আপনার সন্তানের হাতে বই তুলে দিন

প্রভাষ আমিন

এখন মানুষের বিনোদনের অনেক ক্ষেত্র। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, গুগল – চারদিকে শত প্রলোভন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আপনি সারাবিশ্বের বন্ধুদের সাথে সংযুক্ত থাকতে পারবেন। ইউটিউবে যা কন্টেন্ট আছে, একজন মানুষ এক জীবনে তার কানকড়িও দেখে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু বই পড়ার যে আনন্দ, তার তুল্য কিছুই নেই। এখন স্মার্ট ডিভাইস আমাদের দিনের অনেকটা সময় কেড়ে নেয়। বই পড়ার সময় তাই কমে আসছে। এখন জরুরি নন ফিকশন ছাড়া খুব বেশি বই পড়া হয় না বটে। তবে ছেলেবেলায় বই পড়ার যে আনন্দের স্মৃতি, তার সমান্তরাল কোনো আনন্দের উৎস পাইনি এখনও। ছেলেবেলায় পড়া রূপকথার গল্প আমাদের চারপাশে অন্যরকম এক আনন্দময় জগত তৈরি করতো। এই যে এত বছর পর সেই স্মৃতির কথা লিখছি, তাতেও কিন্তু আনন্দটা একটু একটু টের পাচ্ছি। তবে সে আনন্দটা খুব সহজে মিলতো না। পাঠ্যবইয়ের বাইরের বইকে অভিভাবকরা বলতেন ‘আউটবই’। আর পাঠ্যবই ফেলে আউটবই পড়তে দেখলেই মার খেতে হতো। কিন্তু আমরা পাঠ্যবইয়ের নিচে লুকিয়ে মাসুদ রানা পড়েছি রাত জেগে। পরীক্ষার পড়া পড়তে গেলে ঘুমে চোখ বুজে আসতো। কিন্তু আউটবই পড়তে গেলে ঘুম পালাতো। এমনকি স্কুলে ক্লাশে বসেও আউটবই পড়েছি। তবে স্বীকার করছি পাঠ্যবই পড়ে পরীক্ষায় যত নাম্বার পেয়েছি, আইটবই পড়ে জীবনের পরীক্ষায় তারচেয়ে বেশি নাম্বার পেয়েছি।

বই আসলে আমাদের জানার, বোঝার, উপলব্ধি করার একের পর এক দরজা খুলে দেয়। একেকটি বই একেকটি জগৎ তৈরি করে। অনেক কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে অনেক সিনেমা বানানো হয়েছে। কিন্তু সেই বইটি পড়ার সময় প্রতিটি মানুষ তার মতো করে কল্পনায় আলাদা আলাদা সিনেমা বানায়। একটা বড় মহৎ উপন্যাস পড়তে অনেক সময় ১০/১৫ দিনও লেগে যায়। এই সময়টা পাঠক ঘোরের জগতে চলে যান। উপন্যাসের চরিত্রগুলো চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। আমরা মিশে যাই উপন্যাসের সাথে। বই আসলে মানুষকে সৃজনশীল করে, তার কল্পনাশক্তি বাড়ায়। বিজ্ঞান যত আবিস্কারই করুক, মানুষের চেয়ে বড় কোনো আবিষ্কার নেই। রোবট, এআই অনেককিছু এসেছে। কিন্তু কল্পনাশক্তিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি কেউই। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বিপুল সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে চাই বই।

বই সব মানুষের জন্যই দরকার। তবে শিশুদের জন্য দরকার সবচেয়ে বেশি। কারণ শিশুদের কল্পনার জগতটা আরো অনেক বড় এবং বর্ণময়। সবকিছুতে বিস্মিত হওয়ার, আনন্দ পাওয়ার বিরল এক গুণ আছে প্রতিটি শিশুর। বড় হতে হতে বিস্মিত হওয়ার, আনন্দিত হওয়ার ক্ষমতা কমে আসে। ছেলেবেলায় একটা রূপকথা যত বিস্ময়কর মনে হয়, বড় হলে সেটা বিশ্বাসই হতে চায় না। ছেলেবেলায় যে বই পড়ে কেঁদে বুক ভাসাই, বড় হলে সেটাই হাস্যকর লাগে।

তাই শিশুদের বই পড়ার আনন্দের জগতটা চিনিয়ে দিতে পারলেই তার গোটা জীবনটা আননন্দময় হয়ে যায়। কিন্তু সময়টা বদলে গেছে। এখন শিশুদের জগতকে আমরা বই, পরীক্ষা, কোচিংয়ের এমন ভীতিকর রুটিনে ঠেসে দিয়েছি, তার দম ফেলার সময় নেই, বই পড়বে কখন। যেটুকু সময় থাকে, সেটুকু শিশু বুঁদ হয়ে মোবাইলে না হয় কম্পিউটারে। একটা সময় ছিল টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন না দেখলে অনেক শিশু খেতে চাইতো না। এখন অনেক শিশু স্মার্ট ডিভাইস না পেলে খেতে চায় না। এটা শিশুদের দোষ নয়। তারা জন্মের সময় তো টিভি বা স্মার্ট ডিভাইস চেনেনি। আমরাই তাদের চিনিয়েছি। নিজেদের কাজটা সহজ করার জন্য তাকে ডিভাইস নির্ভর করে তুলেছি। নিজেরা মোবাইলে ব্যস্ত থাকি, সন্তানকে দেওয়ার মতো সময় নেই। ডিভাইসে অভ্যস্ত করার পরে আমরা শিশুকে দোষ দেই। কিন্তু এখানে শিশুদের কোনো দোষ নেই। আমরা যদি তাদের হাতে টিভি বা মোবাইল না দিয়ে বই তুলে দিতাম, তাহলে তো তারা বইয়েই অভ্যস্ত হতো। আমার কাজিন খুব পড়ুয়া। ছেলেবেলায় দেখতাম সে মুখ গুঁজে বই পড়ছে আর তার মা তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। সেই অসাধারণ দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। সবাই সমান পড়ুয়া হবে না। কেউ কম পড়বে, কেউ বেশি পড়বে। কারো আগ্রহ হবে ফিকশনে, কারো নন ফিকশনে। আমাদের কাজ শুধু শিশুকে বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা।

‘বিশ্ব শিশু বই দিবস’ ও হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন

রূপকথার জাদুকর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ১৮০৫ সালের ২ এপ্রিল ডেনমার্কের ওডেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বিশ্বের কোটি কোটি শিশুর কল্পনার জগতকে অন্যরকম করে দিয়েছে তার লেখা কুৎসিত হাঁসের ছানা, ছোট্ট মৎস্যকন্যা, তুষার রানী, সম্রাটের নতুন জামাসহ অসংখ্য গল্প। তিনি শিশুদের জন্য লিখে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেন, শিশুদের উৎসাহিত করেন। হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন অপূর্ব কল্পনা ও স্বপ্নের মিশেলে তৈরি করেছিলেন শিশুদের নিজের জগত, যেভাবে সৃজনে ও মননে শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের প্রচেষ্টা ছিল। তার রচিত রূপকথা ও শিশুসাহিত্য এখনো বিশ্বব্যাপী শিশু-কিশোরদের আনন্দ দেয়। শিশুদের চিন্তার পরিধি আর নৈতিকতার প্রসারে হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের রচনাবলী ধ্রুপদের মর্যাদা পেয়েছে আর তার জন্মদিনটি পালিত হয় বিশ্ব শিশু বই দিবস হিসেবে। সুইজারল্যান্ডে অবস্থিত বিশ্ব শিশু-কিশোর পুস্তক বোর্ড প্রতিবছর দিবসটি পালন করে। দিবসটি উপলক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। বিভিন্ন দেশের নামকরা লেখক ও প্রকাশকরা যেন শিশু-কিশোরদের জন্য ভালো ভালো বই লেখেন, প্রকাশ করেন, শিশু-কিশোররা যেন বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, বই পড়তে উৎসাহিত হয়, সে জন্যই দিবসটি পালন করা হয়।

স্মার্ট ডিভাইসের এই সময়ে বিশ্ব শিশু বই দিবসের গুরুত্ব আরো অনেক বেশি। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আমরা যদি একটি মানবিক, আলোকিত সমাজ গড়তে চাই, তাহলে শিশুদের বইমুখী করার চেয়ে সহজ আর কোনো উপায় নেই। আসুন আমরা শিশুদের স্মার্ট ডিভাইস না চিনিয়ে বই চেনাই, ফেসবুক না পড়িয়ে বুক পড়াই। ছোট্ট মনে জেগে উঠুক জানার দুর্নিবার ইচ্ছা।

প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 1 =