আসিফের ‘নির্বাণ’ সিনেমার মস্কো জয়

সম্প্রতি আসিফ ইসলামের ‘নির্বাণ’ চলচ্চিত্রটি ৪৬তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি পুরস্কার লাভ করেছে। ২০১৮ সালে ফয়সাল রদ্দির সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেছিলেন ‘পাঠশালা’ নামের শিশুতোষ চলচ্চিত্র। ডিওপির দায়িত্ব পালন করেছিলেন সিনেমাটিতে। আসিফ ইসলামের নির্মাতা হয়ে ওঠা এবং  ‘নির্বাণ’ চলচ্চিত্রের অজানা কথা জানাচ্ছেন গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

আসিফ ইসলামের জন্ম ঢাকায়। শৈশব-কৈশোর কেটেছে ঢাকা আর লন্ডনে। অল্প বয়সে লন্ডনে চলে যান পরিবারের সাথে। ছোটবেলা থেকেই মা চাইতেন তার ছোট ছেলে গায়ক হোক। তিনি গানও শিখেছেন ছোটবেলায়। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আসিফ সবচেয়ে ছোট। বড় ভাই অভিনয় করেন। এখনো যুক্ত রয়েছেন অভিনয়ের সঙ্গে। লীসা গাজীর ‘বাড়ি নাম শাহানা’য় একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসিফ ইসলামের বড় ভাই। তার ভাইয়ের নাম আরিফ ইসলাম। ছোটবেলা থেকেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে থিয়েটারে যেতেন তিনি। তখন থেকেই মঞ্চে অভিনয় দেখার সুযোগ হতো। লন্ডনে চলে যাওয়ার পরও অভিনয় ছাড়েননি তার বড় ভাই। লন্ডনে বাঙালি কমিউনিটিতে প্রায় সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকতেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে থিয়েটারে গিয়ে লাইট কন্ট্রোল রুমে টুকটাক কাজ করতেন আসিফ ইসলাম। অনেক সময় মঞ্চ নাটকে স্বল্প সময়ের চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন। শনিবার ও রবিবার সাপ্তাহিক ছুটিতে নাটক অনুশীলন করতেন সকলে। লন্ডন বাংলাদেশ সেন্টারে ৯০ দশকে অনেক সময় কেটেছে বড় ভাইয়ের সঙ্গে। বড় ভাইয়ের সাথে থাকার ফলে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ হয় আসিফ ইসলামের।

ঢাকার খিলগাঁও সরকারি হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। তারপর পাড়ি জমান লন্ডনে। ইউনিভার্সিটি অফ হার্টফোর্ডশায়ার থেকে গ্রাফিক ডিজাইন এবং অ্যানিমেশনের ওপর স্নাতক সম্পন্ন করেন। মাস্টার্স সম্পন্ন করেন লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে অডিও ভিজ্যুয়াল প্রোডাকশনের ওপর। ২০০৬ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করার পর নানা ধরনের ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপন নির্মাণ শুরু করেন। আসিফ ইসলাম লন্ডনে যাওয়ার সাত-আট বছর পর বাংলাদেশে আসেন। মাস্টার্সের শেষবর্ষে একটি এসাইনমেন্ট করতে আসেন তিনি। একটি শর্ট ফিল্ম তৈরির এসাইনমেন্ট ছিল। তার নির্মিত ‘চামেলী’ নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি লন্ডনে সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়েছিল। এ প্রতিযোগিতা প্রতিবছর ব্রিটিশ ফিল্ম কাউন্সিল আয়োজন করে থাকে। আসিফ ইসলাম তখন অনুধাবন করেন চলচ্চিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে আসিফ ইসলামের পরিবার গ্রাফিকস ডিজাইন, অ্যানিমেশন, অডিও ভিজ্যুয়াল প্রোডাকশন নিয়ে পড়াশোনা করতে বাধা দেয়নি। যেখানে আজকের দিনেও অনেক পরিবার সন্তানদের এসব বিষয়ে পড়াশোনা করতে দিতে কার্পণ্য করে। আসিফ ইসলামের পরিবারের সহযোগিতা ছিল সবচেয়ে বেশি। আসিফের তিনজনের ছোট পরিবার। স্ত্রী-কন্যা ঢাকাতে থাকেন। তার স্ত্রী ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। তার মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। লন্ডন আসিফের সেকেন্ড হোম। সেখানে পরিবারের বাকি সদস্যরা থাকেন।

আসিফ ইসলাম নিজের রেডমার্ক প্রোডাকশন থেকে বিভিন্ন কোম্পানির জন্য ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে আসছেন। মূলত বিভিন্ন এনজিওর জন্য ডকুমেন্টারি তৈরি করে থাকেন তিনি। আসিফের এককভাবে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘নির্বাণ’। চলচ্চিত্রটি আলোচনায় আসে ৪৬তম মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে (এমআইএফফ) স্পেশাল জুরি পুরস্কার লাভ করার পর। চলচ্চিত্রটি এক কারখানার তিন কর্মীর যাপিত জীবনকে নিয়ে নির্মিত। সাদাকালোয় তাদের জীবনের নানা দিক পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন নির্মাতা। ২০২২ সালে সিনেমাটির কাজে হাত দেন আসিফ ইসলাম। ৮৫ মিনিট দৈর্ঘ্যরে ‘নির্বাণ’ চলচ্চিত্রটি সংলাপবিহীন। সিনেমার ভাষায় যাকে বলা হয় সাইলেন্ট ফিল্ম। আমরা সিনেমা মানেই ভেবে বসি লার্জার দ্যান লাইফ। আমরা মন স্থির করে পর্দায় সিনেমা দেখা শুরু করি। সিনেমাটিতে নির্মাতা বাস্তব জীবনের গল্প বলে গিয়েছেন ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ আর মিউজিকের সংমিশ্রণে। বাকিটা তিনি দর্শকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। দর্শকেরা সিনেমাটি নিজের মতো করে ভেবে নিবেন, এটাই তার ইচ্ছা। সিনেমাটি এক বছর ধরে নির্মিত হয়েছে। এখানে একটা কিন্তু রয়েছে, টানা শুটিং করেননি নির্মাতা। ধাপে ধাপে শুটিং হয়েছে সিনেমার। ঋতুরও একটা প্রভাব রয়েছে। শীতকালে গাজীপুরে এবং সুনামগঞ্জের হাওড়ে বর্ষাকালে শুটিং করা হয়।

গাজীপুরের একটা ট্রান্সফরমার ফ্যাক্টরিতে সিংহভাগ শুটিং করা হয়। সম্পূর্ণ ন্যাচারাল লাইটে শুটিং হয়। ‘নির্বাণ’ সিনেমার আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে একটা সিন ওয়ান টেকে শুট করা হয়েছে। শটে কোনো মুভমেন্ট নেই। আসিফ ইসলাম ১১৯টি স্টিল শট নিয়েছেন। সিনেমায় চারজন অভিনয়শিল্পী অভিনয় করেছেন; প্রিয়ম অর্চি, ফাতেমা তুজ জোহরা, ইমরান মাহাথির ও সতেজ চৌধুরী। চরিত্রের প্রয়োজনে এক মাস ফ্যাক্টরির মধ্যে ছিলেন তারা চারজন। চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাওয়ার জন্য সকলের সঙ্গে কাজ করতেন তারা। ম্যানেজমেন্ট ছাড়া এটা কেউ জানতো না। কিন্তু দুই সপ্তাহ না গড়াতেই সবাই জেনে যায়।

‘নির্বাণ’ সিনেমাটি নির্মাণ করতে আসিফ ইসলাম সঙ্গে পেয়েছেন লেখক ও সহপ্রযোজক আনোয়ার হোসেনকে। সিনেমাটি নির্মাণ করার সময় অভিনয়শিল্পী ছাড়া সেটে আর কেউ ছিল না। দিনরাত খেটে সিনেমাটি তৈরি করেছেন পরিচালক আর লেখক। সেট ডিজাইন নিজেরাই করেছেন। অভিনয়শিল্পীরা সকলে নিজের সিন করার পর সহকারী পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেছেন অধিকাংশ সময়। দুইটি দৃশ্য বাদে কোনো মেকআপ আর্টিস্ট ছিল না শুটিং সেটে। অভিনয়শিল্পীরা নিজেরাই সেরেছেন নিজেদের মেকআপ। চাঁদনি চক, গাউছিয়া থেকে ড্রেস কিনে কস্টিউম ডিজাইন করেছেন ডিরেক্টর নিজেই। সিনেমার এডিটিংও করেছেন পরিচালক নিজে। ব্ল্যাক ম্যাজিক ক্যামেরায় শুট করা হয় সিনেমার।

শুধু একটি আইডিয়া থেকে ‘নির্বাণ’ সিনেমার কাজ শুরু করেন পরিচালক ও লেখক। শুরুতে সিনেমার চিত্রনাট্য ছিল তিন পাতার। সেখানে বুলেট পয়েন্টগুলো টুকে রাখেন তারা। কিন্তু গল্পের পরিসর ছিল বড়। যে কারণে এক বছর ধরে চলে সিনেমার শুটিং। ধাপে ধাপে বেড়েছে চিত্রনাট্যের পাতা। সময়ের সঙ্গে সিনেমায় অনেক কিছু যোগ হয়। মূলত গাজীপুরের লোকেশন ঠিক হওয়ার পর সিনেমার গল্প সাজানো হয়। বলা যায় লোকেশন থেকে বেইজড করে সিনেমা। সম্পূর্ণ সিনেমাটি তৈরি করতে সময় লেগেছে পাক্কা এক বছর। একবছর সময় গিয়েছে সিনেমার শুটিং করতে।

নির্মাতা আসিফ ইসলাম জানান, আমাদের সিনেমাটি সংলাপ বিহীন সেহেতু মিউজিক নিয়ে অনেক ভাবতে হয়। ভিজ্যুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজটা শক্তিশালী করার জন্য পারফেক্ট একটা মিউজিক প্রয়োজন ছিল। সিনেমার সাউন্ড ডিজাইন করার জন্য ঢাকার বেশকিছু জায়গায় চেষ্টা করেছেন কিন্তু যেটা প্রয়োজন ছিল তা কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারেননি। ‘নির্বাণ’ সিনেমার মিউজিক করেছেন কলকাতার সুকান্ত মজুমদার। আসিফ বলেন, সিনেমায় যেহেতু সংলাপ নেই। আমরা চেষ্টা করেছি পোয়েট্রির একটা আবহ তৈরি করার। কিন্তু আমরা যখন সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম তিনি তখন মাত্র সত্যজিৎ রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের সাউন্ড ডিপার্টমেন্টের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি কাজটা করতে পারবেন তবে সময় লাগবে। আমরা অপেক্ষা করলাম। তিনি প্রথমবারে যেটা আমাদের করে পাঠালেন সেটাতেই আমরা ভীষণ খুশি হয়ে যাই। তখন মনে হচ্ছিল এত সুন্দর মিউজিক হয়েছে আমরা আবার কয়েকটা সিন শুট করে আসি। আমাদের ৬ মাসের একটা জার্নি ছিল সাউন্ড ডিজাইন নিয়ে। সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করেছেন আমার এক বন্ধু। চেলো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেই ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করা হয়। এটি করেন বেন রবার্টস নামের ইংল্যান্ডের একজন আর্টিস্ট। তারপর এডিট করার পর সম্পূর্ণ রূপ ধারণ করে।

রিয়ালিটি থেকে বের হয়ে পিসফুল একটা জার্নি দেখানোর চেষ্টা করেছেন নির্মাতা। ১৯ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ৪৬তম মস্কো আন্তজার্তিক চলচ্চিত্র উৎসব। ‘নির্বাণ’ চলচ্চিত্রটি ২২ এপ্রিল উৎসবে প্রদর্শিত হয়। নির্মাতা জানান, আমার সিনেমার কমার্শিয়াল ভ্যালু কম। সেহেতু সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা না করে ফেস্টিভ্যাল কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা করেছিলাম। সেজন্য মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে জমা দেওয়া। এখানে পুরস্কার অর্জনের পর বিশ্বের অনেকগুলো ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এছাড়াও আমরা অনেকগুলো ফেস্টিভ্যালে জমা দিচ্ছি সিনেমাটি। সিনেমাটি নিয়ে বিশ্বের আরো কিছু ফেস্টিভ্যালে ঘুরে দেখতে চাই। আগামী বছর ঢাকা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সিনেমাটি বাংলাদেশের দর্শকদের দেখানোর ইচ্ছা আছে। এছাড়া ২০২৫ সালের শেষের দিকে ওটিটি প্লাটফর্মে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করছি। আমার মনে হয় এই সিনেমা পুরস্কার পেয়েছে এটা আসলেই আশার আলো। ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার যারা তার আমার অর্জনে সাহস পাবেন সিনেমা বানানোর। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। আসিফ ইসলাম নতুন সিনেমা নিয়েও পরিকল্পনা করছেন। বেজড অন ট্রু স্টোরি নিয়ে কাজ করছেন তিনি। সবকিছু ঠিক করে নিজের দ্বিতীয় ফিচার ফিল্মের ঘোষণা দিবেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

14 − 4 =