আগ্রহের কেন্দ্রে চ্যাটজিপিটি

আশফাক আহমেদ: এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে আগ্রহীদের কাছে খুব দ্রুত জায়গা করে নিচ্ছে চ্যাটজিপিটি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই অ্যাপ্লিকেশনটি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। সবচেয়ে অভিনব হলো, প্রচলিত কম্পিউটার সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশনের বাইরে গিয়ে নিজের মতো বুদ্ধিমত্তার ছোঁয়া দিতে পারে। বিশ্বজুড়ে চ্যাটজিপিটি নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। গত জানুয়ারি মাসে বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছে। গবেষক, শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার মানুষ চ্যাটজিপিটির সহায়তা নিতে শুরু করেছেন।

চ্যাটজিপিটি হলো চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেইনড ট্রান্সফর্মার। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এমন একটি অ্যাপ্লিকেশন যাকে বলা হয় ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল টুলস’। একটি চ্যাটবট সিস্টেম বা আলাপচারিতা করার অ্যাপলিকেশন। চ্যাটজিপিটি তার তথ্যভাণ্ডারে থাকা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে লিখিত প্রশ্নের জবাব দেয়। যে ফরম্যাটে বা যেভাবে চাওয়া হয়, অনেকটা সেভাবেই উত্তর দেয়। অন্য সার্চ ইঞ্জিনের মতো চ্যাটজিপিটি এখনো লাইভ বা সরাসরি ইন্টারনেটে কাজ করে না। ইন্টারনেটে ২০২১ সাল পর্যন্ত যেসব তথ্য রয়েছে, শুধু সেগুলোই তার তথ্যভাণ্ডারে রয়েছে।

এর আগেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। গুগল বা এক্সপ্লোরারের মতো সাইটগুলোয় কিছু অনুসন্ধান করলে সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটের লিংক হাজির করে। কিন্তু চ্যাটজিপিটি যেভাবে সরাসরি সুনির্দিষ্ট উত্তর দিয়ে দেয়, এমনটা আর দেখা যায়নি। চ্যাটজিপিটি রচনা লিখতে পারে, চাকরি বা ছুটির আবেদন, চুক্তিপত্র, কোনো ঘটনা সম্পর্কে ব্যাখ্যা, ছোটখাটো প্রতিবেদন তৈরি করে দিতে পারে। এমনকি এটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম, গান বা কবিতাও লিখতে পারে। উত্তর পছন্দ না হলে চ্যাটজিপিটিকে আবারো নির্দেশনা দিলে আরো ভালো করে উত্তর তৈরির চেষ্টা করে। এতে অনেক কাজ বেশ সহজ হয়ে গেছে। এমনকি ছোটখাটো রসিকতা করলে সেটাও বুঝতে পারে চ্যাটজিপিটি। এটাও এর জনপ্রিয়তার একটি কারণ। এই প্রোগ্রামের সুবিধা হলো, যতো ব্যবহার হয় এর সাথে সাথে এটি আরো বেশি শিখতে থাকে। ব্যবহারকারীর প্রশ্নের ধরন বা তথ্য থেকে চ্যাটজিপিটি নিজেকে আরো সমৃদ্ধ করে তোলে। চ্যাটজিপিটি আসলে নিজে থেকে কিছু জানে না। প্রোগ্রামটিকে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বা তৈরি করা হয়েছে নিজ তথ্যভাণ্ডারে থাকা তথ্য-উপাত্ত খুঁজে উত্তর তৈরি করে।

চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করতে এখনো কোনো অর্থ লাগে না। তবে গত জানুয়ারি মাসে একটি পেইড ভার্সন বা অর্থের বিনিময়ে ব্যবহারের একটি ভার্সন চালু হয়েছে। পেইড ভার্সনটি আরো দ্রুত কাজ করে। যখন পিক টাইমে অন্যরা চ্যাটজিপিটিতে ঠিক মতো প্রবেশ করতে পারেন না, সেই সময়েও কাজ করে পেইড ভার্সনটি। আপাতত শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে মাসিক ২০ ডলার করে সার্ভিস চার্জ ধরা হয়েছে। বাকিদের এই ভার্সনটি ব্যবহার করতে কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

ঘরের কাজের দখল নেবে রোবট
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবট নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। তবে বিশ্লেষক ও গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, এক দশক বা ২০৩৩ সাল নাগাদ ঘরের ৩৯ শতাংশ কাজই রোবট করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে অভিজ্ঞ ৬৫ জনের কাছে আগামী ১০ বছর পর গৃহস্থালি কাজে রোবট ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চায় যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের গবেষকরা। তাদের মতে, ঘরের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাকাটায় অটোমেশন বা রোবটের ব্যবহার বেশি হবে। তবে শিশু ও বয়স্কদের পরিচর্যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। গবেষকরা দেখতে পান, ঘরের বিভিন্ন কাজের মধ্যে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হিসেবে যেসব রোবট তৈরি হয়েছে সেগুলোর ব্যবহার ও বিক্রি বেশি।

অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের গবেষক ড. লুলু শি বলেন, ‘ব্যবহারকারীর সন্তানকে শেখানো, তার সঙ্গে থাকা বা পরিবারের বয়স্ক সদস্যের যত্ন নেওয়ার মতো কেবল ২৮ শতাংশ পরিচর্যাসংশ্লিষ্ট কার্যক্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটার পূর্বাভাস মিলেছে।’ অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলেন, রোবট ব্যবহারের মাধ্যমে গৃহস্থালি কেনাকাটার পেছনে খরচ করা সময়ের ৬০ শতাংশ কমে আসবে। আগামী ১০ বছরে রোবট মানুষকে ঘরোয়া কাজ থেকে মুক্তি দেবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণীর দীর্ঘ ইতিহাস আছে। তবে এ বিষয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেন। ১৯৬৬ সালে টুমরোস ওয়ার্ল্ড নামের এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ঘরোয়া রোবট নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তথ্যানুযায়ী রোবট খাবার রান্না থেকে শুরু করে, পোষা কুকুরকে হাঁটতে নিয়ে যাওয়া, শিশুর দেখভাল, কেনাকাটার মতো অনেক কাজে পারদর্শী। সে সময় রোবটটির নির্মাতারা যদি ১২ লাখ ডলার অনুদান পেতো তাহলে ১৯৭৬ সাল নাগাদ এটি বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করা সম্ভব হতো।

অনেকের মতে, একাধিক সাধারণ কাজ করতে পারে এমন রোবট বানানো জটিল ও ব্যয়বহুল। এর বদলে সহায়তা করবে, এমন সহায়ক প্রযুক্তি বানানো তুলনামূলক সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকদের অনেকের অভিমত, বর্তমানে বিশ্বে নারীদের ওপর গৃহস্থালি কাজের যে বোঝা তা তাদের উপার্জন, সঞ্চয় ও পেনশনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রোবটের ব্যবহার বাড়লে তা নারী-পুরুষের সমতা বিধানে সহায়ক হবে। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার ব্যয়বহুল। এছাড়া প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

মেটাভার্সে প্রথম আদালত

মেটাভার্সে প্রথমবার শুনানি পরিচালনা করেছে কলম্বিয়ার এক আদালত। কলম্বিয়ার ‘মাগডালেনা প্রশাসনিক আদালতে’র দুই ঘণ্টা দীর্ঘ শুনানিতে, ট্রাফিক বিরোধের জেরে অংশগ্রহণকারীরা এক ভার্চুয়াল কোর্টরুমে অ্যাভাটার হিসেবে হাজির হন। আর কালো রঙের আইনি পোশাকে শুনানি পরিচালনা করেন ম্যাজিস্ট্রেট মারিয়া কুইনোস ট্রায়ানার অ্যাভাটার। ডিজিটাল জায়গাকে তুলনামূলক প্রাণবন্ত করে তোলা অংশগ্রহণকারীদের বিভিন্ন অ্যাভাটারের সাহায্যে উপস্থাপনের মাধ্যমে মেটাভার্স ও ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে সত্যিকারের আদালত শুনানি পরীক্ষা করা বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে কলম্বিয়া আবির্ভূত হলো।

মেটাভার্স অভিজ্ঞতাকে ‘বিস্ময়কর’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিচারক কুইনোস বলেন, ‘এটা ভিডিও কলের চেয়েও আসল বলে মনে হয়। জুম কলে অনেকে নিজের ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়ায় বোঝা যায় না তারা সে সময় কি করছেন।’ কুইনোস বলেন, দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আনা এক আঞ্চলিক পরিবহন ইউনিয়নের এই মামলা এখন আংশিকভাবে এগিয়ে যাবে মেটাভার্সেই। এর মধ্যে থাকতে পারে রায়ও। অন্যান্য জায়গায় মেটাভার্সভিত্তিক শুনানির সম্ভাবনাও পুরোপুরি উড়িয়ে দেননি তিনি।

জুম ও গুগলের বিভিন্ন ভিডিও কল মিটিংয়ে আদালত শুনানি পরিচালনার ঘটনা দিন দিন বেড়ে চলছে। এমনকি কেউ কেউ মেটাভার্সেও এর পরীক্ষা চালাচ্ছে। এটি এমন এক ডিজিটাল জায়গা, যা তৈরির পেছনে ‘প্রতিযোগিতা’ চলছে মেটা, মাইক্রোসফট ও অন্যান্য প্রযুক্তি জায়ান্টের মধ্যে। ভার্চুয়াল ট্রাইব্যুনালের সাংবিধানিক বৈধতা পুনর্ব্যক্ত করলেও দর্শকদের ৭০ শতাংশই এতে সম্মত নয়। পরীক্ষাটি জনপ্রিয় হয়নি। কলম্বিয়ার ‘ইউনিভার্সিটি অফ রোজারিও’র জননীতি বিষয়ক অধ্যাপক জুয়ান ডেভিড গুতেরেস বলেন, আইনি কার্যক্রমে মেটাভার্সের ব্যবহার বাস্তবায়নে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কারণ, ন্যায়বিচার ও সমতার মতো বিষয়গুলোর প্রবেশযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তোলে এটি। বিচারক কুইনোস স্বীকার করেন, এর খরচ ও প্রবেশগম্যতা নিয়ে কথা বলা দরকার। তবে উদাহরণ হিসেবে বিভিন্ন নিপীড়নসংশ্লিষ্ট মামলায় মেটাভার্সের পক্ষে সমর্থন দেন তিনি। কারণ অংশগ্রহণকারীদের শারীরিকভাবে একে অপরকে দেখার মতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে না। গুতেরেস বলেন, কলম্বিয়ার বিচারকরা দেশটির বিচার ব্যবস্থার ওপর যে মামলার চাপ রয়েছে তা কমিয়ে আনার বিভিন্ন উপায় খুঁজে দেখছেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: টেক ট্রেন্ড

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four + 16 =