রোজ অ্যাডেনিয়াম
ঢাকাই সিনেমায় আইরিন সুলতানার পথচলার সময়টা দীর্ঘ। একে একে বেশ ক’টি সিনেমার নায়িকা হয়েছেন। প্রশংসিত হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন। হাল ছাড়েননি। সিনেমা যেন কঠিন এক পরীক্ষাক্ষেত্র। একটা সিনেমায় অভিনয় করে অনেক সময় মুক্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয় মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। তার পর মেলে ফলাফল। ২০২২ সালে মুক্তি পেয়েছিল চিত্রনায়িকা আইরিন সুলতানা অভিনীত সর্বশেষ সিনেমা ‘কাগজ’। এরপর দুই বছর বড় পর্দায় দেখা যায়নি তাকে। অনেকেই ভাবছিলেন, হারিয়ে গেছেন নায়িকা। কিন্তু হার মানার পাত্রী নন আইরিন।
দুই বছর পর ফিরলেন
প্রায় দুই বছর পরে বড় পর্দায় দেখা মিললো আইরিনের। ২০২৪ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়েছে তার অভিনীত সিনেমা ‘দুনিয়া’। এ সিনেমা মুক্তির মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন পর ফের আলোচনায় আইরিন। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন সাইফ চন্দন। সিনেমা প্রসঙ্গে আইরিন বলেন, ‘সিনেমার কাজ অনেক আগেই শেষ করা হয়েছিল। কিন্তু মুক্তির জন্য বেশ অপেক্ষা করতে হয়েছে।’
৯ বছর আগের সিনেমা নাম বদলে মুক্তি
যখন এই সিনেমার শুটিং শুরু হয় তখন সিনেমাটির নাম রাখা হয়েছিল ‘টার্গেট’। চিত্রনায়িকা আইরিন বলেন, ‘এখানে আমি অভিনয় করেছি দ্বৈত চরিত্রে।
একটি চরিত্র আধুনিক শহুরে, অন্যটি মফস্বলের মেয়ের। কাজের অভিজ্ঞতা ও এর গল্প নিয়ে আশাবাদী হয়ে বলতে পারি, দর্শক সিনেমাটি দেখে নিরাশ হবেন না।’ এতে আনিসুর রাহমান মিলন ও নিরবের সঙ্গে অভিনয় করেছেন আইরিন। সিনেমাটি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে আইরিন সুলতানা আরও বলেন, “আসলে ‘দুনিয়া’ নামে কোনো সিনেমার শুটিং করিনি। তখন সিনেমার নাম ছিল ‘টার্গেট’। হঠাৎ সিনেমাটি মুক্তির তিন-চার দিন আগে শুনলাম, ‘দুনিয়া’ নামে মুক্তি পাচ্ছে। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কবে, কী নামে মুক্তি দেবে, সেটা তাদের সিদ্ধান্ত। অবশেষে মুক্তি যে পেয়েছে, এতেই আমি খুশি। এত বছর আগের সিনেমা। আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম যে এটা বোধহয় আর মুক্তি পাবে না। কারণ, সেন্সর পাওয়ার পরেও অনেক দিন সিনেমাটির ভাগ্য ঝুলে ছিল। একটা অনিশ্চয়তা ছিল। সেখানে দর্শকেরা সিনেমাটি দেখতে পারছেন, এটাই বড় আনন্দের।”
দর্শক সারিতে বসে সিনেমা দেখা
সম্প্রতি দর্শকের সঙ্গে বসে হলে গিয়ে সিনেমাটি দেখে এসেছেন আইরিন। ক্যারিয়ারের এগারো বছর পার করে বারোতে পা রাখতে যাচ্ছেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকের শুটিং করা সিনেমা দেখে কেমন অনুভব করলেন নায়িকা? আইরিন বললেন, ‘সিনেমা দীর্ঘ সময় আটকে থাকলে অভিনেত্রী হিসেবে খুবই কষ্ট লাগে। আমার মনে হয়, আটকে থাকাটা আমাদের দেশেই বেশি হয়। একটা সিনেমা শুটিং করব, সেটা শেষ হলে মুক্তি পাবে। দর্শক দেখবেন, সেটা নিয়ে প্রতিক্রিয়া পাব। নিজের ভুলভ্রান্তি জানব। এটা নিয়ে শুরুতে একটা উৎসাহ থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে যা হয়, তাতে অনেক সিনেমা মুক্তি পেতে পেতে উৎসাহ হারিয়ে যায়। সিনেমাটি তখনকার সময়ে প্রাসঙ্গিক ছিল। কিছু পরিবর্তন করলে হয়তো ভালো হতো। সেটা তো সম্ভব নয়। আমি মুক্তির দিনেই হলে গিয়েছিলাম সিনেমাটি দেখতে। নিজের সিনেমা সব সময় সমালোচকের মতো দেখি। শুধু মনে হয়, এখানে আরও ভালো করা যেত। ইশ্! আবার যদি সুযোগ পেতাম। এবারও তাই মনে হয়েছে। এ ছাড়া সিনেমার যখন শুটিং করি, তখন মাত্র দর্শক অনলাইনমুখী হয়েছেন। সেখানে থেকে এখন আমরা রিলস, শর্টসে ঝুঁকেছি। কত পরিবর্তন হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে, এখন আমি অনেক পরিণত। ভাবছিলাম, গল্পটা ৯ বছর আগে শুটিং করা। তখন অভিনয়ের অনেক কিছুই শিখছিলাম। পরে সিনেমা দেখে মনে হয়েছে, আমার মধ্যে ম্যাচুরিটি এসেছে। এখন সুযোগ পেলে হয়তো আবার কিছু দৃশ্যে দক্ষতার সঙ্গে অভিনয় করতাম।’
মুক্তির অপেক্ষায় হাফ ডজন
মাঝে মিডিয়া থেকে খানিকটা দূরে ছিলেন আইরিন। চাকরি নিয়েছিলেন। বছরখানেক আগে চাকরি ছেড়েও দিয়েছেন। ‘দুনিয়া’ সিনেমা মুক্তির আলোয় আসার পরে আবারও চলচ্চিত্র নিয়েই সরব হন নায়িকা। জানা গেছে, আইরিন বেশ আগে নতুন কয়েকটি সিনেমার কাজ শেষ করেছেন। এর মধ্যে অনেক সিনেমা সেন্সরও হয়ে আছে। এগুলো হয়তো সামনে মুক্তি পাবে। মুক্তির অপেক্ষায় আছে তার অভিনীত ‘রৌদ্রছায়া’, ‘চৈত্রদুপুর’, ‘হৃদমাঝারে’সহ ছয়টি সিনেমা।
বর্তমান ব্যস্ততা
এখন উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছেন আইরিন। এ ছাড়া গল্প এলে কাজ করছেন। সামনে হয়তো ওটিটির কাজ শুরু করতে যাচ্ছেন। আইরিন সুলতানা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি সব সময় ভাগ্যে বিশ্বাস করি। যেভাবে আছি, ভালো আছি। ক্যারিয়ার নিয়ে আফসোস নেই। হয়তো যে সিনেমাগুলো করতে পারিনি, সেগুলো না করাই ভালো ছিল। আমি বলব, আমাকে প্রোডাকশন হাউসগুলো ঠিকমতো ব্যবহার করেনি। আমার কাছে নায়িকা পরিচয় অনেক সম্মানের। সবাই কি নায়িকা হতে পারে? আমি এখনও চেষ্টা করছি। নায়িকা হিসেবে যে সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেছি, সেগুলো নিয়ে খুশি। এখন কোনো নায়িকা চাইলেই কি সব পায়? আমি তো গল্প চাইতে পারি না। আমার কাছে গল্প আসতে হবে। আমি পরিকল্পনা করে তো লাভ নেই। আমাকে নিয়ে কাউকে ভাবতে হবে। আমি প্রযোজনা করব, সেই ক্ষমতা তো নেই। প্রজেক্ট নিয়মিত এলে আরও ভালো কাজ করা হতো।’
এক নজরে নায়িকা
১৯৮৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আইরিন। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশের একজন মডেল ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। ২০০৮ সালের ‘প্যান্টেনা ইউ গট দ্য লুক’ প্রতিযোগিতায় ‘সেরা হাসি’ পুরস্কার পাবার পর থেকে বিনোদন মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু হয় তার। দেশে এবং বিদেশে বহু র্যাম্প মডেলিং অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। তার চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় দেবাশীষ বিশ্বাস পরিচালিত ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে, যা ২০১৩ সালের ৮ নভেম্বর মুক্তি পায়। এই সিনেমাটি বক্স অফিসে সাড়া জাগায়।
অভিনীত যতো সিনেমা
আইরিন অভিনীত সিনেমার তালিকা বেশ দীর্ঘ নয়। কিন্তু ভালো কিছু কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তার অভিনীত সিনেমাগুলো মধ্যে আছে – দেবাশীস বিশ্বাস পরিচালিত ‘ভালোবাসা জিন্দাবাদ’ ২০১৩, সাইমন জাহান পরিচালিত ‘টাইম মেশিন’ ২০১৪, গাজিয়ুর রহমান পরিচালিত ‘এই তুমিই সেই তুমি’ ২০১৪, সাইফ চন্দন পরিচালিত ‘ছেলেটি আবোল তাবোল মেয়েটি পাগল পাগল’ ২০১৫, আলভী আহমেদ পরিচালিত ‘ইউ-টার্ন’ ২০১৫, এস এ হক অলিক পরিচালিত ‘এক পৃথিবী প্রেম’ ২০১৬, আকাশ আচার্য পরিচালিত ‘মায়াবিনী’ ২০১৭, আবু সাঈদ পরিচালিত ‘ডেড অফ এ পয়েট’ ২০১৭, সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান ডায়মন্ড পরিচালিত ‘শেষ কথা’ ২০১৭, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু পরিচালিত ‘আকাশ মহল’, ২০১৯, হারুণ উজ জামান পরিচালিত ‘পদ্মার প্রেম’ ২০১৯ এবং আলী জুলফিকার জাহেদী পরিচালিত ‘কাগজ’ ২০২২। আর এইসব সিনেমায় আইরিন যেসব নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন তারা হলেন আরিফিন শুভ, সাইমন, কায়েস আরজু, আলভী আহমেদ, আসিফ নূর, ইমন, সুমিত সেনগুপ্ত প্রমুখ।
ছোট পর্দায়
ছোট পর্দার নাটক ও মেগা সিরিয়ালেও অভিনয় করেছেন আইরিন সুলতানা। তার অভিনীত আরটিভিতে প্রচারিত মেগা সিরিয়াল ‘ম্যানপাওয়ার’। এটির পরিচালক ছিলেন আশুতোষ সুজন। আরও অভিনয় করেছেন আফসানা মিমি পরিচালিত এটিএন বাংলার ধারাবাহিক ‘পৌষ ফাগুনের পালা’য়। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য একক নাটকগুলোর মধ্যে আছে এ বি সোহেল পরিচালিত ‘অনুভবে ভালোবাসা’। আরও অভিনয় করেছেন আহমেদ সুস্ময় পরিচালিত একক নাটক ‘ভালোবাসা ও একটি কাল্পনিক কাহিনী’। আরও আলোচনায় আসে আইরিন অভিনীত সৈকত নাসির পরিচালিত ওয়েব ধারাবাহিক ‘ট্র্যাপড’ ও অনন্য মামুন পরিচালিত ‘ধোঁকা’।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি
ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে বেশ কিছু পুরস্কারও পেয়েছেন আইরিন। এছাড়া দর্শকের ভালোবাসাও পেয়েছেন অনেক। প্যান্টিং ইউ গট লুক ২০০৮ প্রতিযোগিতায় ‘সেরা হাসি’ টাইটেল বিজয়ী হয়েছিলেন। বেল মডেলস ইন্টারনেট বিউটি কনটেস্ট ২০১১ প্রতিযোগিতায় চতুর্থ রানার আপ হয়েছিলেন, বেল মডেলস ইন্টারনেট বিউটি কনটেস্ট ২০০৯ প্রতিযোগিতায় পঞ্চম রানার আপ হয়েছিলেন। ‘ভালবাসা জিন্দাবাদ’ সিনেমার জন্য ২০১৩ সালে পেয়েছিলেন বায়োস্কোপ বর্ষ-সেরা সেরা চলচ্চিত্র অভিনেত্রী (নবাগতা) পুরস্কার। একই সিনেমার জন্য ওই বছর পান বিনোদন-ধারা পারফরমেন্স অ্যাওয়ার্ড শ্রেষ্ঠ আলোচিত নায়িকার পুরস্কার।
শেষ কথা
বাংলাদেশি সিনেমার পাশাপাশি কলকাতার সিনেমায়ও অভিনয় করেছেন আইরিন। রাজ আদিত্য ব্যানার্জী পরিচালিত কলকাতার সিনেমাটির নাম ‘শিবরাত্রি’। আইরিন সুলতানা বলেন, ‘শুধুই সিনেমায় অভিনয় করতে চাই। সেটা যে দেশেরই হোক। তবে, নিজ দেশের সিনেমাকে সবার আগে প্রাধান্য দেবো। সিনেমা নিয়েই যত স্বপ্ন আমার। সিনেমা নিয়েই সমস্ত ভাবনা। ভালো কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়, আমিও করছি। নতুন নতুন সিনেমার অফার আসছে। একটু ভিন্ন গল্প, ভিন্ন চরিত্র হলেই করব। বেছে বেছে সিনেমা করতে চাই। সংখ্যায় নয়, কোয়ালিটির দিকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।’
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি