শবনম শিউলি
গত কয়েক মাস আগেই অভিনেত্রী তাসনিয়া ফারিন ও গায়ক-অভিনেতা প্রীতম হাসানের একটি নাটক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। সবচেয়ে আলোচিত হয় সেই টেলিফিল্মের শেষ দৃশ্যটি। যেখানে প্রীতম হাসানের সঙ্গে ফারিনের শেষ দেখা। দেখা যায় তাদের নিজেদের মধ্যকার রাগ, অভিমান গলে যায় আলিঙ্গনের মধ্য দিয়ে। বোঝানো হয় একটি সম্পর্কে আলিঙ্গন কতটা জরুরি। আলিঙ্গন যে শুধু প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্কেই জরুরি এমন নয়। জরুরি যেকোনো সম্পর্কেই। হোক বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কে কিংবা ভাই-ভাই, বোন-বোন, ভাই-বোন কিংবা বন্ধুত্বেও। অনেক সময় সম্পর্কের দূরত্ব কিংবা নেগেটিভিটি এক নিমিষেই দূর করে দেয় একটি আলিঙ্গন। যেমনটা বলেছিলেন সঞ্জয় দত্ত, তার মুন্নাভাই এমবিবিএস সিনেমাটিতে। ‘জাদু কি ঝাপ্পি’ দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন স্পর্শ মানুষের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা জানি ফেব্রুয়ারি মাসের ১২ তারিখে হাগ ডে পালন করা হয়। কিন্তু আরও একটি হাগ ডে বিশ্বে পালন করা হয়। তা হলো ‘ফ্রি হাগ ডে’। আন্তর্জাতিক ফ্রি হাগ ডে প্রতি বছর জুলাই মাসের প্রথম শনিবার পালিত হয়। সে হিসেবে এই বছর ৬ জুলাই পড়ে এই দিবসটি পালনের দিন। ফ্রি হাগ ডে এমন একটি দিন যেদিন মানুষ সর্বজনীন স্থানে অপরিচিত ব্যক্তিদের আলিঙ্গন করার প্রস্তাব দেয়। তারা একে অপরকে আলিঙ্গন করে ভালো বোধ করার জন্য এমন করে থাকে। মূলত মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি বাড়াতেই এমন একটি দিবস পালন করে কোনো কোনো দেশ। সামাজিক বিচ্ছেদ এবং মানুষের যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার এই যুগে, ফ্রি হাগ এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে।
তবে হ্যাঁ, এটি শুধুই সম্প্রীতির জন্য নয়; এটি একটি আন্দোলনও বটে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় সেসব নিঃস্বার্থ কাজ যেগুলো শুধুমাত্র অন্যদের ভালো বোধ করার জন্য করা হয়। আর এজন্যই এটি চলে মাসব্যাপী। অর্থাৎ জুলাই মাসের প্রথম শনিবার শুরু হয়ে চলে ১ আগস্ট পর্যন্ত। এটি ২০০৪ সালে ‘জুয়ান ম্যান’ ছদ্মনামে পরিচিত একজন অস্ট্রেলিয়ান ব্যক্তি শুরু করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ান ব্যান্ড ‘সিক পাপিস’ এর একটি মিউজিক ভিডিওর ফলে ২০০৬ সালে এটি আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। ভিডিওটি ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ৭৮ মিলিয়ন বার দেখা হয়েছে। জুয়ান ম্যান শুধু শুধুই এমন উদ্যোগ নেননি। জুনের বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই তিনি ব্যক্তিগত নানা সমস্যার ফলে হতাশ এবং একাকী বোধ করছিলেন। নিজেকে জীবনমুখী ও উৎফুল্ল করে তুলতেই জুয়ান ২০০৪ সালের ৩০ জুন ফ্রি হাগ প্রচার শুরু করেছিলেন। তিনি সেন্ট্রাল সিডনির পিট স্ট্রিট মলে আলিঙ্গন শুরু করেছিলেন। তবে এক পর্যায়ে এর জন্য তাকে জরিমানাও গুনতে হয়। কিন্তু ২০০৬ সালের দিকে এই ফ্রি হাগ ব্যাপারটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে একজন কলেজ ছাত্র, ইউ জু-ওয়েই তাইপেইতে ‘তাইওয়ানের সবাইকে আলিঙ্গন’ করার প্রচার শুরু করেন।
২০০৬ সালের অক্টোবরে ইসরায়েলের তেল আবিবে আলিঙ্গন অভিযান শুরু হয়। ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে ইতালির বেশ কয়েকটি শহরে কয়েকটি ফ্রি আলিঙ্গন প্রচার শুরু হয়েছিল। ২০০৭ সালের ১৪ এপ্রিল ইংল্যান্ডের নিউক্যাসল আপন-টাইনে বসবাসকারী পর্তুগিজ ওয়েট্রেস সারা ভিয়েরা নিউক্যাসল সিটি সেন্টারের রাস্তায় আলিঙ্গন করেছিলেন, যা বিবিসি নিউজ এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে আরব দেশ জর্ডানের রেডিও স্টেশন প্রথম ফ্রি আলিঙ্গন ভিডিও তৈরি করে আন্তর্জাতিক ফ্রি আলিঙ্গন দিবস উদযাপন করে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আলিঙ্গন আহ্বান টরন্টোর ক্রেতাদের চমকে দিয়েছিল। ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে পোলিশ ভ্রমণকারী ম্যাকসিম স্কোরুবস্কি ‘৮০ দিনে বিশ্বজুড়ে আলিঙ্গন’ কার্যক্রম শুরু করেন। এই ভ্রমণকালীন সময়ে তিনি বিশ্বের ১৯টি দেশে ৬,৭৮৩ জনকে আলিঙ্গন করেছিলেন। তার সফরকে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ট্রাভেলার ২০১২ সালের সেরা ভ্রমণ হিসেবে মনোনীত করে। এমন অনেক খণ্ড খণ্ড ঘটনা ধীরে ধীরে আলিঙ্গন ব্যাপারটা মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে। সামাজিক বিচ্ছেদ এবং মানুষের যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তার এই যুগে ফ্রি আলিঙ্গনের প্রভাব উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে। কিন্তু সামাজিক বিশ্বাসের এই প্রতীক বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ায় কর্তৃপক্ষ ফ্রি আলিঙ্গন নিষিদ্ধের নির্দেশ দেয়।
মৌখিকভাবে বা মুখের অভিব্যক্তির মাধ্যমে বেশিরভাগ মানুষের যোগাযোগ তৈরি হয়। কিন্তু স্পর্শ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়, যার মাধ্যমে একে অপরের মধ্যে বার্তার আদান-প্রদান ঘটে। অপরের সংস্পর্শে এলে মানুষের আবেগের প্রকাশ ঘটে। সেটা রাগ, ভয়, ঘৃণা, ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, সুখ, দুঃখ কিংবা সহানুভূতি হতে পারে। আলিঙ্গন হচ্ছে আরামদায়ক ও যোগাযোগমূলক একটি ধরন। মার্কিন ফ্যামিলি থেরাপিস্ট ভার্জিনিয়া স্যাটিয়ার বলেন, ‘বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রতিদিন অন্তত ৪ বার আলিঙ্গন করা দরকার। মেইটেন্যান্স থেরাপির জন্য দিনে আলিঙ্গন দরকার ৮ বার। আর উন্নতির জন্য প্রতিদিন দরকার ১২ বার।’
আলিঙ্গনের ফলে মানসিক চাপ কমে যায়। যার প্রভাব আমাদের দৈনন্দিন সুস্থতার ক্ষেত্রেও পড়ে। আলিঙ্গন হৃৎপিণ্ড ভালো রাখার দারুণ একটি উপায়। আমেরিকান ইনডিপেনডেন্ট একাডেমিক পাবলিশিং কোম্পানি প্রকাশিত সেজ জার্নালস চার শতাধিক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ওপর একটি গবেষণা করে। গবেষকেরা সেখানে দেখেন, আলিঙ্গন কোনো ব্যক্তির অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস করতে পারে। এ সময় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা বেশি আলিঙ্গন পেয়েছেন, তাদের অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা কম ছিল। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন আরেকটি গবেষণায় ২০০ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে দুটি দলে ভাগ করে। সেখানে প্রথম দলে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল। তারা ১০ মিনিট একে অপরের হাত ধরেছিলেন এবং ২০ সেকেন্ড করে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন। অন্য গ্রুপে যারা ছিলেন তাদের মধ্যেও রোমান্টিক সম্পর্ক ছিল, কিন্তু তারা ১০ মিনিট ২০ সেকেন্ড পাশাপাশি চুপচাপ বসেছিলেন। দেখা যায়, দ্বিতীয় দলের চেয়ে প্রথম দলের সঙ্গীদের রক্তচাপের মাত্রা ও হার্ট রেট বেশ ভালো অবস্থায় আছে। গবেষণা অনুসারে বলা যেতে পারে, একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
আলিঙ্গন যে মানুষকে শুধুমাত্র বাহ্যিকভাবে সুখি করে এমন নয়। আমাদের শরীরে অক্সিটোসিন নামে একটি হরমোন কাজ করে। বিজ্ঞানীরা যাকে আলিঙ্গন হরমোন বলেও উল্লেখ করেন। আমরা যখন অন্য কাউকে আলিঙ্গন করি, স্পর্শ করি বা কাছাকাছি বসি, তখন এর নির্গমনের মাত্রা বেড়ে যায়। সুখানুভূতি তৈরি এবং চাপ কমিয়ে রাখার ক্ষেত্রে অক্সিটোসিন সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মজার বিষয় হলো এই হরমোন নারীদের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে। রক্তচাপ ও নোরাপিনেফ্রিন নামে স্ট্রেস হরমোনকে নিয়ন্ত্রণে রাখে অক্সিটোসিন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটস অব হেলথ তাদের গবেষণায় দেখেছে, যেসব নারীর সঙ্গে তাদের সঙ্গীর সুন্দর সম্পর্ক বিরাজ করছে এবং তারা যখন ঘন ঘন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন তখন সেসব নারীর মধ্যে অক্সিটোসিন ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করে। শিশুদের ঘনিষ্ঠভাবে বুকে জড়িয়ে ধরার ক্ষেত্রেও নারীরা অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাব উপলব্ধি করতে পারেন। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভয় কাজ করে, কোনো জড় বস্তুকে ছুঁয়ে দিলে, সেটা টেডি বিয়ারও হতে পারে, তা দূর হয়ে যায়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস