আমরা কি এই বিপিএল চেয়েছিলাম

উপল বড়ুয়া: কথায় আছে, ‘সকালের সূর্য সবসময় দিনের সঠিক পূর্বাভাস’ দেয় না। সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) নিয়েও সে কথা বলা যায়। বিতর্কিত অধ্যায় দিয়ে শুরু হলেও মাঝপথ থেকে জমে উঠেছিল দেশের অন্যতম এই ক্রিকেট লড়াই।

আন্তর্জাতিক সূচির পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে ফ্র্যাঞ্জাইজি ক্রিকেট জেঁকে বসেছে। নতুন লিগ সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইএল টি২০ তো নেমেছিল টাকার বস্তা নিয়ে। টাকার গন্ধে মাতোয়ারা অনেক নামী ক্রিকেটারকে দেখা গেছে মরুর বুকের ক্রিকেটে। নতুন বছরে প্রথমবারের মতো ফ্র্যাঞ্জাইজি ক্রিকেট চালু করে দক্ষিণ আফ্রিকাও। সেই এসএ২০ লিগেও খেলেছেন বিশ্বের নামকরা ক্রিকেটাররা। জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি, নতুন এই দুই লিগ চালু হওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) থাকায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৯ম আসরের সূচি বের করা। তার মধ্যে আন্তর্জাতিক এফটিফিতে মার্চে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে পূর্ণাঙ্গ সিরিজ তো ছিলই।

সব জল্পনা-কল্পনার অবসানের পর চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স বনাম সিলেট স্ট্রাইকার্সের ম্যাচ দিয়ে গত ৬ জানুয়ারি শুরু হয় বিপিএল। কিন্তু কেমন পানসে আয়োজন! মাঠে নেই দর্শক। নেই তেমন বিদেশি বড় তারকা। প্রযুক্তি ত্রুটিতে যেন কণ্ঠরোধ অবস্থা। বিশ্বের চতুর্থ ধনী বোর্ডের এমন হতশ্রী আয়োজন দেখে হতাশ সবাই। শুরুতেই সৌম্য সরকারের এক আউট নিয়ে আম্পায়ারদের অত্যন্ত বাজে ও ভুল সিদ্ধান্ত যেন সবার সেই রাগের আগুনে ঘি ঢালল। দেশের ক্রিকেটে স্তরভিত্তিক ক্রিকেটে ক্লাব কর্মকর্তা ও আম্পায়ারদের ‘ঘুষনীতি’র দুই-চার কথা আমরা জানি, বুঝতে বাকি রইল না

বিপিএলেও সেই থাবা পড়েছে। তবে সেসবের সত্য-মিথ্যা উদঘাটন এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। ২০২৩ বিপিএলের উদ্বোধনী দিনেই কোনো কথাবার্তা ছাড়া সময়সূচি পরিবর্তন দেখে তো অবাক ক্রিকেট ভক্তরাও। যেন এ এক পাড়ার ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। না আছে ডিআরএস, না রিভিউ সিস্টেম। বিদেশের ফ্র্যাঞ্জাইজি ক্রিকেটে যখন রমরমা অবস্থা সবকিছুতে সেখানে তথ্য প্রযুক্তির যুগে বিপিএলের এমন দরিদ্রদশা দেখে কে না মন খারাপ করবে! তবে কি বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবনতির দৃশ্য আঁকা হয়ে গেল! এমন শঙ্কা যে কারও মনে ভর করতে পারে।

তবে শেষ পর্যন্ত সব আশঙ্কা উড়ে যায় সময়ের স্রোতে। মিরপুরের আকাশে ঘনীভূত কালো মেঘ কেটে ফিরে আসে দু’দণ্ড স্বস্তির বাতাস। এটা যেমন দেশের ক্রিকেট ভক্তদের জন্য আনন্দের তেমনি অনেক ক্রিকেটারের জন্যও। একটু পেছনে ফেরা যাক। গত বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যাটিংয়ে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পর লিটন দাসের নামই হয়ে গিয়েছিল ‘ডিসকাউন্ট লিটন’। কিন্তু মানুষ যে হার না মানা প্রাণ! বিখ্যাত আমেরিকান সাহিত্যিক আনের্স্ট হোমিংওয়ে তার নোবেলজয়ী উপন্যাস ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’তে লিখেছিলেন, ‘ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েট বাট ক্যান নট বি ডিফিটেড’। অর্থাৎ, মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে কিন্তু পরাজিত হতে পারে না। লিটন সেটির প্রকৃত উদাহরণ হয়ে থাকলেন। বিশ্বকাপের ব্যর্থতা ভুলে গত বছরের পুরোটা বইয়ে দিলেন রানের বন্যা। একই গল্প নাজমুল হোসেন শান্তরও। প্রতিভাবান ব্যাটারের তকমা তার গায়ে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে। কিন্তু এক ম্যাচে সাফল্য পান তো দশ ম্যাচে ব্যর্থ। অবশ্য দু’এক জনের নাম এই তালিকা থেকে বাদ দিলে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এমন দৃশ্য খুব সাধারণ হয়ে গেছে সবার কাছে। ব্যর্থতা ভুলে শান্তর ব্যাটও হাসলো ২০২৩ বিপিএলে। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসকে হারিয়ে শিরোপা জেতাতে না পারলেও ফাইনালে ৪৫ বলে খেললেন ৬৪ রানের ঝোড়ো ইনিংস।

পুরো আসরে সর্বোচ্চ রানও করেন শান্ত। ১৫ ইনিংসে ১১৬.৭৪ স্ট্রাইক রেটে ৫১৬ রান করে বিশ্বব্যাপী বয়ে যাওয়া টি-টোয়েন্টি হাওয়ায় নিজেও বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন তিনি। সমান ১৩ ইনিংসে ৪২৫ ও ৪০৩ রান করে সর্বোচ্চ সংগ্রহের তালিকায় পরের দুই স্থানে রনি তালুকদার ও তৌহিদ হৃদয়। বিপিএলে ভালো খেলার পুরস্কারও পেলেন তারা। ডাক পেয়েছেন সফরে আসা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে। আট বছর পর দলে ফিরলেন রনি। বিপিএলে সর্বোচ্চ রান স্কোরারের তালিকায় এক থেকে সাত, সবাই বাংলাদেশি। সেরা দশের মধ্যে কেবল একজন বিদেশি, আট নম্বরে থাকা পাকিস্তানি ব্যাটার ইফতিখার আহমেদ। সেরা দশের মধ্যে তার স্ট্রাইক রেটই সর্বোচ্চ ১৫৭.৪০।
তবে একই সূচিতে বিগ ব্যাশ লিগ, আইএল টি২০, এসএ২০ ও পিএসএল পড়ে যাওয়ায় এবারের বিপিএলে তেমন বিদেশি আসেনি। এমনিতে অর্থসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পিছিয়ে পড়ায় বিপিএলের প্রতি আগ্রহও হারাচ্ছে বাইরের খেলোয়াড়েরা। মাঝখানে পিএসএলে খেলার জন্য বিপিএল ছেড়ে ঘরে ফেরেন ইফতিখার, মোহাম্মদ আমির, শোয়েব মালিকের মতো তারকারা। চলে যান ইংলিশ ব্যাটার ডেভিড মালানও। তবে তাতেও রোমাঞ্চের উপস্থিতি কমেনি। বিপিএল যতোই এগিয়েছে, শীতের খোলস ছেড়ে বসন্তের বেরিয়ে আসার মতো মৃদু উষ্ণতাও ছড়িয়েছে।

বিপিএলের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সমস্যা এখানে শেষ নয়। প্রতিবার মালিকানা ও নাম পরিবর্তন যেন ধন্দে ফেলে দিয়েছে ভক্তদের। এবারের সাকিব আল হাসানের দল ফরচুন বরিশালের নাম ধরুন। ২০১২ সালে শুরু হওয়া বিপিএলের প্রথম আসরে এই ফ্র্যাঞ্চাইজির নাম ছিল বরিশাল বার্নার্স। পরে বরিশাল বুলস। এরপর কতবার যে নাম পাল্টাছে! এবারের রানার্সআপ সিলেট স্ট্রাইকার্সের নাম পাল্টেছে পাঁচবার। খেলোয়াড় ধরে রাখা বা ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি তো প্রতি মৌসুমেই হচ্ছে। তবে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) বা বিগ ব্যাশ লিগে (বিবিএল) এমন ঘটনা খুব কম। বিরাট কোহলি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্সে (আরসিবি) খেলছেন দীর্ঘদিন হয়। মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের নাম শুরু থেকেই মুম্বাই ইন্ডিয়ানস। কলকাতা নাইট রাইডার্সও একই নামে। তবে পাল্টেছে পাঞ্জাব কিংসের নাম। অন্য দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ যখন এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের বিপিএল পিছিয়ে পড়ছে ক্রমান্বয়ে।
এবার সাত দলের এই বিপিএল আসরে রবিন রাউন্ড পেরিয়ে শেষ চারে জায়গা করে নেয় (উপর থেকে) সিলেট সিক্সার্স, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস, রংপুর রাইডার্স ও ফরচুন বরিশাল। বাদ পড়ে ১২ ম্যাচে সমান ৬ পয়েন্ট পাওয়া (নিচ থেকে) চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স, ঢাকা ডমিনেটরস ও খুলনা টাইগার্স। সমান ১৮ পয়েন্ট পায় সিলেট ও কুমিল্লা। নিয়ম অনুযায়ী এরপর শুরু হয় কোয়ালিফায়ার ১-২ এবং এলিমিনেটর পর্বের খেলা। সেই পর্ব পেরিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনালে জায়গা করে নেয় সিলেট এবং গত আসরের চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লা।

ফাইনালের আগের দিন বাংলাদেশের নতুন গর্ব মেট্রো রেলে শিরোপা হাতে ফটোসেশন করেন কুমিল্লার অধিনায়ক ইমরুল কায়েস ও মুশফিকুর রহিম। নিয়মিত অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা ব্যক্তিগত কারণে অনুপস্থিত থাকায় সিলেটের হয়ে ফটোসেশনে যোগ দেন দলের সিনিয়র খেলোয়াড় মুশফিক। তবে ফাইনালে খেলেছেন ম্যাশ। কিন্তু অভিজ্ঞতা দিয়েও সিলেটকে প্রথমবারের মতো এনে দিতে পারেননি শিরোপা।

এর আগে যে চারবার ফাইনাল খেলেছেন মাশরাফি প্রতিবারই শিরোপা জিতেছেন। গতবার কুমিল্লাকে এনে দিয়েছেন ট্রফি। কিন্তু এবার দল বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে যেন ভাগ্যটাও বদলে গেল। কারণ অবশ্য কুমিল্লা। বিপিএলে যে একচ্ছত্র আধিপত্য তাদের! চারবার শিরোপা গেল তাদের ঘরে। তার মধ্যে এই প্রথম ব্যাক টু ব্যাক চ্যাম্পিয়ন হলো নাফিসা কামালের দল। শিরোপা জয়ের পর লাল জার্সিতে তিনি উল্লাসে মেতে ওঠেন দলের ক্রিকেটারদের সঙ্গে। আগের প্রতিটি আসরের মতো এবারও ফাইনাল হয়েছে মিরপুরের শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে। শুরু হয় এই ভেন্যুতে। এরপর দ্বিতীয় পর্ব চলে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে চায়ের দেশ সিলেটে। সিলেট পর্ব শেষে ফের শুরু হয় ঢাকা পর্ব। মিরপুরেই কোয়ালিফায়ার ও এলিমিনেটর পর্ব শেষে ফাইনাল।

২০ ওভারের সংক্ষিপ্ত সংস্করণের পর থেকে গত দুই দশকে আমূল পাল্টে গেছে ক্রিকেট। এখন আগের সেই ‘ঝিঁ ঝিঁঁ’ পোকার ডাক শোনা যায় না ক্রিকেটে। যেন অবস্থা হয়ে গেছে এমন ‘ধরো তক্তা মারো পেরেক’। আন্তর্জাতিক, ফ্র্যাঞ্চাইজি, ঘরোয়া ক্রিকেট মিলিয়ে এখন ক্রিকেটারদের শ্বাস ফেলার ফুসরত নেই। তবে পকেটও যে ভারী হচ্ছে না তা নয়। সবার এখন মনোযোগ টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই জায়গায় পিছিয়ে। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে সাফল্যের দেখা পেলেও টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে এখনো সেই সোনার হরিণের পিছু পিছু ছুটতে হচ্ছে টাইগারদের। অথচ বিপিএল হয়ে উঠতে পারতো দেশের ক্রিকেটারদের প্রতিভা অন্বেষণের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু আইপিএল থেকে ভারত প্রতিভাবান ক্রিকেটার পেলেও, বাংলাদেশে তা হাতেগোনা। যে কয়জন এসেছিলেন তারাও ক্যারিয়ারটা উল্লেখযোগ্য ও লম্বা করতে পারেননি। এর দায় কর্তৃপক্ষের ওপরেও বর্তায়। বিপিএল হয়ে গেছে এখন কেবল বাৎসরিক এক প্রথাগত টুর্নামেন্ট। কিন্তু এবার তাতে অভাবটাও দিগম্বর হয়ে ফুটে উঠেছে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। যদি এখন থেকে সাবধান হওয়া না যায় তবে অচিরেই পচন শুরু হবে। বিপিএলের প্রথম দুয়েক আসরের যে উত্তেজনা, বড় তারকাদের মাঠ দাপানো সব যেন এখন স্মৃতির করাল গ্রাসে হারিয়ে যেতে বসেছে। বিমুখ হয়ে পড়েছে দর্শকরাও। এখন গ্যালারিতে বসে তাদের হৈ-হুল্লোড় আর দেখা যায় না। নেই প্রিয় দল ও খেলোয়াড়ের নামে গলা ফাটিয়ে চেঁচানোর দৃশ্যও। সামনে ক্রিকেটের আরও পরিবর্তন আসবে। বিভিন্ন ক্রিকেট খেলুড়ে দেশও নতুন নতুন লিগ শুরু করবে। এখন থেকে যদি ঢালাওভাবে বড় চিন্তা করা না যায় বা নতুন বিনিয়োগ না আসে তবে হুমকির মুখে পড়বে বিপিএলের ভবিষ্যত। দেখা যাবে, একই সময়ে হওয়া নিজের দেশের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ছেড়ে অন্য দেশের লিগে খেলতে গেছেন সাকিব। তখন আর ক্রিকেটারদের দোষ দেওয়া যাবে না।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 − 3 =