ময়ূরাক্ষী সেন
শীত পড়ার সাথে সাথে জ্বর ঠান্ডা কাশি সাধারণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সিজনাল ঠান্ডা কাশি খুব গুরুতর না হলেও এটি কষ্টদায়ক। প্রাত্যহিক কাজে এটি ব্যাঘাত ঘটায়। শীতের সময় সাধারণত জলীয় বাষ্প কমে আসে। ফলে ধুলাবালির পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে শীত পড়তে না পরতেই দেখা দেয় শুষ্ক কাশির মতো সমস্যা। যা সহজে ভালো হতে চায় না। এছাড়া নিউমোনিয়া, হাঁপানি ও এলার্জির মতো সমস্যাও শীতের সময় বেড়ে যায়। শীতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় বয়স্ক ও শিশুদের। যেকোনো রোগে আক্রান্ত হলে বয়স্কদের ভোগান্তিতে পড়ার কারণ হচ্ছে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। সিজনাল অসুস্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য জীবনযাত্রায় কিছুটা পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
টনসিলে সমস্যা
আমাদের গলার দুইপাশের দুটি গ্রন্থিকে টনসিল বলা হয়। এই গ্রন্থি আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেমের অংশ। বছরের যেকোনো সময় টনসিলের প্রদাহ দেখা দিতে পারে। যাদের টনসিলের প্রদাহ সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বার বার এই সমস্যা হয়ে থাকে। তবে আবহাওয়া বদলের সময় সবচেয়ে বেশি টনসিলের সমস্যা দেখা দেয়। ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের ফলে টনসিলে সমস্যা দেখা দেয়। শীতের দিনে মৌসুমি ফ্লু হওয়ায় টনসিলাইটিসের প্রকোপ বাড়ে। টনসিলে সমস্যা দেখা দিলে সাধারণত মাঝারি থেকে তীব্র জ্বর, গলাব্যথা, খাবার গিলতে কষ্ট, মুখে দুর্গন্ধ, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকতে পারে। টনসিলে সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে সমস্যা হলে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন। অনেকে মনে করেন টনসিলে সমস্যা হলে অপারেশন করতেই হবে, কিন্তু তা নয়। কিছু ক্ষেত্রে টনসিলে বার বার ইনফেকশন হতে থাকে, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয় ও বছরে পাঁচ থেকে সাত বার ইনফেকশন দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে টনসিল অপারেশন করে ফেলে দিতে হয়। রোগীর অবস্থা বুঝে চিকিৎসক পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সঠিক সময় টনসিলের চিকিৎসা না করালে বড় ধরনের জটিলতা হতে পারে।
হাঁপানি বা অ্যাজমা
দীর্ঘদিন ধরে শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ এবং সংবেদনশীলতায় স্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, যাকে বলে হাঁপানি বা অ্যাজমা। চিকিৎসকগণ হাঁপানির সঠিক কারণ না জানলেও বলা হয়ে থাকে হাঁপানি একটি বংশগত রোগ। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি মানুষ হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। যার মধ্যে বেশি রয়েছে শিশুরা। হাঁপানি রোগ হলে শ্বাসকষ্টের সাথে শুকনা কাশি থাকে, হঠাৎ দমবন্ধ ভাব অনুভব হয়ে থাকে। আবহাওয়া বদলের সময় হাঁপানির টান উঠার প্রবণতা বেড়ে যায়। এছাড়া বছরের যেকোনো সময়ই হাঁপানির সমস্যা দেখা দিতে পাের। তবে বসন্তের শুরুতে হাঁপানি রোগীদের বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা জরুরি। অনেকের এলার্জির কারণে হাঁপানি হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে চিকিৎসক স্কিন প্রিক টেস্ট দিয়ে থাকেন। এছাড়া বুক এক্স-রে করে দেখা হয় অন্য কোনো কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কি না। হাঁপানি থেকে দূরে থাকতে হলে এলার্জিজনিত সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। টেস্টের মাধ্যমে জেনে নিতে হবে রোগীর কিসে এলার্জি এবং তা থেকে দূরে থাকতে হবে। হাঁপানি রোগীদের ঘর থেকে বের হওয়ার আগে মাস্ক পরিধান করতে হবে। ঘরে কার্পেট রাখা যাবে না। এমনকি ফুলের রেণু থেকেও হাঁপানির টান উঠতে পারে। কোনো বিষয়ে অতিরিক্ত চিন্তা বা মানসিক অশান্তির মধ্যে থাকলে অনেক সময় হাঁপানির সমস্যা বেড়ে যায়। তাই মনকে যতটা সম্ভব শান্ত রাখতে হবে। হাঁপানি কখনো পুরোপুরি ভালো হয়ে যায় না, তবে জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করে ও কিছু ঔষধপত্রের মাধ্যমে হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব। হাঁপানি সমস্যা ধরা পড়ার পর চিকিৎসক কিছু ঔষধ দিয়ে থাকেন, অনেকেই সেই ঔষধ খাওয়া নিয়ে অবহেলা করেন এবং ভোগান্তিতে পড়েন। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া হাঁপানির ঔষধ বন্ধ করা যাবে না। ঔষধ খাবার পরেও হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে না এলে চিকিৎসককের শরণাপন্ন হতে হবে।
নিউমোনিয়া
নিউমোনিয়া হলে ফুসফুস ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফুসফুসের ভিতরে বাতাসের থলিগুলো ফুলে যায়। তখন রোগীর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। নিউমোনিয়া হলে সাধারণ লক্ষণ হিসেবে জ্বর আসে ও কফযুক্ত কাশি হয়। এছাড়া শ্বাসকষ্ট হয়ে থাকে। আরো দেখা যায় বমি বমি ভাব, খাবারের প্রতি অনীহা, মাথাব্যথা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি। নিউমোনিয়াকে অবহেলা করলে অনেক সময় এটি তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। অনেক সময় নিউমোনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলে সাধারণ ঠান্ডা কাশি মনে করে অনেকে এড়িয়ে চলেন। কিন্তু শীতকালিন আবহাওয়ায় ঠান্ডা কাশির মতো লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করে নিতে হবে নিউমোনিয়া হয়েছে কি না। সঠিক সময় চিকিৎসা শুরু হলে নিউমোনিয়া গুরুতর আকার ধারণ করতে পারবে না। এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও কিছু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিউমোনিয়া শনাক্ত করা হয়। নিউমোনিয়াতে বয়স্ক কিংবা শিশুরা আক্রান্ত হলে তা জটিল আকার ধারণ করার সম্ভাবনা থাকে। তাই আবহাওয়া বদলের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে ঠান্ডা লেগে না যায়। আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংকসসহ ঠান্ডা জাতীয় সব খাবার থেকে এ সময় দূরে থাকতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি কাশি
শীতের শেষের দিকে অনেকের দীর্ঘমেয়াদে কাশি দেখা দেয় যা সহজে সারতে চায় না। তা শুকনা হতে পারে আবার কফযুক্ত কাশিও হতে পারে। শুকনা কাশি সাধারণত ভাইরাস সংক্রমণের ফলে হয়ে থাকে। ফলে সিরাপ বা অ্যান্টিবায়োটিকে কাশি ভালো হতে চায় না। আবহাওয়াতে জলীয় বাষ্প কমে যাবার কারণে সাধারণত এই কাশি দেখা যায়। কাশির সাথে সর্দি এবং হালকা দুর্বলতা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপায়ে কাশি কমানোর চেষ্টা করতে হবে। যেমন তুলসী পাতার রস, মধু, আদা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে। গরম পানির সাথে আদা কিংবা লেবু মিশিয়ে খেলে আরাম পাওয়া যাবে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় এমন কাশি যন্ত্রণাদায়ক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর কিছু হয় না। রাতে এ কাশি অনেক সময় বেড়ে যায় তাই ঘুমানোর সময় উঁচু বালিশে ঘুমাতে হবে। তবে কাশির সাথে যদি রক্ত বের হয়, শ্বাসকষ্ট থাকে ও তীব্র জ্বর থাকে তাহলে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক নয়
দেশের ফার্মেসিগুলোতে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে পাওয়া যায়। ফলে সামান্য ঠান্ডা কাশিতেই অনেকে ফার্মেসিতে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে নিয়ে আসেন। এতে হয়তো দ্রুত ঠান্ডা কাশি ভালো হয়ে যায়, কিন্তু শরীরে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করলে আমাদের শরীর অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে কাজ করা শিখে যায়। ফলে যে কোনো গুরুতর ইনফেকশনে অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে কাজ করতে চায় না। যাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। সামান্য ঠান্ডা কাশিতে ঔষধের উপর নির্ভরশীল না হয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হবে। সাধারণত ভাইরাসজনিত যেকোনো ঠান্ডা কাশি দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে ওষুধ ছাড়াই ভালো হয়ে যায়। তাই আবহাওয়া পরিবর্তনের সময় অসুস্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ঔষধ গ্রহণ করা যাবে না।
বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন
শীতের শেষের দিকে যেহেতু রোগের প্রকোপ বেড়ে যায় তাই সকলকে কিছুটা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন হবে। যেমন ঘর থেকে বের হলে মাস্ক পরা, ধুলাবালির মধ্যে না যাওয়া ও পর্যাপ্ত পরিমাণ গরম কাপড় পরা। গোসলের সময় গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসকেরা পরামর্শ দেন এ সময় বেশি করে ভিটামিন সি যুক্ত খাবার গ্রহণ করা। ভিটামিন সি ঠান্ডা কাশির মতো ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শরীরকে সাহায্য করে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা