ইতিহাস খুঁজতেই যাবেন ময়নামতি 

নিবিড় চৌধুরী

শুরুতেই একটু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করা যাক। ২০১১ সালে থেকে ময়নামতি দেখার উদ্দেশ্যে আমরা চার বন্ধু চট্টগ্রাম থেকে সকাল সকাল রওনা দিলাম বটে তবে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভর দুপুর। সময় লাগার কথা ঘণ্টা চারেক। কিন্তু জ্যামের কারণে অতিরিক্ত তিন ঘণ্টা গাড়িতে বসেই কাটাতে হয়েছিল। আর গাড়ির ভেতরে সে কী গরম! গ্রীষ্মকাল ছিল কী! ঠিক খেয়াল নেই। তবে এটুকু মনে আছে, সন্ধ্যায়  ফেরার সময় গাড়ি পাচ্ছিলাম না। এই ভ্রমণ মনে থাকার কারণ, প্রথমবার কুমিল্লা গিয়েছি বলেই নয়; মনে আছে কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডারের জন্য। কুমিল্লায় এসেছি আর মাতৃভাণ্ডারের মিষ্টি খাবো না, সে কী হয়! কিন্তু যেখানেই যাচ্ছি না কেন, দেখি সব মিষ্টির দোকানের নামই মাতৃভাণ্ডার! কোনটি আসল, কোনটি নকল সে তো পরে জানলাম। এরপর অবশ্য অনেক বছর কুমিল্লার ওপর দিয়ে, মাতৃভাণ্ডারের সাইনবোর্ড পড়ে পড়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে গিয়েছি। আর যখনই গাড়ি কুমিল্লায় থামে, আমার ওই ঘটনায় মনে পড়ে।

অনেক বছর পর আবারও কুমিল্লা যাওয়া হলো, এই তো কিছুদিন আগে। প্রিয় ভ্রমণকাহিনী লেখক মঈনুস সুলতান, ফারুক মঈনদ্দিন, অণু তারেক, ফাতিমা জাহানের বই পড়ে নেশাটা হয়েছে এমন, দু’একদিন ছুটি পেলেই হাতের কাছে গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা নিয়ে কোথাও বেরিয়ে পড়া। সেই ভ্রমণের অংশ হিসেবে ঢাকা থেকে গেলাম কুমিল্লা। উদ্দেশ্য পুরোনো স্মৃতিটা ঝালিয়ে নেওয়া আর হাজার বছরের বাঙালির ইতিহাসের রূপ, রসের গন্ধ নেওয়া। সেক্ষেত্রে দেশে ময়নামতির চেয়ে উপযুক্ত স্থান আর কী হতে পারে!

যাত্রা শুরু

ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। ঘণ্টা দুয়েক। সময়ের একটু এদিক-ওদিক তো হবেই। ট্রেন ও বাস, দু’ভাবেই যাওয়া যায়। আমি অবশ্য রওনা দিলাম বাসে। সকালে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে উঠে পড়লাম একটি বাসে। বাস ছাড়তেই কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়েও পড়লাম। ভেবেছিলাম, পাশের সিটে কোনো তরুণী বসলে তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেবো। কিন্তু হলো উল্টো। এক বুড়ো ভদ্র লোক আমার পাশের সিটে। ঘুমের মধ্যেও তার জর্দা দিয়ে পান চিবানোর সুবাস আমার নাকেও ঢুকে পড়েছে। এ-ও টের পেলাম, ঘুমে কাত হওয়া আমার মাথা বেশ কয়েকবার ঠেলে তার কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।

এমন কোনো বাঙালি নেই বোধহয়, যিনি গাড়িতে ভ্রমণের সময় অন্যের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমায়নি বা সহযাত্রীর মাথাটি ঠেলে সরিয়ে দেয়নি। সেই বিবেচনায় আমার ক্ষুদ্র অপরাধটি নিয়ে কুমিল্লা শহরে নামলাম পূর্বাহ্নে, যখন ঘড়ির কাঁটা ১২ ছুঁই ছুঁই। তারপর হালকা চা-নাস্তা সেরে কোর্টবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে রওনা দিলাম শালবন বিহারের দিকে। অটোতে যেতে বেশিক্ষণ লাগে না। মাত্র ৩ কিলোমিটারের দূরত্ব।

ইতিহাস কথা বলে

বিখ্যাত গবেষক গোলাম মুরশিদ ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইয়ে জানিয়েছেন, বাঙালির সংস্কৃতি হাজার বছরের বেশি নয়। সেই হাজার বছর পেরিয়ে এসে আমরা আজকের অবস্থানে। একটি জাতির গড়ে উঠতে হাজার বছর লেগে যায়। সেই তুলনায় ড. মুরশিদের কথার যুক্তি আছে। তাই বলে কি এখানে বাঙালি ছিল না আগে, এই বঙ্গে? ছিল। তবে তারা ছিল ভিন্ন জাতের, ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন ধর্মের। কেউ ছিল বৌদ্ধ, কেউ হিন্দু, কেউ দ্রাবিড় গোষ্ঠীর। বাঙালি জাতি হিসেবে তখনও গড়ে উঠেনি। বাঙালি ভাষানির্ভর জাতি। সেই ভাষার অতীত নির্দশন চর্যাপদ। সেই চর্যাপদ লিখিত হয়েছিল সপ্তম শতাব্দীতে। মতান্তরে ভিন্নতাও আছে।

বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যের অনেক কিছু আজ হারিয়ে গেছে। কিছু গুপ্ত সাম্রাজ্যের মতো লুপ্ত হয়েছে, আর কিছু আমাদের অজ্ঞানতার কারণে ধ্বংস করেছি। সেই ধ্বংসের মাঝেও গর্ব করার মতো জাগ্রত হয়ে আছে কালের সাক্ষী ময়নামতি। এক সময় বাংলার তো বটে, উপমহাদেশের অন্যতম স্থান ছিল এটি। ছোট ছোট সবুজ পাহাড়, সেই পাহাড়ে ঘরের মতো খোপ। ওসব খোপ নয়, বৌদ্ধদের শাস্ত্র ও ধর্মীয় আবাস ছিল একসময়, যা বিহার নামে পরিচিত। শালবন বিহার তার একটি। আর পাহাড়ের নাম লালমাই।

এসব পাহাড়ের কক্ষ দেখে আপনার মনে পড়বে চর্যাপদের সেই বিখ্যাত পঙ্তি, ‘টালত মোর ঘর নাহি পরবেশী/হাড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী’। ময়নামতির পাহাড়গুলোকে টিলা বলা যায় না। এই কথার সঙ্গেও তার কোনো যোগসূত্র নেই। তবে গূঢ় অর্থের কথা চিন্তা করলে কতকিছুই তো মনে হতে পারে। চর্যাপদের সেই পঙতি বাংলাটা এমন, ‘টিলায় আমার ঘর, কোনো প্রতিবেশি নেই/হাঁড়িতে ভাত নেই, তবু প্রতিনিয়ত অতিথি আসে’। ময়নামতির সুবর্ণ ইতিহাস মাটি চাপা পড়লেও সেটি দেখতে নিয়মিত অতিথি আসে।

এক সময় এই লালমাই-ময়নামতি ছিল প্রাচীন বাংলার সমতটের অংশ। যার বিস্তৃতি ছিল সিলেট হয়ে ভারতে। এই সমতটের বিখ্যাত সংগীতশিল্পী শচীনদেব বর্মণ, যিনি পরে ভারতের ত্রিপুরায় চলে যান। এমন আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির জন্মস্থান এখানে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, এই সমতট প্রাচীনকাল থেকে ছিল সমৃদ্ধ নগরী। খ্রিষ্টাব্দের কয়েকশ বছর পর থেকে বেশ কয়েকটি রাজবংশের শাসনের হদিস পাওয়া যায় এখানে। গুপ্ত বংশ (৩২০-৫৫০), গোপচন্দ্র বংশ, ভদ্র বংশ, নাথ বংশ, খড়্গ বংশ (৬২৫-৭০৫), রাত বংশ (৬৪০-৬৭০), দেব বংশ (৭২০-৮০০), চন্দ্র বংশ (৮৬৫-১০৫৫), পাল বংশ (৭৫৬-১১৬২), বর্মণ বংশ (১০৫৫-১১৪৫) ও  সেন বংশ (১০৯৭-১২৫০)।

তার মধ্যে গুপ্ত বংশ, পাল বংশ ও সেন বংশ ক্ষমতায় ছিলেন লম্বা সময় ধরে। তাদের প্রতিপত্তিও ছিল বেশি। ধারণা করা হয়, পাল বংশের সময়ে ময়নামতিতে বৌদ্ধদের বিকাশ শুরু। এখানে সে সময় মঠে মঠে চর্চা হতো ধ্যান, জ্ঞানের। লক্ষণ সেনের শাসনের সময় ১২ শতকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি এসে বাংলা দখল নেন। ১৩ শতকের শেষ দিকে বঙ্গ ও হরিকেল জনপদের সঙ্গে এ অঞ্চলও মুসলিম শাসনের অধীনে আসে। পরবর্তী এ অঞ্চল ত্রিপুরা রাজাদের অধীনে চলে আসে। ১৭৬৫ সালে এটি ব্রিটিশ ভারতের অধিভুক্ত হয় ও ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলার সঙ্গে একীভূত হয়। পাকিস্তান আমলে ১৯৬০ সালে নাম পাল্টে হয় কুমিল্লা।

মুসলিম শাসনের অধীনে আসার আগেই অবশ্য ময়নামতি গুরুত্ব হারায়। ১১ শতকে সমতটের রাজধানী বিক্রমপুরে (বর্তমানে মুন্সীগঞ্জে) স্থানান্তর করা হলে এর গুরুত্ব কমতে থাকে। এরপর ১২ শতকে সেন শাসনের দখলে যাওয়ার পর এবং পরবর্তীতে মুসলিম শাসনে আসার পর এখানকার মানুষজন নিরাপত্তার খোঁজে বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়। বিশেষ করে ভারতে। অন্তরালে চলে যায় এখানকার আগের বৌদ্ধ ও হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় স্থাপনা, মঠ, মন্দির, বিদ্যাপীঠ। বিশাল ও সমৃদ্ধ জনপদটি চাপা পড়ে যায় মাটিতে। তার ওপর দিয়ে গড়ে উঠে জঙ্গল। সেই জঙ্গলের একটি শালবন।

শুধু শালবন বিহার নয়। খননের ফলে আবিষ্কৃত হয় ভবদেব বিহার, আনন্দ বিহার, রূপবান মুড়া, কুটিলা মুড়াসহ আরও বেশ কয়েকটি স্থাপনা। ১৮৫৭ সালে রাস্তা খনন করার কালে আবিষ্কৃত হতে থাকে ময়নামতির ইতিহাসের এসব মণি-মুক্তা। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এসব স্থান থেকে পাওয়া যায় আটটি তাম্রলিপি, প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক, সিলমোহর, ব্রৌঞ্জ ও মাটির বুদ্ধ ও বিষ্ণুমূর্তি। অন্যান্য মূর্তিও পাওয়া গেছে ঢের। ওসব রাখা আছে ময়নামতি জাদুঘরে। মহামূল্যবান এসবকিছু দেখতে আপনাকে ঢুঁ মারতে হবে সেখানে, টিকিট কেটে।

যদি আরও খননকার্য চালানো হয় তবে এমন আরও অনেক কিছু বেরিয়ে আসতে পারে। আবিষ্কৃত হতে পারে নতুন নতুন স্থাপনাও, বাংলার এক সময়ের সমৃদ্ধ রূপ।

এই ময়নামতি নামটি নিয়েও আছে অনেক জনশ্রুতি। সমতটের এক সময়ের শাসক ছিলেন চন্দ্রবংশের রাজা মানিক চন্দ্র। অনেকে মনে করেন, তার রূপবতী-গুণবতী স্ত্রী ময়নামতির নামে নামাঙ্কিত হয়েছে ময়নামতি।

সেই ইতিহাস স্বচক্ষে দেখতে হাতে একদিন সময় নিয়েই আপনি ঘুরে আসতে পারেন ময়নামতি থেকে। আবিষ্কৃত বিহারের পাশাপাশি দেখে নেবেন ‘ময়নামতি ওয়্যার সিমেট্রি’ও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হাজারো শহীদ শুয়ে আছেন এখানে। এমন ইতিহাসসমৃদ্ধ স্থানে যাওয়া মানে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: কোথায় কি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × five =