সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: ইতোমধ্যে সবাই আমরা জেনে গেছি যে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্বাহী ও পরিচালনা পর্ষদ বাংলাদেশের ঋণপ্রস্তাব অনুমোদন করতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ পাচ্ছে সাড়ে তিন বছরের জন্য ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। মোট সাত কিস্তিতে প্রতিশ্রুত অর্থের প্রথম কিস্তি ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার আসবে মার্চের মধ্যে। অর্থনীতির সঙ্গীন অবস্থায় এ ঋণ দিয়ে স্বস্তির পথে না হাঁটলেও কিছুটা হলেও নিঃশ্বাস নিতে পারবে বাংলাদেশ।
ঋণ পেয়েছে, সেটা বাংলাদেশের প্রতি এই আন্তর্জাতিক সংস্থার এক স্বীকৃতি। তবে অর্থনীতি ঠিক পথে আছে কি না সেটা ভিন্ন বিষয়। একটি অর্থনীতিকে তখনই ঠিক পথের পথিক বলা যায় যখন সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ে আর বেকারত্বের হার কমে। একটি অর্থনীতিকে তখনই স্বাস্থ্যবান বলা যায় যখন মানুষের মাঝে আর্থিক বৈষম্য কমে আসে। এই দুই প্রশ্নেই বাংলাদেশ বহু বছর যাবৎ হোঁচট খাচ্ছে। টানা অনেক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের উচ্চহার বেকার সমস্যার সুরাহা করতে পারেনি, পারেনি মানুষে মানুষে অসাম্য দূর করতে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ বেকার হবে।
করোনার দুই বছরের মধ্যে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টা একটা জায়গায় না আসতেই শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ। ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটায় ২০২২ সালের প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি ঠিক ছিল না। একদিকে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে অত্যধিক, মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, অন্যদিকে চরম ডলার সংকটে আমদানি এবং ব্যাংকিং খাতেও ছিল সংকট। তবে যুদ্ধ শুরুর আগেও যে অর্থনীতি খুব ভালো অবস্থায় ছিল সেটা দাবি করা হয়তো ঠিক হবে না। দুর্বলতাগুলো ত্বরিৎ আকারে প্রকাশিত হয়েছে, এই যা।
সম্প্রতি সরকার গ্যাসের রেকর্ড পরিমান দাম বাড়িয়েছে। সাত মাস পর এবার গ্যাসের দাম বাড়ল ৮২ শতাংশ। শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতের গ্রাহকেরা দেবেন বাড়তি এ দাম। নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। আর্থিক চাপ সামলাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে একের পর এক দাম বাড়াচ্ছে সরকার। মাত্র কিছুদিন আগে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে রেকর্ড পরিমাণে।
নতুন করে শিল্পখাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়াবে যা মূল্যস্ফীতিকে আরেক দফা উসকে দিবে। এমনিতেই চরম গ্যাস সংকটে আছে সব শিল্প। এখন এই অস্বাভাবিক বাড়তি দাম কার্যকর হলে অনেক শিল্পকারখানাই লোকসানে চলে যাবে। অনেকেই হয়তো, বিশেষ করে ছোট-মাঝারি শিল্প মালিকরা, কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে।
আমরা সহজেই বুঝতে পারছি, মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানি সংকটের প্রভাবে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হবে, মন্দাও দেখা দিতে পারে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান দুটি খাতে উজ্জ্বলতার লক্ষণ নেই। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী মন্দায় থাকলে বাংলাদেশের পোশাক খাতের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। সামগ্রিক রপ্তানি খাতই একটা ভাবনার মধ্যে থাকবে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রবাসী আয় বাড়ার সম্ভাবনা আছে বলে একটা ধারণা আছে যেহেতু সেখানে মন্দা অতটা নেই। তবে ডলারের হার বাজারমুখী করতে না পারলে হুন্ডিই ভরসা হবে মানুষের। আর পাচারও অব্যাহত থাকবে।
যে কথাটি বলছিলাম যে, করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ছিল। রপ্তানি আয়ে কোনো গতি ছিল না ২০১৯ সাল থেকেই, আমদানিতেও একই অবস্থা। রাজস্ব আয়ের বড় ঘাটতিতো চিরসঙ্গী। একমাত্র স্বস্তির সূচক ছিল প্রবাসী আয়। এ ছাড়া অর্থনীতির আর কোনো সূচকই ইতিবাচক পথে ছিল না। আর এর মধ্যেই করোনার হানা এবং রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ পুরো বিশ্বের অর্থনীতির গতি স্থবির করে দেয়; যা আমাদেরও প্রভাবিত করে।
২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে চীন ব্যাপকভাবে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। চীনকে অনুসরণ করে আরও অনেক দেশ নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে। কিন্তু বাংলাদেশ সে পথে যায়নি। জোর করে টাকা ডলারের সেই বিনিময় হার নিয়ে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় বেশি দরে পণ্য আমদানি করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়তে শুরু করে। বিনিময় হার কম থাকায় প্রবাসী আয়ও বৈধ পথে আসা কমে যায়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়েই ২০২২ সালে টাকার অবমূল্যায়ন করে, কিন্তু সেটা হয়েছে অনেক দেরি করে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির একটা অদ্ভূত অবস্থা এই যে, একদিকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, আরেক দিকে নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখন ১০ শতাংশের কিছু বেশি। আর নেপালে এ অনুপাত ২৪ শতাংশের ওপরে। এমনকি সাবসাহারান আফ্রিকান দেশগুলোতেও এর চেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত আছে। এই নিম্ন রাজস্ব আদায়ের কারণে কোভিডের সময় প্রণোদনা ছিল ব্যাংকঋণ নির্ভর। রাজস্ব ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পরোক্ষ কর নির্ভর হয়ে একটা নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা জিইয়ে রেখেছে। কর-জিডিপি অনুপাতে পিছিয়ে থাকায় বড় মাশুল দিতে হয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। উন্নয়নের সাথে দুর্নীতি ও টাকা পাচারের কথাও ব্যাপকভাবে উচ্চারিত।
বৈদেশিক মুদ্রার উচ্চ রিজার্ভ নিয়েও ধরে রাখা যায়নি। বিপজ্জনক ভাবে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আপত্তির মুখে রিজার্ভ গণনার পদ্ধতিরও পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
দেশের ব্যাংক ও আর্থিকখাত দুর্বল নজরদারি, খেলাপি ঋণের উচ্চ হার, ঋণ জালিয়াতির খবর আনেকদিনের। এমনকি ব্যাংক দখলের খবরও এসেছে গণমাধ্যমে। খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের হিসাবে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরও অনেক বেশি। এসব খবর কতটা বাস্তব আর কতটা আতংক তার একটা যুৎসই জনধারণা তৈরি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয় ব্যর্থ হয়েছে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, আইএমএফ বাংলাদেশের অর্থনীতির উদ্ধার কর্তা নয়। নিজের সংস্কার নিজের তাগিদেই করতে হবে। তাই ঋণ জালিয়াতি কমানো, টাকা পাচার বন্ধ করা, লোকসান কমানো, কৃচ্ছসাধন এবং দুর্নীতি কিভাবে কমানো যাবে, আগামী দিনের অর্থনীতির ভাবনা সেটিই।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
লেখাটির পিডিএফ দেখতে ক্লিক করুন: দিন দিন