আমার বইমেলা

ইরানী বিশ্বাস

আবহমান কাল থেকে আমাদের দেশে হরেক রকমের মেলার প্রচলন রয়েছে। তারমধ্যে অমর একুশে বইমেলা অন্যতম। ‘মেলা’ শব্দের ব্যাকরণগত অর্থ ‘মিলন’। এটি ‘মিল’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু করে শেষ দিন পর্যন্ত চলতে থাকে বইমেলা। বইপড়া ব্যতীত জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়। তাই জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। বই মানুষের জাগতিক, মনস্তাত্ত্বিক, নৈতিক, দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চমার্গে পদার্পনের প্রধান সোপান। কথায় বলে যে জাতি যত শিক্ষিত, সেই জাতি তত বেশি উন্নত। আর বই হচ্ছে শিক্ষার মূল উপকরণ।

বইমেলা যে কোনো জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বইয়ের সাথে মানুষের সম্পর্ক যত নিবিড় ও ঘনিষ্ট হবে, মানুষের চিন্তা-চেতনা তত উন্নত হবে। বিশ্বের যত জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, বিপ্লবী এবং স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই বইয়ের সাথে ছিল নিবিড় সম্পর্ক। বিশ্ব ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিপ্লবী নেতা চে’গুয়েভারা সবসময় বন্দুকের সাথে পাবলো নেরুদার ‘কান্তো জেনারেল’ বইটি রাখতেন, বিশ্বখ্যাত আলেকজান্ডার দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় বই পড়েছেন।

১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গণের বটতলায় প্রথম বইমেলার গোড়াপত্তন হয়। মুক্তধারা ও পুঁথিঘর প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী প্রায়ত চিত্তরঞ্জন সাহা মাটিতে চট বিছিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত ত্রিশ-বত্রিশটি বই বিক্রির মাধ্যমে বইমেলার শুভ সূচনা করেন। ১৯৮৪ সালে সরকারিভাবে আইন পাস করে ভাষা আন্দোলনে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বইমেলার নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। শুরু থেকে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজে বইমেলা বিস্তৃত থাকলেও ২০১৪ সালে সম্প্রসারণ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

বইমেলা মূলত স্মৃতিমেলা। যেদিন থেকে বইমেলায় যাচ্ছি সেসব স্মৃতি যেন জীবনের পরতে পরতে মিশে আছে। কতো মানুষ, কতো মুখ, কতো হাসি; বই-পত্রিকা, গান, চেনা মানুষের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। কতো বড়-ছোট লেখক, পাঠক সকলেরই প্রাণকেন্দ্র বইমেলা। শুরুর আগে যতটা আনন্দ থাকে, শুরু হতে না হতেই মনের মধ্যে কেমন একটা বিষাদের বাতাস হু-হু করে বয়ে যায়।

বইমেলায় বহু মানুষের ভিড়। নানান বয়সি মানুষের অবিরাম ব্যস্ততা। সারাবছর মলাটবদ্ধ পুরানো বইগুলো যেন অপেক্ষা করে নতুন ছাপানো বইয়ের সাথে বইমেলায় ঘুরতে যাবে। সদ্য বানানো স্টলগুলোর সেল্ফে মেলায় আসা বইগুলো ভাঁজ ভাঙা শাড়ি পরা নব-বধূর মতো অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে প্রিয় পাঠকদের জন্য। দুপুরের ধুলা ওড়া রোদে নতুন বইয়ের ঝলকে পাঠকের চোখ চিকচিক করে ওঠে। অথবা অতি যত্নে কনে দেখা আলোয় কাক্সিক্ষত বইয়ের মলাট ছুঁয়ে যায় পাঠকের আঙ্গুল। বিরহি প্রেমিকের মতো শিহরিত হয় মেলায় আসা নতুন বইয়ের প্রাণ। আবেগে আপ্লুত হয় ক্রেতার মনে ধরলে। ন্যায্য দামে কেনা বই পেয়ে পাঠক যেমন হয় তুষ্ট, তেমনি সঙ্গে যেতে পারার আনন্দে বই হয় আহ্লাদে আটখানা। পাঠকের মন আকৃষ্ট না করতে পারলে পড়ে থাকে নতুন ক্রেতার অপেক্ষায়।

প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি জুড়ে বইকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং সোহরাওয়ার্দীতে সৃষ্টি হয় জনসমুদ্র। এক বছরের অপেক্ষা শেষে দেখা যায় অনেক পরিচিত মুখ। কুশল বিনিময়ে আবার জমে ওঠে চিড় ধরা সম্পর্কে। নতুন-পুরাতন পাঠক-লেখকের মেলবন্ধনে এক নতুন পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। নামী লেখক বা অনামী সবাই যেন এক সুতায় বাঁধা হয়ে যায়। এখানে সকলের আগমনের উপলক্ষ্য একই। লেখক নিজের বই পাঠকের কাছে পরিচিত করতে ব্যস্ত। প্রকাশক লেখকের বই বিক্রি করতে ব্যস্ত। পাঠক নিজের পছন্দের বই খুঁজে পেতে ব্যস্ত। লেখক-প্রকাশক-পাঠকের ব্যস্ততাই যেন বইমেলার প্রাণ। সব মিলিয়ে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ।

সমগ্র দেশ থেকে বইপ্রেমী মানুষ ছুটে আসে প্রাণের টানে। নির্দিষ্ট ঠিকানা খুঁজে পেতে ছুটতে থাকে দিকবিদিক। প্রতিটি বইয়ের স্টল যেন এক একটি বাড়ি। বৈচিত্র্যময় নামের সম্ভার নিয়ে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে প্রতিটি স্টল-বাড়ি। বাড়িতে বসবাস করা সকল সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিতে রয়েছে অনেক বিক্রয়বন্ধু। কোনো সদস্যের সাথে পরিচয় হয়ে খুশি মনে আমন্ত্রণ জানানো হয় সঙ্গে যেতে। কাউকে আশ্বাস দেয় পরবর্তী সাক্ষাতের জন্য। কেউবা থাকে কুশল বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

প্রতিটি বইয়ে বন্দি রয়েছেন কতো জ্ঞানীগুণী, মনীষির কথা। নীরবে কান পাতলে শোনা যায় সেসকল মানুষের রেখে যাওয়া কথামালা। প্রতিটি বইয়ের পরতে পরতে বন্দি ভাষাগুলো যেন মুক্তি পেতে চায় পাঠকের হাত ধরে। মলাটবদ্ধ জ্ঞান বিকষিত হতে চায় মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর। আত্মচিৎকারে সেসব বাণী যেন আহ্বান করছে সমজদার পাঠকদের।

মায়াবী আলোয় ভরে থাকে বইমেলার সান্ধ্য পরিবেশ। অপার্থিব এক আলোয় ঝলমল করে মেলা প্রাঙ্গণ। প্রিয়মুখের সাক্ষাতে প্রাণ-মন আনন্দিত হয়ে ওঠে। মেলা প্রাঙ্গণ জুড়ে শুধু বই নয়, রয়েছে বৈচিত্র্যময় খাবারের সম্ভার। সেখান চলে জমজমাট আড্ডা। সময়ের হাত ধরে মেলা প্রাঙ্গণের সব আলো একে একে নিভে আসে। মেলা প্রাঙ্গণে উপস্থিত সকলেই নিজ গন্তব্যে পা বাড়ায়। এভাবেই একসময় শেষ হয় ফেব্রুয়ারি মাস। আনন্দ-বিষাদে মন বিচলিত করে শেষ হয় বইমেলা, প্রাণের মেলা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × four =