আবারও বিশ্বমঞ্চে সুন্দরী জেসিয়া

মডেলিং জগতের এক অনন্য নাম জেসিয়া। ২০১৭ সালে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন আলোচিত মডেল ও অভিনেত্রী জেসিয়া ইসলাম। তারপরই বিনোদন অঙ্গনে পা রাখেন তিনি। এরপর নানা ঘটনা, দুর্ঘটনা দিয়ে আলোচনায় ছিলেন এই মডেল। বেশ কয়েকটি নাটক ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছিলেন তিনি। শোনা যাচ্ছে সামনে অনন্য মামুন পরিচালিত শাকিব খান অভিনীত ‘দরদ’ সিনেমাতে অতিথি চরিত্রে দেখা মিলবে জেসিয়ার। সম্প্রতি বিশ্বসেরা একটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে আলোচনায় এসেছেন জেসিয়া। সেসব নিয়েই মাধবী লতার প্রতিবেদন।

ঢাকার মেয়ে

জেসিয়া ইসলাম ১৯৯৭ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। পুরান ঢাকার মেয়ে জেসিয়া। এই সুন্দরীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানেই। ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম ও গৃহিণী রাজিয়া সুলতানার একমাত্র সন্তান তিনি। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির এই মডেল স্বপ্ন দেখেন একজন ভালো মডেল ও অভিনেত্রী হওয়ার। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করেছেন জেসিয়া। সাউথপয়েন্ট একাডেমি থেকে ও-লেভেল সম্পন্ন করেন। পরে রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন।

পথচলা শুরু

জেসিয়ার পরিচিতি তৈরি হয় ২০১৭ সালের মিস বাংলাদেশ সুন্দরি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। ওই প্রতিযোগিতায় সেরার মুকুট পরে চীনের সানাইয়া শহরে অনুষ্ঠেয় ৬৭তম মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের হয়ে অংশগ্রহণ করেন তিনি। নাচ, গান কিংবা অভিনয়ে হাতেকলমে কোনো শিক্ষা নেই জেসিয়ার। যা কিছু শিখেছেন ওই সুন্দরী প্রতিযোগিতার প্লাটফর্মেই, বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রুমিংয়ের মাধ্যমে। তবে মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পূর্বে ফ্যাশন হাউজ এক্সটেসির মডেল হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

যেভাবে মিস বাংলাদেশ খেতাব

২০১৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বরে ঢাকায় আয়োজিত ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ ২০১৭‘ এর চূড়ান্ত পর্বে বিজয়ী হিসেবে জান্নাতুল নাঈমের নাম ঘোষণা করা হয়। ঘোষণার পর থেকেই শুরু হয় বিতর্কের। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমে চলে নানা জল্পনা-কল্পনা। চূড়ান্ত রায়ের পর জানা যায় জান্নাতুল নাঈম বিবাহিত। ২০১৩ সালে ২১ মার্চ বিয়ে করেন তিনি। আড়াই মাস সংসারের পর তার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়। প্রতিযোগিতার নিয়মে রয়েছে, বিবাহিত কেউ মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। ফলে ঘোষিত বিজয়ীকে নিয়ে বিতর্ক ছড়ায়। পরবর্তীতে প্রতিযোগিতার পাঁচ দিন পর, প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয়-স্থান অধিকার করা জেসিয়া ইসলামকে ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায়, তিনি ষষ্ঠ গ্রুপে হেড টু হেড চ্যালেঞ্জ পর্বে বিজয়ী হন ও শীর্ষ ৪০-এ জায়গা অর্জন করেন।

মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিযোগিতা

সাত বছর পর বিশ্বমঞ্চে আরও একবার বাংলাদেশের নাম তুলে ধরলেন জেসিয়া। এবারের মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ২০২৪ এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন জেসিয়া ইসলাম। প্রতিযোগিতার অংশ হিসেবেই বিভিন্ন লুকে মঞ্চ মাতিয়েছেন জেসিয়া। কখনো খোলামেলা পোশাকে উত্তাপ ছড়িয়েছেন। আবার কখনও পোশাকের মাধ্যমে প্রতিবাদের বার্তা দিয়েছেন। মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে গত ১ অক্টোবর কম্বোডিয়ায় যান জেসিয়া। এটি ছিল তার তৃতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। এর আগে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভিয়েতনামে ‘মিস চার্ম’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। গণমাধ্যমে এক সাক্ষাৎকারে জেসিয়া বলেন, ‘এ ধরনের আয়োজনে অংশ নেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্যে হলো, আমার বাংলাদেশকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা। আমার অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নামটাই উচ্চারিত হয়। সবাই যেন বাংলাদেশকে মনে রাখে, এটাই স্বপ্ন। সুন্দরি প্রতিযোগিতা ভালো লাগার আরেকটা কারণ হচ্ছে, এখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগী ও ভিন্ন রকম সংস্কৃতির একটা মিলনমেলা হয়। বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। নিজেদের সেরা প্রমাণের একটা চেষ্টা থাকে। এ রকম পরিবেশ আমি অন্য কোথাও দেখিনি। এটা মানুষ হিসেবে আমাকে অনুপ্রাণিত করে।’

সুইম স্যুট বিতর্ক

মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার পর কিছু ছবি পোস্ট করে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন জেসিয়া। ১৪ অক্টোবর মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ২০২৪ প্রতিযোগিতার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশ হয় জেসিয়াসহ বিশ্বের ৭০ জন প্রতিযোগীর সুইম স্যুট পরা ছবি। যেখান থেকে সেরা ২০ জনকে বাছাই করা হয় দর্শক ভোটে। ভোট চান জেসিয়া নিজেও, তার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে। মূলত এরপর থেকেই তার ও পোশাকের সমালোচনা শুরু হয়। অবশ্য তার পক্ষেও অনেকে দাঁড়ায়। এমনকি পিয়া জান্নাতুলসহ অনেক তারকাও জেসিয়ার এই সাহসী অংশগ্রহণে পাশে দাঁড়ান, ভোট চান জেসিয়ার জন্য। প্রতিযোগিতার নিয়ম অনুযায়ী মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল-এর ভেরিফায়েড পেজে ফলো বাটনে ক্লিক করে তারপর জেসিয়া বা অন্য যেকোনো প্রতিযোগীর ছবিতে লাইক বা শেয়ার করার নিয়ম ছিল। লাইক করলে ১০ পয়েন্ট এবং ছবিটি শেয়ার করলে ৫ পয়েন্ট যুক্ত হবে বলে জানায় জেসিয়া। তিনি সবার কাছে ভোট চেয়ে বলেন, ‘আমি সবার কাছে ভোট চাইছি। সবার সহযোগিতায় আমি চ্যাম্পিয়ন হতে পারি।’ এদিকে সুইমস্যুটে জেসিয়াকে দেখে যে বিরূপ মন্তব্য ছড়িয়েছে অন্তর্জালে, সে বিষয়েও কথা বলেছেন জেসিয়া। তিনি সবার মন্তব্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বলেন, ‘আমার সাম্প্রতিক ছবিতে আপনারা যে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনালে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারা আমার জন্য গর্বের বিষয়, যেখানে পাকিস্তান, মিসর, ভারত এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশের অসাধারণ নারীদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাচ্ছি।’ সুইম স্যুট প্রসঙ্গে জেসিয়া বলেন, ‘সুইম স্যুট রাউন্ড আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার একটি অংশ, যেখানে সব প্রতিযোগীই অংশ নেন। এটি কারও মূল্যবোধে আঘাত দেওয়ার জন্য নয়, বরং প্রতিযোগীদের আত্মবিশ্বাস, ফিটনেসের প্রতি নিষ্ঠা এবং ব্যক্তিত্ব তুলে ধরার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়। এটি বহুদিনের একটি ঐতিহ্য, যা বৈশ্বিক পেজেন্ট্রির মানকে ধারণ করে এবং বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে ঐক্য, বৈচিত্র্য এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা প্রচার করে। তবু সবার মতামতের প্রতি সম্মান জানিয়ে জেসিয়া বলেন, ‘আমি সব ধরনের মতামতকে সম্মান করি এবং আপনাদের গঠনমূলক প্রতিক্রিয়ার জন্য কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে আমাদের মূল্যবোধকে তুলে ধরা আমার লক্ষ্য, একই সঙ্গে এই অসাধারণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সারা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। এই যাত্রায় আমার পাশে থাকার জন্য এবং আপনাদের অব্যাহত সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ!’

পোশাকে ছাত্র আন্দোলন

মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিশ্বের ৭০ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে সেরা হওয়ার লড়াইয়ে টিকেছিলেন তিনি। দেশে গত জুলাই ও আগস্টের ছাত্রদের আন্দোলনে ব্যবহৃত একগুচ্ছ শব্দে তৈরি পোশাকে থাইল্যান্ডের ফ্যাশন মঞ্চে দেখা গেছে এই মডেলকে। মূলত  আন্দোলনের সময় ফেসবুকে হ্যাশট্যাগ দিয়ে ব্যবহার করা শব্দগুলো নিজের গাউনে তুলে ধরেছিলেন জেসিয়া। সোনালি রঙের সিøট ককটেইল শাড়িতে ‘সোনার বাংলা’কে বিষয়বস্তু করে তৈরি করা হয়েছে জেসিয়ার এই পোশাক। পোশাকের টেল গাউনে কালো রঙে লেখা ছিল ‘কোটা আন্দোলন’, ‘মুক্তি’, ‘ছাত্র জনতা’, ‘মুক্তবাংলা’, ‘শান্তি’, ‘সেইভ বাংলাদেশি স্টুডেন্ট‘, ‘কোটা বাতিল’, ‘সমান অধিকার’, ‘বিচার চাই’। ইনস্টাগ্রামে ওই পোশাকে নিজের ছবি শেয়ার করে জেসিয়া লিখেছেন, ‘সোনার বাংলাদেশ, যে হ্যাশট্যাগগুলো আমরা ব্যবহার করেছিলাম সেগুলো আমরা ভুলবো না।’

মিস গ্র্যান্ড ২০২৪

২০২৪ সালের ২৫ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হয় মিস গ্র্যান্ড ২০২৪-এর প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। সেখান থেকে নির্বাচিত হন সেরা ১০ জন। প্রতিযোগিতাটিতে চারটি বিষয় লক্ষ রাখা হয়। সেটি হলো বডি, বিউটি, ব্রেন ও বিজনেস। এবারের মিস গ্র্যান্ড ২০২৪-এর গ্র্যান্ড ফিনালেতে বিজয়ী হয়েছেন ভারতের মডেল র‌্যাচেল রুপ্তা। প্রথম রানার আপ হন ফিলিপাইনের ক্রিস্টিন ওপিয়াজা, দ্বিতীয় রানার আপ মিয়ানমারের থে সু নি এবং তৃতীয় রানার আপ ফ্রান্সের সেফিতু কেবিনগিলি। জেসিয়া ছিলেন সেরা ২০ জনের তালিকাতে।

স্বপ্ন

ভালো চলচ্চিত্রে অভিনয় করার স্বপ্ন দেখেন জেসিয়া। এ বিষয়ে জেসিয়া ইসলামের ভাষ্য, ‘ভালো অভিনয়ের জন্য ভালো পরিচালক লাগে। লাগে ভালো টিম, ভালো লেখকও। তারপর ভালো প্রোডাকশন টিম নিয়ে একটা ভালো কনটেন্ট তৈরি হয়। আমি যখন থেকে কাজ করছি, তখন বাংলাদেশে ভালো মুভি অনেক কম তৈরি হয়েছে। ইদানিং আবার ভালো ছবি হচ্ছে যেমন ‘হাওয়া’, ‘পরাণ’, ‘তুফান’। অনেক ছবির ভিড়ে এসব হচ্ছে। এসব ছবি দেশের পাশাপাশি দেশের বাইরেও দারুণ সাড়া ফেলছে। ভালো পরিচালক কেউ যদি বলেন অডিশন দিতে, আমি কিন্তু মোটেও মাইন্ড করব না। আমি অডিশন দিয়ে হলেও ভালো প্রোডাকশনে কাজ করতে চাই। আমি প্রচণ্ড পরিশ্রমী মেয়ে, সব রকম চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে রাজি আছি। আমার কাছে অভিনয়টা প্যাশন। ক্যামেরার সামনে থাকাটাও আমার প্যাশন। আমি যদি তেমন কোনো সুযোগ পাই, তাহলে কাজে লাগানোর চেষ্টা করব। সে ইচ্ছার কারণেই মাঝখানে অভিনয় কর্মশালাও করেছি। একটি সুযোগও যদি পাই, তাহলে নিজেরা সেরা পারফরম্যান্স দেখাতে পারব। আমার শুধু একটাই চাওয়া, একটা ভালো টিম লাগবে, একজন গুণী পরিচালক লাগবে।’

সামাজিক কাজে

নানা রকম সামাজিক কাজের সঙ্গেও নিজে সম্পৃক্ত রাখেন জেসিয়া। মাঝখানে বরিশালের জেলেপল্লি ও যৌনপল্লিতে গিয়ে ওখানকার নারীদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন এই মডেল। তাদেরকে জানার চেষ্টা করেছেন তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেছেন। এখনো নিয়মিত নানা ধরনের সামাজিক কাজের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করেন।

শেষ কথা

সেই ২০১৭ সাল থেকে নানা ঝক্কি-ঝামেলা পার করে নিজের স্বপ্নের পথে হেঁটে চলেছেন জেসিয়া। তার যাত্রা শুভ হোক। আগামীতে আরও নতুন কোনো চমক নিয়ে হাজির হোক জেসিয়া। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে তার জন্য নিরন্তর শুভ কামনা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fourteen − 6 =