আমাদের মেমী…

মুনিরা ইউসুফ মেমী, সকলেই তাকে দক্ষ অভিনেত্রী হিসেবে চিনে। পাশাপাশি তার আরেকটি পরিচয় হলো তিনি একজন  আবৃত্তি শিল্পী। জীবনের এই পর্যায়ে এসে সবচেয়ে বেশি আপন করে নিয়েছেন কবিতাকে। ফেইসবুক পেইজের মাধ্যমে তার কবিতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি ভক্তদের কাছে। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা বরিশাল শহরে। বরিশাল থেকে তিনি অনেক স্বপ্ন নিয়ে কলেজে থাকা অবস্থাতেই ঢাকা চলে আসেন পড়াশোনা করতে। এত কম বয়সে ঢাকা আসার পর কিছুটা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও তিনি থেমে যাননি। অভিনয়, বাচনভঙ্গি ও ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি মন জয় করেছেন সকল ভক্তদের।

সংস্কৃতিক পরিবারেই বড় হয়েছেন তিনি। তার বোনেরা ভীষণ ভালো গান করতেন। গান জানলেও তার বোনেরা সংস্কৃতিক জীবনে পা দেননি, তা নিয়ে মা বাবার ভীষণ আফসোস ছিল। সেই আফসোস মিটিয়ে দিয়েছে মুনিরা ইউসুফ মেমী। ছোটবেলা থেকে নাচের প্রতি প্রবল আকর্ষণ থাকলেও বেশিদিন তিনি নাচের সাথে যুক্ত থাকেননি। কিশোরী অবস্থায় বরিশালের নাট্য দলের সাথে তিনি যুক্ত হন। সেখানে নাট্যকর্মী হিসেবে বেশ প্রশংসা পেয়েছেন। সেই প্রশংসা ও উৎসাহই তাকে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা আরো বড় কিছু করার। এসএসসি পাস করে তিনি উচ্চশিক্ষা নেওয়ার জন্য ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা সরকারি ইডেন কলেজে। তখন থেকেই তার অভিনয়ের যাত্রা পাকাপোক্তভাবে শুরু। তিনি যখন ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন তখন অনেকেই তাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, এই বাধাই যেন তাকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তুলেছে, কিছু একটা করতে হবে এই আগুন জ্বালিয়েছে। ইডেন কলেজে পড়াকালীন সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে কাজ করা শুরু করেন তিনি। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই মঞ্চের সাথে জড়িত ছিলেন তাই কাজ করতে খুব একটা অসুবিধা হতো না।

এই যে কণ্ঠস্বর, তার কথা আমার কথা, ফিরিয়ে দাও অরণ্যর মতো কালজয়ী বিভিন্ন নাটকে তিনি অভিনয় করেন। ফিরিয়ে দাও অরণ্যতে ভিন্নধর্মী একটি চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন। ঢাকা থিয়েটার আরামবাগের সাথেও তিনি কাজ করেন। থিয়েটারে তিনি জমিদার দর্পণ ও নীলদর্পণে কাজ করেন। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে থিয়েটারের দল নিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের পরিচিতি ছড়িয়ে দেন। শুধু থিয়েটার ও ছোটপর্দায় নয় বড়পর্দায়ও বেশ কয়েকবার দেখা যায় তাকে।

মন মানে না, হঠাৎ দেখা, পুত্র ইত্যাদি সিনেমায় তিনি অভিনয় করেন। তবে তিনি যত কাজ করেন না কেন কাজের গুণগতমানের দিকে তিনি খেয়াল রাখার চেষ্টা করেন। গল্প ও চরিত্র তার ব্যক্তিত্বের সাথে গেলেই তবে তিনি সে কাজের সাথে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গুণগত কাজ না পাওয়ার জন্য মাঝে তিনি কাজ করা কমিয়ে দিয়েছিলেন। অভিনয় থেকে দূরে থাকার কারণ বলতে গিয়ে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, পরিণত বয়সের জন্য উপযুক্ত ক্যারেক্টর পান না বলে কাজ কিছুটা কমে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন অভিনয় জগতে সব বয়সের মানুষের প্রয়োজন রয়েছে এবং প্রত্যেক বয়সেরই আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। তবে অভিনয়কে তিনি কখনোই পেশা মনে করেননি। এটি সবসময় তার শখের জায়গা ছিল। কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই তিনি সবসময় বলেন, অভিনেতা কিংবা শিল্পীদের কখনো প্রমোশন হয় না বরং সময়ের সাথে সাথে চাহিদা কমে যায়।

তিনি মনে করেন অভিনয় তার রক্তে মিশে আছে। সেজন্যই অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে আজও টিকে আছেন তিনি। অভিনয় জগতের প্রতি অনেক অভিযোগ ও অভিমান থাকার পরেও এ জায়গাটিকে তিনি সবসময় শ্রেষ্ঠ মনে করেন। কারণ এই স্থানটি তাকে একটি পরিচয় দিয়েছে। অভিনয় তাকে অনেক মানুষের ভালোবাসা পেতে সাহায্য করেছে, অনেক সম্মান দিয়েছে। তাই বিরতি নেওয়ার পরেও বারবার এই স্থানে তিনি ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।

গুণী এই অভিনেত্রীকে সবসময় হাস্যজ্জল অবস্থাতেই দেখা যায়। কারণ তিনি মনে করেন ‘নিজেকে ভালো আছি যে মনে করে’ সে মানুষ কখনো খারাপ থাকতে পারে না। তাই সবসময় ইতিবাচক মনোভাব ধারণ করেন তিনি। নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করেন তিনি। কারণ বিয়ের আগে মা বাবা এবং বিয়ের পর স্বামী ও শাশুড়িকে জীবনের সবক্ষেত্রে পাশে পেয়েছেন। তার মা-বাবা কখনোই তার কোনো সিদ্ধান্ত কিংবা কাজে বাধা দেননি। বরং প্রতি পদে তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। এই শিক্ষা তিনি মা-বাবার কাছ থেকে অর্জন করেছেন এবং নিজের সন্তানকেও তিনি কখনো কোনোকিছুতে বাধা দেন না বা চাপিয়ে দেন না। তার মেয়ে যখন ছোট ছিল তখন তাকে নাচ শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারলেন তার মেয়ের নাচের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তখন আর মেয়েকে জোর করেননি তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন যে কাজ ভালোবেসে করা যায় সে কাজে সফলতা অর্জন করা যায়।

খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস তার। সকালের গরম চায়ের পরে শুরু হয়ে যায় তার ব্যস্ত দিন। অবসর সময় নিজের প্রিয় কোনো পদ রান্না করেন, গাছে পানি দেন কিংবা কবিতা আবৃত্তি করেন। পরিবারের সাথে জীবনের কোনো বিশেষ দিন উদ্্যাপন করতে ভালোবাসেন তিনি। জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকী যেকোনো বিশেষ দিন তার শাশুড়ি তার প্রিয় খাবার রান্না করেন। ব্যস্ততায় অনেক সময় নিজের জন্মদিনের কথা ভুলে গেলেও পরিবারের সকলে তাকে বেশ হৈ হুল্লোড় করে মনে করিয়ে দেয়। ক্যারিয়ার ও সফলতার মাঝখানেও ৩০ বছর ধরে বেশ গুছিয়ে নিজের সংসার করছেন তিনি। বর্তমান সময় বিচ্ছেদের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্পর্ক ভালো রাখতে হলে ভীষণ ধৈর্যশীল হতে হবে। জীবনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাড়াহুড়া করা যাবে না, সময় দিতে হবে।

সময়ের সাথে সাথে জীবনের অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রেও তাই। বাবা মায়েরা সন্তানকে অনেক সময় কিছু একটা করতে নিষেধ করে। কিন্তু সন্তানকে কোনোকিছু করতে নিষেধ করার আগে নিজেরও সে কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। সন্তানকে কোয়ালিটি সময় দিতে হবে। তবে এর মানে এই নয় যে সারাক্ষণই সন্তানের সাথে থাকতে হবে। যতটুকু সময় থাকা যায় ততটুকু সময় যাতে সুন্দর হয়।

মুনিয়া ইউসুফ মেমী বলেন, ভালোবাসা ছাড়া জীবন থেকে এখন আর তার চাওয়ার কিছু নেই। জীবনের বাকিটা সময় তিনি মানুষের কল্যাণে কাজ করতে চান। জীবনের প্রতিটা সময় তিনি উপভোগ করতে চান। কারণ তিনি মনে করেন প্রতিটা সময়ের একটি আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। জীবনে যখন দায়িত্ব ছিল না সে সময়টা যেমন উপভোগ করেছেন এখন অনেক দায়িত্বের মাঝেও নিজেকে গুছিয়ে জীবন উদযাপন করছেন। অতীতে করা ভুল নিয়ে তিনি কখনো আফসোস করেন না বরং অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি বর্তমানকে গুছিয়ে বাঁচিয়ে রাখেন।

তিনি অভিনয় ও কঠোর পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে গেছেন। তাই যতদিন বেঁচে আছেন ভালো কাজের সাথে থাকতে চান। ক্যারিয়ারের এ পর্যায়ে এসে তিনি বেশ বাছাই করে কাজ করেন, যে কাজে তাকে মানাবে এবং তিনি তৃপ্তিবোধ করবেন। তিনি বলেন ‘আমি ভীষণ উপলব্ধি করি, সেখান থেকে উদ্্যাপন করি’। তিনি কাজ থেকে বিরতিতে থাকলেও সকল মানুষ তাকে ভালোবাসে, স্মরণ ও শ্রদ্ধা করে যা তিনি অনেক টাকা দিয়েও কিনতে পারবেন না। তার জীবনে এখন প্রধান কাজই হচ্ছে যা কিছু অর্জন করেছেন তা ধরে রাখা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

eleven − 3 =