আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে  জয়ের মরুদ্যানে টিম টাইগার্স

সালেক সুফী

বিজয়ের মাসে বিশ্বকাপে স্বপ্ন বঞ্চিত, বিপর্যস্ত বাংলাদেশের তৃপ্তির বিজয় আসলো টেস্ট ক্রিকেটে শক্তিশালী তাসমান সাগর পাড়ের দেশ নিউ জিল্যান্ডের বিরুদ্ধে। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ সিরিজের অধীন ২ টেস্ট ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচে পুণ্যভূমি সিলেটের মাঠে তাইজুল ইসলামের (৪/১০৯ এবং ৬/৭৫)  ঘূর্ণি বলের সাফল্যের কারণে ১৫০ রানের বিশাল জয় পেলো বাংলাদেশ।

প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের ৩১০ রান তাড়া করে ৩১৭ করেছিল নিউ জিল্যান্ড।  দ্বিতীয় ইনিংসে অধিনায়ক নাজমুল শান্তর মাইল ফলক শতরান (১০৫) ,মুশফিকুর রহিমের (৬৭) এবং মেহেদী মিরাজের অপরাজিত (৫০) রানের উপর ভর করে ৩৩৮ রান করে বাংলাদেশ। কিছুটা কঠিন উইকেটে ৩৩২ রান করে টেস্ট জয় করা সহজ ছিল না। তদুপুরি উইকেটের সুবিধা সঠিক ব্যবহার করে অভিজ্ঞ তাইজুল ইসলাম (৬/৭৫), নাঈম হাসান (২/৪০), মেহেদী মিরাজের নিয়ন্ত্রিত স্পিন বোলিং দিয়ে ব্ল্যাক ক্যাপসদের দ্বিতীয় ইনিংস ১৮১ রানে সীমিত রাখে। ১৫০ রানের ব্যাবধানে দাপুটে জয় পায় বাংলাদেশ।

শক্তিশালী নিউ জিল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে সাকিব, তামিম, লিটন, তাসকিন বিহীন বাংলাদেশের তরুণ দলের বিরুদ্ধে জয় বিশাল অর্জন। সহজেই অনুমেয় বিশ্বকাপ খেলা এই দলের অধিকাংশ দল বোধগম্য কারণে মানসিক চাপের মুখে স্বাভাবিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করেনি। একই সঙ্গে প্রমাণ হয়ে গেছে দেশ সেরা স্পিনার তাইজুলকে বিশ্বকাপ স্কোয়াডে না রাখা কতটা বোকামি ছিল।

কিছু কিছু মানুষ সিলেট জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের উইকেট ধীর, নিচু, ঘূর্ণি চিহ্নিত করে বাংলাদেশের অর্জনকে কটাক্ষ করার অপপ্রয়াস করছে। আমি টেস্টটির শুরু থেকে শেষ অবধি দেখেছি। উইকেট কিছুটা ধীর গতির ছিল, স্পিন বোলারদের জন্য কিছুটা সহায়তা ছিল। কিন্তু ভালো ব্যাটসম্যানদের জন্য আতঙ্কের কিছু ছিল না। দুই দলের ৫ জন খেলোয়াড় দুটি শত রান এবং ৫ টি অর্ধশত করেছে। বাংলাদেশের তাইজুল ইসলাম উইকেটের সুবিধা ভালোমত কাজে লাগিয়েছে।

প্রথম ইনিংসে ব্ল্যাক ক্যাপস অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসনের দুটি ক্যাচ ফস্কে না গেলে হয়তো চতুর্থ দিনেই বাংলাদেশ জয় পেতো।  বাংলাদেশের সামনে এখন বড় সুযোগ ঢাকার শেরে বাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ টিম টাইগার দুর্গে আরো একটি জয় অর্জন করে নিউ জিল্যান্ডকে বাংলা ওয়াশ করার।  বিশ্বকাপ বিপর্যয়ের পর বাংলাদেশ কৃতিত্বপূর্ণ জয় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সাফল্য তৃষ্ণার্থ ক্রিকেট প্রেমিকদের কাছে স্বপ্ন দেখার নতুন উপলক্ষ্য হয়েছে।

ফিরে দেখলে দেখবেন নাজমুল শান্তর অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকের ম্যাচে গোটা দলের শারীরিক ভাষা সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছে।  প্রথম ইনিংসে মাহমুদুল হাসান জয় ( ৮৬)  প্রকৃত ওপেনারের মত ধৈর্য্য এবং প্রয়োগ স্পৃহা নিয়ে অ্যাংকরের ভূমিকা পালন করেছে।  নাজমুল শান্ত (৩৭) এবং মোমিনুল হকের (৩৭) ইনিংস দুটি বড় হলে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে ম্যাচজয়ী স্কোর করতে পারতো।

বাংলাদেশের ৩১০ রানের জবাবে ব্যাটিং করতে এসে নিউ জিল্যান্ড কিন্তু আদৌ স্বস্তিতে ছিল না।  একমাত্র বর্তমান বিশ্ব ক্রিকেটে অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান কেন উইল্লিয়ামসন (১০৪) ছাড়া কিছুটা প্রতিরোধ গড়েছিল ড্যারিল মিচেল (৪১) এবং গ্লেন ফিলিপ্স (৪২)। তাইজুলের (৪/১০৯) সঙ্গী হয়ে সফল বোলিং করেছে অনিয়মিত বলার মোমিনুল (৩/৪)। এখানে অধিনায়ক নাজমুল শান্তর মুন্সিয়ানা ছিল। আগেই বলেছি উইলিয়ামসনের দুটি ক্যাচ ফস্কে না গেলে বাংলাদেশ প্রথম ইনিংসে লিড পেতো।

দ্বিতীয় ইনিংসে রান করা অপেক্ষাকৃত দুরূহ ছিল। তৃতীয় দিন চমৎকার ব্যাটিং করে বাংলাদেশ কঠিন উইকেটে। দিন শেষে রান উঠেছিল ৩ উইকেটে ২১২। জয় এবং মোমিনুল কাটা পড়েছিল রান উঠে। তৃতীয় দিনে বাংলাদেশের ব্যাটিং ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দেয়। আর এর মূলে ছিল অধিনায়ক শান্তর মাইলফলক গড়া শতরান।

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে শান্ত প্রথম নজির স্থাপন করলো অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকে শতরান  করার। পাশাপাশি দায়িত্বপূর্ণ ব্যাটিং করে বিশ্বস্থ  মুশফিকুর রহিম (৬৭) এবং চৌকষ খেলোয়াড় হিসাবে বিকশিত হতে থাকা মেহেদী মিরাজ (৫০*)। ৩৩৮ রানে শেষ হওয়া বাংলাদেশ ঘূর্ণি উইকেটে নিউ জিল্যান্ডের সামনে কঠিন ৩৩২ রানের টার্গেট তুলে ধরে।

শেষ ইনিংসে উইকেটের কিছুটা সুবিধা কাজে লাগিয়ে চেপে ধরে বাংলাদেশ বোলাররা। চতুর্থ দিন শেষে ১১৩/৭ করে ধুঁকতে থাকা নিউ জিল্যান্ড পঞ্চম দিন সকালে ১৮১ রানে গুটিয়ে যায়। তাইজুল ৭৫ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট নিয়ে টেস্টটি তাইজুলময় করে ফেলে। এই টেস্টে ১৮৪ রানের বিনিময়ে ১০ উইকেট লাভ করে তাইজুল। প্রমাণিত হয় বিশ্বকাপে তাইজুলকে কোনো ভাবেই অবজ্ঞা করা সমীচীন ছিল না।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পরাজয়ের মরুভূমিতে সিলেট টেস্ট জয় মরুদ্যান হিসাবে বিবেচিত হবে।

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty − ten =