আলোর পথযাত্রী এখানে থেমো না…

ঋষিকা

নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আজকের বিশ্বেও মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে রয়ে গেছে। পরিবর্তন সম্ভব। কিন্তু সেই প্রচেষ্টাকে দ্বিগুণ জোরদার করতে হবে।  যাতে সবাই মিলে এক সঙ্গে ২০৩০ সালের মধ্যে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার অবসান ঘটান যায়। ১৩টি দেশের প্রায় অর্ধেক নারী বলেছেন, মহামারির সময় হয় তারা নিজেরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন নতুবা তার পরিচিত অন্য কোনো নারীকে নির্যাতনের শিকার হতে দেখেছেন। জাতিসংঘের নারী বিষয়ক সংস্থার সাম্প্রতিকতম তথ্য বলছে, কোভিড ১৯ মহামারির সময় নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা আরও বেড়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা অনিবার্য কিছু নয়। সঠিক নীতি আর কর্মসূচি এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে পারে। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রবর্তিত একটি বিশেষ দিবস নারীর প্রতি সহিংসতার অবসান ঘটানোর আন্তর্জাতিক দিবস। এটি পালন করা হয় ২৫ নভেম্বর। যার লক্ষ্য হলো নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করা। বাংলাদেশ সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিবছর ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রতিরোধ পক্ষ উদযাপনে নানা কর্মসূচি পালন করে।

দিবসের ইতিহাস

১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত আন্দোলন করার জন্য প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল; এই তিন বোনকে হত্যা করা হয়।  তাদের স্মরণে ১৯৮১ সাল থেকে এই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়। ১৯৯৩ সালে ভিয়েনায় বিশ্ব মানবাধিকার সম্মেলন দিবসটি স্বীকৃতি পায়। ১৯৯৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর জাতিসংঘ দিবসটি পালনের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশ ১৯৯৭ সাল থেকে দিবসটি পালন করে আসছে। জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন নারী তাদের জীবনে নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন, জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং টেকসই উন্নয়নের পথে বড় বাধা। নারীর প্রতি অন্যায় প্রতিরোধ ও অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও শক্তিশালী করতে বিনিয়োগ জোরদার করা প্রয়োজন।

কেন সেই হত্যা, কেন এই দিবস

ডমিনিকান রিপাবলিকের ছোট্ট এক গ্রামের একটি পরিবার। পরিবারে বাবা মায়ের আছে তিন মেয়ে। প্যাট্রিয়া, মিনার্ভা আর মারিয়া তেরেসা মিরাবেল। পরিবারের তিন বোনের বয়স যথাক্রমে ৩৬, ৩৪ ও ২৫ বছর। তারা মানুষ সাধারণ। কিন্তু অসাধারণ কাজের নেশা তাদের পেয়ে বসেছিল। আর সে জন্যই সংসারে মন ছিল না আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতন। জড়িয়ে পড়েছিলেন একনায়ক শাসক রাফায়েল ট্রুজিলোর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজে। তারা রাফায়েলের গুম করা মানুষদের নাম লেখা তালিকা লিফলেটের মাধ্যমে বিলি করতেন। গোপনে বিপ্লবীদের সাহায্য করতেন। ফলে এই তিন বোনের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে, দেশের বাইরেও। দেশের মানুষ ভালোবেসে তাদের ডাকতে শুরু করেছিল ‘লা মারিপোসাস’ বা ‘আমাদের প্রজাপতিরা’ বলে! মিরাবেল বোনেরা ক্রমশ হয়ে উঠছিলেন গণতন্ত্র আর নারীবাদের প্রতীক। সেসময় ডমিনিকান রিপাবলিকের অত্যাচারী নিষ্ঠুর আর জাঁদরেল শাসক রাফায়েল। যার শাসনকাল ৩১ বছর। এত বছরে তিনি দেশে হত্যা, গুম ও নির্যাতন করেছেন হাজার হাজার মানুষকে। তার বিরুদ্ধে মুখ খুললেই পেতে হতো শাস্তি। হয় কারাগার বাস নয়তো গুম হতে হতো প্রতিবাদীদের। সংখ্যালঘু হাইতিয়ানদের গণহত্যার জন্যও দায়ী করা হয় তাকে।

১৯৬০ সালের ২৫ নভেম্বর লাতিন আমেরিকার দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকের স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন করতে গেলে প্যাট্রিয়া, মারিয়া তেরেসা ও মিনার্ভা মিরাবেল নামের তিন বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। তাদের দেশের মানুষ এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে ফুঁসে ওঠে। দিকে দিকে প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। মিরাবেল বোনদের হত্যার ছয় মাস পরই ডমিনিকান রিপাবলিকে একনায়কত্বের অবসান ঘটে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যায় দেশ। সেই সঙ্গে কিংবদন্তিতে পরিণত হন প্রজাপতি বোনেরা। পরবর্তী সময়ে তাদের স্মরণে ১৯৮১ সাল থেকে এই দিনটি আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিবাদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।

আইন কি বদলাতে পারবে চিত্র

নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থান কোনো রকমফের করে না নারীদের ক্ষেত্রে। দরিদ্র থেকে ধনী, উচ্চশিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, গ্রাম থেকে শহর; সর্বত্র সহিংসতার শিকার নারীরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) কর্তৃক পরিচালিত ২০১১ সালের জরিপ মতে, শতকরা ৮৭ ভাগ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। পরিবার বা পথে-ঘাটেই নয়, নারীরা কর্মক্ষেত্রেও নানা সহিংসতার শিকার হন। সাম্প্রতিক কালে নারীর প্রতি অন্যদের নির্যাতন ও সহিংসতার অস্বাভাবিকতাও মাত্রা ছাড়িয়েছে। করোনাকালেই ২০২০-এর অক্টোবরে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড রেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের খসড়া অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১৩ অক্টোবর এটি আইনে পরিণত হয়। বিচার ও আইনব্যবস্থা যেখানে এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি, বিচারপ্রার্থী নারী নিজেই যেখানে প্রশ্নে জর্জরিত আর চরম অবমাননার শিকার। যেখানে বিচার চাইলেই একজন নারীকে প্রথম প্রশ্ন করা হয়, ওখানে কেন গিয়েছিলে? সঙ্গে কেউ ছিল না কেন? মাথায় কাপড় ছিল না কেন? অথচ নেকাব-বোরকা পরা নারীরাও নির্যাতনের শিকার হন রাস্তাঘাটে। আমরা নারীদের ছোটবেলা থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করি। যুগ এখন বদলে গেছে, এখন নারীদের পরিবর্তনের কথা বলা হয়। তবে সেই কন্যা শিশুটির পাশাপাশি যে ছেলে শিশুটি বড় হচ্ছে তাকে আমরা নৈতিকতা শেখাতে ভুলে যাই। দেশে আইন কানুন অবশ্যই হবে। তবে সেটা সঠিক উপায়ে মানিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থাও থাকতে হবে। জনগণকে সেভাবে গড়ে তুলতে হবে।

সহিংসতার কারণে মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি

সহিংসতার শিকার একজন নারী ঘুরে দাঁড়াতে পারে তার আশেপাশের পরিবেশের সহায়তায়। কিন্তু সমাজ যদি তাকে সাহায্য না করে তাহলে সে কোনোদিনও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। সে মাথা উঁচু করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে না। আর এই না পারার দায় থাকবে সমাজের উপরে। সমাজ তাকে সেই নারীর মতোন করে তার অবস্থান থেকে স্বচ্ছতা দিতে না পারলে, একজন ভিক্টিমের বেঁচে থাকার ইচ্ছাটাই নাই হয়ে যায়। সহিংসতার ফল যে শুধুই মানসিক ক্ষতি তা নয়, এর আর্থিক ক্ষতিরও একটা দিক আছে।  আইএমএফের একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা ১ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম ৯ শতাংশ নেমে আসে।

নারীশিক্ষা, কর্মসংস্থান, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি, নিরাপদ কর্মক্ষেত্র, কর্মজীবী হোস্টেল, যানবাহনব্যবস্থা, নারী উদ্যোক্তা তৈরি, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ গুরুত্ব বহন করে। কেননা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। এই সমন্বিত কার্যক্রমে গণমাধ্যম পালন করতে পারে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা, সে ক্ষেত্রেও প্রয়োজন পরিকল্পিত কর্মসূচি। বৈশ্বিক এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে, নারীর প্রতি সহিংসতার কারণে (ব্যক্তি পর্যায়, জনপরিসর ও সামাজিক পরিসরে) ক্ষতির পরিমাণ ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে ক্ষতি হয় বছরে ৩৬৬ বিলিয়ন ডলার। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের লক্ষ্যে কেবল সুনির্দিষ্টভাবে সহিংসতার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ যথেষ্ট নয়, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে বিনিয়োগ না করলে প্রকৃত অর্থে সহিংসতা নির্মূল হবে না। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমন্বিত পরিকল্পিত বিনিয়োগ ও নীতি প্রণয়নে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। সেই সঙ্গে সহিংসতার বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে আওয়াজ তোলা এবং সেখানে সব শ্রেণিপেশা এবং পুরুষ ও তরুণদের যুক্ত করা দরকার।

ইদানীং আমরা সমঅধিকারের কথা বলি। অর্থাৎ নারী ও পুরুষ সবাই সমান অধিকার ও সুবিধা ভোগ করবে। কিন্তু যতদিন নারীরা নির্ভয়ে এবং স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে না, যতদিন নারীদের নিরাপত্তা এবং সহিংসতা নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হবে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে দিবসটি উপলক্ষ্যে এক বিশেষ আয়োজনে তৎকালীন জাতিসংঘ মহিসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বিশ্বব্যাপী মারণব্যাধি ক্যানসারের মতো রূপ নিয়েছে। এর ফলে অনেক নারী অল্প বয়সে মৃত্যুবরণ করছে।’ একজন নারী তার কর্মে ও সংসারে এগিয়ে যান কখনো মা, কখনো বোন, কখনো বন্ধু, কখনো স্ত্রী, আবার কখনো বা সহকর্মী রূপে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে ঘরে-বাইরে সকল ক্ষেত্রে নারী অতুলনীয় হলেও দিন শেষে তারাই হচ্ছে সহিংসতার শিকার। সেখানে গিয়ে যদি তাদের নির্যাতন আর সহিংসতার শিকার হতে হয় তাহলে তো সেই ট্যাবুটাই সত্যি হয়ে যায় যে, মেয়ে হয়ে জন্মানোই ভুল। আজকের বিশ্ব নারীদের নিয়ে ভাবছে, তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে, তবে এই কাজ যেন ফলপ্রসূ হয় সে দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

লেখাটির পিডিএফে দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

fifteen − 1 =