আজ অভিনেতা মমতাজউদদীন আহমেদের জন্মদিন

দেশের প্রথিতযশা নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, অভিনেতা, কলামিস্ট ও ভাষাসৈনিক অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের অনন্য পথিকৃৎ। বাংলাদেশের নাট্যইতিহাসে এক অঙ্কের নাটক লেখায় তিনি বিশেষ পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

মমতাজউদদীন আহমেদ ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম কলিমুদ্দিন আহমদ ও মাতার নাম অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমেদ সখিনা বেগম।

তিনি মালদহ আইহো জুনিয়র স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৯৫১ সালে ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দেশ বিভাগের পর তার পরিবার তদানিন্তন পূর্ববঙ্গে চলে আসেন। পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বি.এ (অনার্স) ও এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন।

তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ভোলাহাট উপজেলায় শৈশব অতিবাহিত করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে অংশ নেন। রাজশাহীর ভাষা আন্দোলন কর্মী গোলাম আরিফ টিপুর সাথে তিনি রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা পালন করেন।

রাজশাহী কলেজে বাংলাদেশের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণেও ভূমিকা পালন করেন মমতাজউদদীন আহমেদ। ১৯৫৪, ১৯৫৫, ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে তিনি প্রগতিশীল রাজনীতির কারণে কারাবরণ করেন।

বেতারে তার অনেক নাটকই প্রচার হয়েছে এবং প্রায় সবই শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে বেতারে প্রচারিত জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে অন্যতম হলো ‘কী চাহো শঙ্খচিল’। এটি মমতাজউদদীন আহমেদেরও প্রিয় নাটক। টেলিভিশনে তার লেখা প্রচার হওয়া প্রথম নাটক ছিল ‘দখিনের জানালা’। এটি নির্মাণ করেছিলেন প্রয়াত আতিকুল হক চৌধুরী।

তবে টেলিভিশনে প্রচারিত নাটকের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পায় প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুনের পরিচালনায় ‘ঝড়ের মধ্যে বসবাস’। টেলিভিশনে তার লেখা প্রচারিত জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ‘কূল নাই কিনার নাই’ ও ‘সহচর’। দুটি নাটকই নির্মাণ করেছিলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ ও নওয়াজেশ আলী খান। হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় ‘শঙ্খনীল কারাগার’ চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও তার দশটি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছিলে মমতাজউদদীন আহমদ।

সৈয়দ হাসান ইমাম পরিচালিত ‘লাল সবুজের পালা’ চলচ্চিত্রের কাহিনি, সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনা করেছেন মমতাজউদদীন আহমদ। প্রয়াত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলামের ‘শাস্তি’, ‘সুভা’ ও ‘হাছনরাজা’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও তিনি করেছিলাম। তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’, ‘নদীর নাম মধুমতি’ ও মহিউদ্দিন ফারুকের ‘বিরাজ বৌ’ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি।

পেশাগতভাবে মমতাজউদদীন আহমেদ ১৯৬৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ৩২ বছরেরও বেশি সময় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় নাট্যকলায় শিক্ষাদান করেছেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন তিনি। ১৯৭৬-৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মমতাজউদদীন আহমেদ।

তিনি ভারতের দিল্লী, জয়পুর এবং কলকাতায় নাট্যদলের দলনেতা হিসাবে ভ্রমণ ও নাট্য মঞ্চায়ন করেন। তার লেখা নাটক ‘কি চাহ শঙ্খ চিল’ এবং ‘রাজা অনুস্বরের পালা’ রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এ ছাড়াও তার বেশ কিছু নাটক, বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে নিয়মিত কলামও লিখেছেন।

মমতাজউদদীন শিক্ষক ও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেলেও থিয়েটারের মাধ্যমে তার কর্মজীবনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন কর্মী হিসেবে সক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এছাড়াও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।

মমতাজউদদীন ১৯৭৭-৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার স্ত্রী কামরুন্নেসা মমতাজ, দুই ছেলে, দুই মেয়ে তিয়াসা, তিতাস, তমাল ও তাহিতি আমেরিকাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

বিভিন্ন সরকারি কলেজে ৩২ বছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি বাংলা ও ইউরোপীয় নাটক বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৯৭ সালে নাট্যকার হিসেবে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও শিল্প ও সাহিত্যে অনন্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন।

তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৯৭), নাট্যকলায় অবদানের জন্য ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাউল সাহিত্য পুরস্কার।

তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- (গবেষণা ও প্রবন্ধ) বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত, বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু। নাটকের মধ্যে রয়েছে- নাট্যত্রয়ী, হৃদয় ঘটিত ব্যাপার স্যাপার, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা (১৯৭১), কি চাহ শঙ্খ চিল (১৯৮৫), প্রেম বিবাহ সুটকেশ, জমিদার দর্পণ, রাজা অনুস্বরের পালা, ক্ষত বিক্ষত, রঙ্গপঞ্চাদশ, বকুল পুরের স্বাধীনতা, সাত ঘাটের কানাকড়ি, রাক্ষসী।

গদ্য রচনাসমগ্রের মধ্যে রয়েছে- চার্লি চ্যাপেলিন-ভাঁড় নয় ভব ঘুরে নয়, আমার ভিতরে আমি, জগতের যত মহাকাব্য, হৃদয় ছু আছে, লাল সালু ও সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, মহানামা কাব্যের গদ্যরূপ, সাহসী অথচ সাহস্য, নেকাবী এবং অন্যগণ, জন্তুর ভিতর মানুষ, ভালবাসিলেই, সজল তোমর ঠিকানা (উপন্যাস), এক যে জোড়া, এক যে মধুমতি (উপন্যাস), অন্ধকার নয় আলোর দিকে।

২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি বিকেল ৩টা ৩৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেশবরেণ্য গুণী এই নাট্যকার ৮৫ বছর বয়সে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। সশরীরে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও নিজের অনন্য সৃজন-মননের জন্য বহুকাল বাঙালির অন্তরে উজ্জ্বল হয়ে বেঁচে থাকবেন সবার প্রিয় মমতাজউদদীন আহমেদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 1 =