আলোর মিছিল: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আর এসব চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। সেই সময়ে নির্মিত এমনই একটি চলচ্চিত্রের নাম ‘আলোর মিছিল’। রঙ বেরঙ এর মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নিয়ে ধারাবাহিক আয়োজনে আমরা এবার আলো ফেলার চেষ্টা করব ‘আলোর মিছিল’ চলচ্চিত্রে। মৌ সন্ধ্যার প্রতিবেদন

আলোর মিছিলের মুক্তি
আলোর মিছিল মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালের ২৫ জানুয়ারি। দেশের বিখ্যাত চলচ্চিত্রটির পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন সদ্য প্রয়াত নায়ক ফারুক। আরও অভিনয় করেছেন ববিতা, রাজ্জাক, সুজাতা। চলচ্চিত্রটির কাহিনী ও সংলাপ রচয়িতা ইসমাইল মোহাম্মদ। চিত্রগ্রাহক ছিলেন রফিকুল বারী চৌধুরী ও সম্পাদক ছিলেন বশীর হোসেন। ঝরনা পিকচার্স প্রযোজনা করে চলচ্চিত্রটি। গীতিকার ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। নৃত্য পরিচালনা করেন গওহর জামিল। চলচ্চিত্রটির পরিবেশক চিত্রলোক। এখানে রাশেদ চরিত্রে দেখা যায় ফারুককে। আর আলো চরিত্রে অভিনয় করেন ববিতা। রানা নামের একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক। সুজাতার চরিত্রটির নাম ছিলো দিনা। আলিম চরিত্রে খলিল উল্লাহ খান ও সাইফুদ্দিন ছিলেন আলিমের সেক্রেটারি। রোজী আফসারী – মিনা, আনোয়ার হোসেন – শহীদ আশরাফ, নারায়ণ চক্রবর্তী – আলোর দাদু, ইনাম আহমেদ – মি. চৌধুরী, হাসমত – আলোর নাচের শিক্ষক ও রবিউল আলম অভিনয় করেন করিম চরিত্রে।

সংগীত
আলোর মিছিল চলচ্চিত্রের গানগুলো সুর করেছেন খান আতাউর রহমান এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন সত্য সাহা। গীত রচনা করেছেন মুস্তাফিজুর রহমান। গানে কণ্ঠ দিয়েছেন আব্দুল জব্বার, সাবিনা ইয়াসমিন ও পারমিতা মুমু। সিনেমাটিতে ‘এই পৃথিবীর পরে’ শিরোনামের গানটি গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন। ‘আমার নীরবতা আজ পেয়েছে ভাষা’ গানটি গেয়েছেন পারমিতা মুমু ও ‘দুঃখ কোরো না’ গানটি গেয়েছেন আব্দুল জব্বার।

কী আছে আলোর মিছিলে
মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে পুরো ছবির গল্প এগিয়েছে। যুদ্ধের আগে অল্প বেতনের এক চাকুরে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কালোবাজারি ও মজুদদারি করে দ্রুত বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করে। বিষয়টি মেনে নেয় না তার স্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা ভাই-বন্ধু কেউই। চারদিকে মজুদদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদ স্তব্ধ করতে হামলা হয়, ঘটনাচক্রে এ বাড়িরই সবার আদরের এক ভাগ্নির মৃত্যু হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নাটক ‘জল্লাদের দরবার’ করে পরিচিতি পাওয়া অভিনেতা নারায়ণ ঘোষ মিতা ‘আলোর মিছিল’-এর পরিচালক। ষাটের দশকেই তিনি পরিচালনায় আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশা-আকাক্সক্ষার বিপরীতে স্বাধীনতার পর যে কৃত্রিম সংকট তৈরির তৎপরতা চলেছিল, তা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ছবিতে। বিষয়বস্তুর সঙ্গে নানা চরিত্রে দক্ষ শিল্পীদের অভিনয় সমৃদ্ধ করেছে ছবিটিকে। কালোবাজারি খলিল, আহত মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাক, বিখ্যাত ছাত্রনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন, খলিলের স্ত্রী চরিত্রে রোজী, মিষ্টি ভাগ্নি ববিতা, প্রেমিকা চরিত্রে সুজাতা অভিনয়ে সবাই অনবদ্য।

যে সিনেমাতে রাজ্জাক-ববিতা থাকবেন, সেই ‘আলোর মিছিল’ সিনেমাতে অন্যকেও আলো ছড়াবেন, সেটা মেনে নেওয়া কিছুটা হলেও শক্ত। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে অভিনয় গুণেই সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন অভিনেতা খলিল। সিনেমার কাহিনীতে ছিল, একাত্তরে বিজয়ের পরে এই দেশে ৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সূচনা হয়। সেই সময় কিছু মুনাফালোভী মানুষ খাদ্য মজুদ করে নিজেদের পকেট ভারী করার জন্য। না খেয়ে থাকা মানুষের কষ্ট তাদের কাছে ডালভাতের মতো ছিল, ‘মরলে মরুক! আমার কি। আমার টাকা আসলেই হবে!’ এ ধরনের চিন্তাধারা। এই চরিত্রে দারণ অভিনয় করেছেন খলিল।

প্রশংসা ও পুরস্কার
দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসা তো আছেই, ছবিটি সেই সময়ের একমাত্র পুরস্কার ‘বাচসাস’-এর নানা শাখায়ও পুরস্কার অর্জন করে। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, পরিচালক, কাহিনীকার, গীতিকারসহ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হয়েছেন ববিতা, পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-অভিনেত্রী হন খলিল ও রোজী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন মিতা। কাস্টিংয়ে বড় চমক ছিল রাজ্জাক-ববিতার মামা-ভাগ্নি চরিত্রে অভিনয়। যদিও ববিতা শুরু করেছিলেন ‘সংসার’ ছবিতে রাজ্জাকের মেয়ে হয়ে। পরে বেশ কয়েকটি প্রেমের ছবিতে নায়ক-নায়িকা হয়ে জনপ্রিয় হন তারা। প্রতিষ্ঠিত রোমান্টিক জুটি থেকে পর্দায় মামা-ভাগ্নি হওয়ার প্রস্তাব পেয়ে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেন ববিতা। ছবিতে ছোট্ট একটি চরিত্রে ববিতার সঙ্গে পর্দা শেয়ার করেন ফারুক। পরে অবশ্য এ দুজনের জুটি ঢালিউডে বেশ জনপ্রিয় হয়। এই সিনেমায় রাজ্জাকের নায়িকা সুজাতা। ‘এতটুকু আশা’, ‘অবুঝ মন’ সিনেমার মতো হিট ছবি করে তখন তারা বেশ জনপ্রিয়। ঢালিউডের জনপ্রিয় তিন কৌতুক অভিনেতা রবিউল, হাসমত, সাইফুদ্দিনকে এখানে একসঙ্গে পাবে দর্শক। ছবিতে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া গান ‘এই পৃথিবীর পরে কত ফুল ফোটে আর ঝরে’ আজও জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

আলোর মিছিলের সফলতা
সিনেমাটি দর্শক দেখেছিল সেই সময়। পরিবেশক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিনও এক সাক্ষাৎকারে তথ্য দিয়েছিলেন, সেই বাজারে হিট হয়েছিলো ‘আলোর মিছিল’। তার দেওয়া তথ্যমতে, সেই সময়ে এ ছবির ব্যবসা হয়েছিল ২০-২৫ লাখ টাকার। নানা সূত্রে ধারণা পাওয়া যায়, ছবির নির্মাণ ব্যয় ছিল এক লাখ টাকার ওপরে।
‘আলোর মিছিল’ নিয়ে দুই নায়িকার মন্তব্য

সিনেমাটি নিয়ে নায়িকা সুজাতা এক গণমাধ্যমে বলেন, ‘আলোর মিছিল’-এর মতো সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে আমি খুব তৃপ্ত ছিলাম সেসময়। নারায়ণ ঘোষ মিতা বড় মাপের পরিচালক ছিলেন। বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এ ছবিতে অভিনয় করেন। আজিম সাহেবের পর রাজ্জাকের সঙ্গে আমার বেশ কিছু সিনেমা হিট হয়। ‘আলোর মিছিল’ও সেই রকম সফল একটি সিনেমা। ছবিতে আমার চরিত্রের নাম দিনা। মজুতদার বাবার বিরুদ্ধে আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করি। এ ছবিতে ববিতাও অভিনয় করেছে। দুই নায়িকা কাজ করলে নাকি প্রতিযোগিতা হয়, তেমন কিছুই ছিল না আমাদের মধ্যে। ও আমার জুনিয়র, শুটিংয়ের সময় তাই স্নেহই করতাম।

এদিকে ববিতা বলেন, রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে রোমান্টিক নায়িকা হিসেবে কিছু ছবি হিট করার পর ‘আলোর মিছিল’-এর অফার এলো। গল্পটা ‘আলো’ নামের এক মেয়েকে ঘিরে। সব ইমোশন তাকে নিয়ে, কিন্তু ছবিতে রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে রোমান্টিক পেয়ার হলেন সুজাতা ম্যাডাম। আমি গল্পে রাজ্জাক সাহেবের ভাগ্নি। আমাকে নিয়ে তখন ইন্ডাস্ট্রিতে যারা লগ্নি করছেন বা যারা আমার বন্ধু, সবাই চাইলেন আমি যেন ছবিটা ‘না’ করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুন্দর গল্প, সুন্দর চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছারই জয় হলো। নারায়ণ ঘোষ মিতা যখন সিকোয়েন্সগুলো অভিনয় করে দেখাতেন, বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠত। এ জন্যই এসব ছবি করার সময় গ্লিসারিন লাগত না। আমার একটা সংলাপ খুব জনপ্রিয় হয়েছে ‘চা গরম চা গরম।’ ক্লাসিক্যাল নাচ শিখতে হয়েছিল এ ছবির জন্য। দর্শক ছবিটা কিভাবে নেয় তা দেখার জন্য বোরকা পরে গিয়েছিলাম ‘মধুমিতা’য়। আলো যখন মারা যায়, দর্শকদের দেখেছি হাউমাউ করে কাঁদতে। যারা ছবিটি করতে মানা করেছিলেন তারা সবাই পরে আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। কারণ এ ছবির পরও রাজ্জাক ভাইয়ের সঙ্গে আমার রোমান্টিক ছবি হিট হয়েছে। অর্থাৎ দর্শক গল্প এবং চরিত্রই দেখে। সেই সময় এ ধরনের সিনেমাই করতে চেয়েছিলাম। পারিশ্রমিক নিয়ে ভাবতাম কম। অর্থই সব কিছু নয়। ‘আলোর মিছিল’ আমার প্রিয় সিনেমাগুলোর একটি।

একনজরে পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতা
নারায়ণ ঘোষ মিতা চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়া প্রযোজনা করেছেন, চিত্রনাট্য লিখেছেন ও কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রথম আয়োজনে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক ও পরিচালক বিভাগে পুরস্কার অর্জন করেন। নারায়ণ ঘোষ মিতার জন্ম ২২ ডিসেম্বর। তিনি ষাটের দশকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রবেশ করেন। ১৯৬৮ সালে পারিবারিক টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করেন ‘এতটুকু আশা’ চলচ্চিত্রটি। পরের বছর নির্মাণ করেন ‘নীল আকাশের নিচে’, যেখানে পারিবারিক বন্ধনকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তার নির্মিত ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪) চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম তুলে ধরেন। ১৯৭৫ সাল থেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান শুরু হলে তিনি ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম শ্রেষ্ঠ প্রযোজক ও পরিচালক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তার নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘অলংকার’, ‘হারানো সুর’, ‘সুখের সংসার’ উল্লেখযোগ্য। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলো হলো: ‘চাওয়া পাওয়া’ (১৯৬৭), ‘এতটুকু আশা’ (১৯৬৮), ‘নীল আকাশের নিচে’ (১৯৬৯), ‘দীপ নেভে নাই’ (১৯৭০), ‘ক খ গ ঘ ঙ’ (১৯৭০), ‘এরাও মানুষ হ’ (১৯৭২), ‘আলোর মিছিল’ (১৯৭৪), ‘লাঠিয়াল’ (১৯৭৫), ‘অলংকার’ (১৯৭৮), ‘হারানো সুর’ (১৯৮৭) ও ‘সুখের সংসার’ (১৯৮৯)।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × 1 =