অলকানন্দা মালা
রাগ, ধ্রুপদ, উচ্চাঙ্গ সংগীতকে একটু আলাদা করে রাখা হয়। উচ্চাঙ্গ সংগীতের দখল আছে এমন কণ্ঠশিল্পীদের সংখ্যা কম। সেকারণে যারা পারদর্শী তাদেরও আলাদা চোখে দেখা হয়, সমীহ করা হয়। রাগ, ধ্রুপদী, উচ্চাঙ্গসংগীতে একটি বিস্মৃত নাম আভা আলম। গান গেয়ে যিনি নাম করেছেন উপমহাদেশজুড়ে।
জন্ম
আভা আলম ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মাদারীপুর শহরের এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক নাম আভা দে। আভা যে সংগীতে সৌরভ ছড়াবেন তা যেন পূর্ব নির্ধারিত ছিল। কেননা তার বাবা হরিপদ দে ছিলেন গানের মানুষ। এক সংস্কৃতিবান্ধব পরিবারে জন্ম হয়েছিল আভা দে’র। তাই বেড়ে ওঠাও ছিল গানে এানে।
গানের হাত ধরে বেড়ে ওঠা
ছোটবেলায় গানে হাতেখড়ি নিতে ঘরের বাইরে পা রাখতে হয়নি তাকে। বাবার কাছেই নিয়েছিলেন সংগীতের প্রথম পাঠ। পরে আভা দ্বারস্থ হন ময়মনসিংহের নামকরা উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী মিথুন দে’র। তার কাছ থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শুরু করেন উচ্চাঙ্গ সংগীতের পাঠ গ্রহণ। এখানে বলে রাখা ভালো, আভা দের জন্ম মাদারীপুর হলেও পরে তারা পারিবারিকভাবে ময়মনসিংহে থিতু হন।
সংগীতাঙ্গনে বিচরণ
সংগীতাঙ্গনে নাম লেখাতে বেশি সময় নেননি আভা আলম। ১৯৫৯ সালে বয়স যখন ১৩ তখন প্রথম মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ান। পাকিস্তান বেতারের ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রথম গান পরিবেশন করেন তিনি। বৃষ রাশির এই জাতিকার ব্যস্ততার শুরু সেখান থেকেই। আস্তে আস্তে বিচরণের পরিধি বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন বেতার কেন্দ্রে গান পরিবেশন করতে থাকেন আভা আলম।
গুণীজনদের সান্নিধ্য
সেসময় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের স্বনামধন্য শিল্পী ছিলেন আমানত আলী খাঁ। তার সঙ্গে গান পরিবেশন করেন আভা আলম। এছাড়াও আরও অনেক গুণী সংগীতজ্ঞদের সঙ্গে মাইক্রোফোন ভাগ করেন তিনি। তাদের সঙ্গে গান পরিবেশন করতে গিয়ে কখনও তাদের আলোয় ম্লান হননি। বরং নিজের আলোয় আলোকিত থেকেছেন। উদাহরণস্বরুপ চট্টগ্রামের সালামত আলী খাঁ ও নাজাকত আলী খাঁর কথা বলা যায়। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাগ সংগীত পরিবেশন করতেন তিনি। এ তালিকায় ময়মনসিংহের ফতে আলী খাঁও রয়েছেন।
জনপ্রিয়তা
সংগীতাঙ্গনে পা রাখার অল্প দিনেই পরিচিতি পেয়েছিলেন আভা আলম। গড়ে ওঠেছিল তার অনুরাগীগোষ্ঠী। ফলে নিজের কণ্ঠের রাগ রাগিণী আর বেতারের স্টুডিওতে বন্দি রাখা বেশিদিন সম্ভব হয়নি। ছড়িয়ে দিতে হয় মঞ্চেও। সেসময় ঢাকার বিভিন্ন আসরে গান পরিবেশনের জন্য ডাক পেতে থাকেন আভা আলম। সেসব আসর মুগ্ধ হতো গায়িকার সুরের ইন্দ্রজালে। আভা আলম। টেলিভিশনেও ছড়িয়েছিলেন তার সুরের সৌরভ।
পূর্ব বাংলার বাইরে জনপ্রিয়তা
আভা আলমের সুর শুধু তৎকালীন পূর্ব বাংলায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাড়িয়েছিল সীমানা। ঢাকায় বিভিন্ন মঞ্চে গান করে আভা যখন পরিচিতি পেয়ে গেছেন ততদিনে সুনাম ছড়িয়েছে অন্যান্য অঞ্চলেও। স্বামীর চাকরি সূত্রে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বাসা বেঁধেছেন আভা আলম। গান শুনিয়ে মন ভরিয়েছেন করাচি, রাওয়ালপিন্ডি, হায়দ্রাবাদের মানুষজনের। অল্প দিনেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন তিনি।
পশ্চিম পাকিস্তানে প্রশংসিত
পাকিস্তানের লাহোরে একবার কণ্ঠের মাধুর্য ছড়িয়েছিলেন আভা আলম। তার সে সুর মুগ্ধ করেছিল উপস্থিত শ্রোতাদের। এতে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন এ গায়িকা। কীর্তির শেষ নেই আভা আলমের। তিনি নিখিল পাকিস্তান সংগীত সম্মেলনে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে পুরিয়া ধানেশ্রী রাগে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। যা বিগলিত করেছিল সে সম্মেলনে উপস্থিত শ্রোতাদের। এ সময়ই পাকিস্তানের সংগীত সম্রাজ্ঞী রোশন আরা বেগমের সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি।
পরিচিতি ছড়িয়েছিল ভারতে
আভা আলমের পরিচিত ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতেও। তারাও বুঝেছিল এই গুণী কণ্ঠশিল্পীর কদর। সেখানকার বিভিন্ন স্থানে গান পরিবেশনের জন্য সরকারিভাবে আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। তবে স্বাস্থ্যগত জটিলতার কারণে সেসব আমন্ত্রণ আর রক্ষা করা সম্ভব হয়নি এ গায়িকার।
মনযোগী ছাত্রী ছিলেন
খ্যাতির শিখরে গিয়েও শেখার স্পৃহা ত্যাগ করেননি আভা। তার প্রমাণ খ্যাতি অর্জনের পরও গুরুর কাছে তালিম নেওয়া। পাকিস্তানে থাকাকালীন সেখানকার স্বনামধন্য সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আজহার মজিদের নিকট শাস্ত্রীয় সংগীতে পাঠ নেন তিনি। শাস্ত্রীয় সংগীতের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেন তার কাছ থেকে।
শিল্পকলার সঙ্গে প্রাণের সম্পর্ক
অল্প বয়সেই সংগীতে নাম করেছিলেন আভা আলম। শ্রোতাদের মন জয় করে সর্বত্র পেয়েছিলেন কদর। জীবদ্দশায় জড়িত ছিলেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, সংগীত প্রসার সমিতির সঙ্গে ছিল তার প্রাণের সম্পর্ক। ছায়ানট, আলতাফ মাহমুদ সংগীত একাডেমির সঙ্গেও নিবিড় যোগাযোগ ছিল তার। পাশাপাশি আতিক সংগীত একাডেমির অধ্যক্ষ এবং সেনানিবাস সংগীত একাডেমির সহ-অধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। এছাড়া একাধিক সংগঠনের সঙ্গে আমৃত্যু জড়িত ছিলেন তিনি। পরীক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন আভা আলম। ঢাকা বিভাগের উচ্চাঙ্গ সংগীতের বহিরাগত পরীক্ষক হিসেবে ছিলেন তিনি।
ব্যক্তিগত জীবন
ব্যক্তিগত জীবনে আভা আলম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন তরিকুল আলমের সঙ্গে। তরিকুল আলম ছিলেন একজন সংগীত বোদ্ধা। তিনি স্ত্রীর গানের একজন অনুরাগীও ছিলেন বটে। এই বিয়ের পরই আভা দে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন আভা আলম নামে।
মৃত্যু
উচ্চাঙ্গ সংগীতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মানা হয় আভা আলমকে। তবে খুব বেশিদিন সুর লহরী কণ্ঠে ধারণ করা হয়নি তার। তিনি ছিলেন এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা। ১৯৭৬ সালের ২১ নভেম্বর জীবনের লেনদেন চুকিয়ে পরপারে পাড়ি জমান তিনি। মৃত্যুকালে এ গায়িকার বয়স হয়েছিল মাত্র ২৯ বছর।
পরিশেষে
সংগীতে এ ভূমিকা পালনে মৃত্যুর দুই বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে। আভা আলমের উচ্চাঙ্গ সংগীতের রেকর্ডও প্রকাশিত হয়েছিল। তার কয়েকটি পরিবেশনা হলো আমায় বলো না ভুলিতে বলো না, রাগ বাগেশ্রী বিলম্বিত একতাল ও দ্রুত তিনতাল ও রাগ শুদ্ধ কল্যাণ, মধ্যলয় ত্রিতাল, ছোট খেয়াল।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা