আদুরে প্রাণী বিড়াল

ঋষিকা

জনপ্রিয় পোষা প্রাণীর মধ্যে অন্যতম বিড়াল। প্রাচীন মিসরে বিড়াল অত্যন্ত সম্মানিত ও পবিত্র প্রাণী হিসেবে বিবেচিত হতো। তারা বিশ্বাস করতো, কোনো বিড়ালকে আঘাত করা বা হত্যা করার মানে নিজের দুর্ভাগ্য বয়ে আনা। জাপানে মানেকি-নেকো নামে পরিচিত বিড়ালের মূর্তি মালিকের সৌভাগ্য বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করা হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বিড়াল নিয়ে নিজস্ব কুসংস্কারও আছে। বিড়ালকে বলা হয় বাঘের মাসি। এদের চলাফেরায় আর আচার-আচরণে আছে অদ্ভুত এক রাজকীয় ভাব। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে এরা কেতাদুরস্ত ও আরামপ্রিয়। আলস্যে এরা অন্য যেকোনো প্রাণীর মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

বিড়াল দিবসের ইতিহাস

বিড়াল স্বাস্থ্যের জন্য ভালো এবং উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য অসুস্থতার ঘটনা কমাতে পারে তা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। দিন দিন নানা জাতের বিড়াল পালার অভ্যাস ও শখ বাড়ছে মানুষের মধ্যে। এই বেড়ে চলা জনগোষ্ঠীর জন্য আছে বিড়ালের জন্য বিশেষ একটি দিন। বিশ্বব্যাপী বিড়ালপ্রেমীদের জন্য প্রতি বছর ৮ আগস্ট পালন করা হয় বিড়াল দিবস। মাংস খাওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বিড়াল সবচেয়ে বেশি গুণান্বিত। তাদের মস্তিষ্ক বড় এবং উন্নত। শতাব্দি ধরে মানুষের সঙ্গে বসবাস করে আসছে বিড়াল। শুরুতে শিকারীরা বিড়ালকে শিকারের সঙ্গী হিসেবে গৃহে পালন শুরু করে। সেই থেকে তারা মানুষের সঙ্গে বাস করছে। ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক প্রাণী কল্যাণ তহবিল ৮ আগস্টকে আন্তর্জাতিক বিড়াল দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। আন্তর্জাতিক বিড়াল দিবস কখনও কখনও বিশ্ব বিড়াল দিবস হিসেবে পরিচিত। বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশ অস্ট্রেলিয়া, ভারত এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিবসটি পালিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন দেশে বিড়াল দিবস উদযাপনের জন্য নিজস্ব দিন রয়েছে। যেমন রাশিয়া ১ মার্চ বিশ্ব বিড়াল দিবস পালন করে।

যারা ঘরে বিড়াল পোষেন তারা শারীরিকভাবে অন্যদের তুলনায় বেশ সুস্থ থাকেন। বিড়াল পুষলে মানসিক চাপ কমে যায়। ইঁদুরের উৎপাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি মাছের কাঁটা, ঝুটা খাবার খেয়ে পরিবেশ রাখে সুন্দর। এছাড়া বিড়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন ভূমিকম্পের আভাস পায়।

বিড়ালের জনপ্রিয় পাঁচ জাত

তুর্কি আঙ্গোরা

বিড়ালের একটি জাত আছে যাদের রঙ সাদা ও এদের চোখ নানা রঙের হয়। এই প্রজাতির বিড়াল প্রাচীনতম এবং প্রাকৃতিক প্রজাতির বিড়াল। জাতটির নাম তুর্কি আঙ্গোরা। এদের জন্ম মধ্য তুরস্কের আঙ্কারা অঞ্চলে। ১৭ শতকের প্রথম দিকে এদের নথিভুক্ত করা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এদের রূপ গুণে বৈচিত্র্য এসেছে। মুখ না খুলেই বিভিন্ন আকর্ষণীয় শব্দের মাধ্যমে মনের ভাব বোঝাতে পছন্দ করে এই প্রজাতির বিড়াল।

ব্রিটিশ শর্টহেয়ার

শিকার দক্ষতা এবং শক্তির জন্য পরিচিত ব্রিটিশ শর্টহেয়ার জাতের বিড়াল। এটি প্রাচীনতম ইংরেজ জাতগুলির মধ্যে একটি। ঘন নীল-ধূসর রঙের কারণে এ জাতকে ‘ব্রিটিশ নীল’ বলা হয়। এরা সাধারণত বসে থাকে। তবে এই বিড়াল বিনোদন দিতে বা মালিকের সাথে সময় কাটাতে বেশি ভালোবাসে।

পারস্য বিড়াল

পারস্য বা পার্সিয়ান বিড়াল ঘুমাতে খুব পছন্দ করে। অলস প্রকৃতির বিড়ালগুলো বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিড়ালের মধ্য একটি। ২৪ ঘণ্টার ভেতর ১৮ ঘণ্টাই এরা অনায়সে ঘুমাতে পারে। তাদের চওড়া মুখ, চ্যাপ্টা নাক এবং চোখ বড় হয়। পার্সিয়ানদের ১০০টিরও অধিক প্রজাতি রয়েছে। এদের গায়ের লোম অনেক সিল্কি এবং এরা খুব মিশুক। তবে পারস্য বিড়াল বেশি সময় ধরে একা থাকতে পছন্দ করে না।

ওসিকেট

ইংরেজি ওসিকেট থেকে আসা শব্দ ওসিকেট। এটি বিড়ালের একটি জাত। ওসিকেট বিড়াল পেশিবহুল শক্তিশালী প্রাণী। এরা বিখ্যাত স্বল্পকেশি বিড়াল হিসেবে। এই বিড়ালের জন্ম ক্রসের মাধ্যমে। প্রাপ্তবয়স্কদের ওজন ৩.৫ থেকে ৭ কেজি পর্যন্ত হয়। এদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দুর্দান্ত শেখার দক্ষতা।

ম্যাঙ্কস

ম্যাঙ্কস বিড়াল দেখতে গোলাকার। এদের সুন্দর মুখ, মোটা গাল ও পশমের পুরুত্ব দেখে সহজেই এদের শনাক্ত করা যায়। এই বিড়ালের লেজ নেই। এরা খেলতে ও সাঁতার কাটতে ভীষণ ভালোবাসে। শক্তিশালী ও পেশিবহুল পায়ের জন্য এরা সহজেই অনেক উচ্চতায় লাফ দিতে পারে।

বিড়াল নিয়ে মজার পাঁচ

বিড়াল যে অত্যন্ত উপকারী প্রাণী, এ নিয়ে কিন্তু কোনো সংশয় নেই। তবে দারুণ ঈর্ষাকাতর ও অভিমানী প্রাণী। আদরযত্নে একটু কমতি টের পেলে অভিমান করে। মার্কিনিরা বছরে শিশুদের খাবারের চেয়ে বিড়ালের খাবারে বেশি ব্যয় করে। জেনে নেওয়া যাক এদের নিয়ে মজার কিছু তথ্য।

বিড়াল তাদের কান ১৮০ ডিগ্রি ঘোরাতে পারে। বিড়ালের কান ৩০টিরও বেশি পেশির সাথে সংযুক্ত থাকে। কান ঘোরানোর এই ক্ষমতা বিড়াল নির্ভুলভাবে শিকার শনাক্ত করতে ব্যবহার করে। বিড়ালের পেষণকারী দাঁত নেই এবং তাই এরা খাবার চিবাতে পারে না। পরিবর্তে, তারা খাবার কেটে ফেলে। বিড়াল একশর বেশি শব্দ করতে পারে।

বিড়ালের একটি তৃতীয় চোখের পাতা আছে, যা নিক্টিটেটিং মেমব্রেন নামে পরিচিত। এই মেমব্রেনটি তাদের চোখের ভিতরের কোণে অবস্থিত টিস্যুর একটি পাতলা ও স্বচ্ছ স্তর। অন্য দুটি চোখের পাতা থেকে ভিন্ন, নিক্টিটেটিং মেমব্রেনটি উল্লম্বভাবে নয় বরং চোখজুড়ে অনুভূমিকভাবে চলে। তৃতীয় চোখের পাতার প্রধান কাজ হলো চোখকে আঘাত থেকে রক্ষা করা এবং আর্দ্র রাখা। বিড়ালের চোখের তৃতীয় পাতার গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রয়েছে কিছু বিড়াল শিকার ধরতে তাদের তৃতীয় চোখের পাতা ব্যবহার করে।

বিড়াল সাধারণত একাকী প্রাণী। তাই বিড়ালের বড় দল দেখা যায় না। বন্য বিড়াল উপনিবেশ গঠন করতে পারে। তবে বাড়ির বিড়াল সামাজিক বন্ধন তৈরি করে। বিড়ালের একটি দলকে ক্লাউডার বলা হয়। বিড়াল সামাজিক প্রাণী এবং তারা সাহচর্য পছন্দ করে।

মানুষ এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীর বিপরীতে বিড়ালের ব্যতিক্রমী নমনীয় মেরুদণ্ড রয়েছে যা তাদের দেহকে সবধরনের অস্বাভাবিক অবস্থানে বিভক্ত করতে সাহায্য করে। এই নমনীয়তার কারণ বিড়ালের মেরুদণ্ড মানুষের তুলনায় অনেক বেশি কশেরুকা নিয়ে গঠিত। মানুষের সাধারণত ৩৩টি কশেরুকা থাকে, বিড়ালের থাকে ৫৩ থেকে ৭০টি। তাদের মেরুদণ্ডে প্রচুর সংখ্যক ইন্টারভার্টিব্রাল ডিস্ক রয়েছে, যা শক শোষক হিসেবে কাজ করে এবং নড়াচড়ার সময় হাড় কুশন করতে সহায়তা করে। এ কারণ বিড়ালকে অবিশ্বাস্য দুর্দান্ত শিকারী এবং অ্যাক্রোব্যাট করে তোলে।

বিড়াল মিষ্টি জিনিসের স্বাদ নিতে পারে না। যদিও মানুষ এবং অন্যান্য অনেক প্রাণীর একটি স্বাদ রিসেপ্টর রয়েছে যা বিশেষভাবে মিষ্টি স্বাদ শনাক্ত করার জন্য। তবে বিড়ালদের এই নির্দিষ্ট রিসেপ্টরটি নেই। পরিবর্তে, বিড়াল আরও সুস্বাদু এবং মাংসযুক্ত স্বাদ পছন্দ করে। তাই যখন আপনি মিষ্টি কিছু খাচ্ছেন, তখন সেই খাবার আপনার আশেপাশে থাকা বিড়ালকে খাওয়াতে যাবেন না।

বিশ্বে বিড়ালের তিন শহর

ইস্তাবুল, তুরস্ক

তুরস্কের অন্যতম প্রাচীন শহর ইস্তাম্বুলের সরু গলি কিংবা কোনো বাড়ির ছাদ অথবা জানালার কার্নিশে দেখা যায় বিড়াল। পুরো শহরই যেন বিড়ালের বিচরণ ক্ষেত্র। এজন্যই হয়তো ইস্তাম্বুলকে বিড়ালের শহর নামে ডাকেন অনেকে। এই শহরের অনেক মানুষই বিড়াল কিনে লালন পালন করে। কেনার সময় দামের দিকে নজর দেন না। শুধু যে দেখতে সুন্দর বিড়াল তারা কেনেন, এমন নয়। পা নেই কিংবা চোখে দেখে না অথবা অন্য কোনো সমস্যা আছে, তাতে কি! তবুও বিড়াল কেনেন বিড়ালপ্রিয় এ শহরের মানুষরা। এরপর তাদের প্রথম কাজ হয় বিড়ালদের ক্লিনিকে ভর্তি করা। বিড়াল যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন বিড়াল ক্রেতাদের চোখে-মুখে অন্যরকম দীপ্তি দেখা যায়। ইস্তাম্বুল ঘেঁষা জেলা চিহানগির। এ জেলার দৃশ্যও অভিন্ন। এ শহরেও দাপিয়ে বেড়ায় বিড়াল। তবে এখানকার অন্যতম আকর্ষণ রাস্তায় সারি সারি সাজিয়ে রাখা বিড়ালদের আশ্রয় ঘর।

কোটর, মন্টিনিগ্রো

পাহাড় এবং সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ইউরোপের মন্টিনিগ্রোর শহর কোটর। এখানে অতি প্রাচীন ভবন, ক্লক টাওয়ার, দুর্গ ইত্যাদি দেখা যায়। এই শহরের সর্বত্রই বিড়াল দেখা যায়। সেখানকার প্রায় প্রতিটি রাস্তায় অনেক বিড়াল ঘোরাঘুরি করে। এই কারণে শহরটি বিড়ালপ্রেমীদের জন্য স্বর্গের চেয়ে কম নয়! এখানে কেউ বিড়ালদের তাড়া দেয় না। ২০১২ সালে, এখানে প্রথম বিড়াল-থিমযুক্ত স্যুভেনির দোকান খোলা হয়েছিল যার নাম ক্যাটস অব কোটর। এই দোকানের মালিক অক্সানা ট্রোশিনা মনে করতেন এই বিড়ালগুলো শহর এবং এর বাসিন্দাদের জন্য সৌভাগ্য নিয়ে আসে। এখানে বিড়াল জাদুঘর খোলা হয়েছে। শীতের দিনে সাধারণ মানুষ বিড়াল বাড়িতে নিয়ে আসে। বিশ্বাস করা হয় এই বিড়ালগুলো অতীতে নাবিকরা এই শহরে নিয়ে এসেছিল।

কুচিং, মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়ার সারাওয়াক প্রদেশের কুচিং শহর। শহরটিকে বলা হয়ে থাকে বিড়ালের শহর। ধারণা করা হয়, শহরটির নাম ‘কুচিং’ শব্দটি এসেছে মালয়েশীয় শব্দ ‘কুইটিং’ থেকে, যার অর্থ ‘বিড়াল’। শহরটি এই নামে পরিচিত হয়ে উঠার একমাত্র কারণ হলো পুরো শহরটিই বিড়ালে পরিপূর্ণ। শহরের রাস্তা, ফুটপাত, বাড়ির ছাদ, ট্র্যাফিক সিগন্যাল এবং পার্কগুলোতে – যে দিকেই তাকাবেন, চোখে পড়বে শুধু বিড়াল আর বিড়াল। কিন্তু অন্য শহরগুলোর মতো এই বিড়ালগুলো জীবন্ত নয়। বিড়ালের প্রতি ভালোবাসা থেকে শহরের মানুষ সব জায়গায় তৈরি করেছে বিড়ালের ভাস্কর্য। কুচিং এর একটি কলেজের নাম আই-ক্যাটস (ইন্টারন্যাশনাল কলেজ অব অ্যাডভান্সড টেকনোলজি সারওয়াক)। একটি স্থানীয় রেডিও স্টেশন ‘ক্যাটস এফএম’ রয়েছে। বিড়াল নিয়ে কুচিংয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত স্থাপনাটি হচ্ছে ক্যাট জাদুঘর, যার মধ্যে রয়েছে চার হাজার নিদর্শন এবং বিড়ালের স্মৃতিচিহ্ন। প্রদর্শনীটিতে প্রাচীন মিশরের একটি বিড়াল এবং বোর্নেওতে প্রাপ্ত পাঁচ প্রজাতির বন্য বিড়ালও রয়েছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen + 5 =