এশিয়ার প্রথম ‘চিফ হিট অফিসার’ বুশরা আফরিন

‘আমার বাড়ি ঢাকায়। তবে শহরটা যেন এখন অচেনা লাগে। কারণ, অসহ্য গরম,’ কথাগুলো যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ইনডিপেনডেন্টকে বলছিলেন বুশরা আফরিন। যিনি ঢাকার ‘চিফ হিট অফিসার’–এর দায়িত্ব পেয়েছেন।

বুশরা আফরিনের বেড়ে ওঠা ঢাকাতেই। তিনি বলেছেন, ছেলেবেলায় শুনতেন, পড়াশোনা বা কাজের খোঁজে অনেকেই রাজধানী শহর ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। এখনো অনেকে যাচ্ছেন। তাদের একাংশের কারণটা ভিন্ন, ঢাকার দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়া।

গত মাসে ভয়াবহ তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে বাংলাদেশ। কয়েকটি জেলায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। ঢাকার তাপমাত্রার পারদ চড়ে সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। রাজধানীতে এটা ছিল গত ছয় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশকে প্রায় প্রতিবছরই এমন তাপপ্রবাহের কবলে পড়তে যাচ্ছে।

এমনই এক সংকটের মধ্যে বুধবার বুশরা আফরিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘চিফ হিট অফিসার’-এর দায়িত্ব পেয়েছেন। এশিয়ায় প্রথম চিফ হিট অফিসারও তিনি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামি, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন, গ্রিসের এথেন্স, চিলির সান্তিয়াগো, মেক্সিকোর মনট্রে ও অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে চিফ হিট অফিসার রয়েছেন। বুশরার মতো তারা সবাই নারী।

পদটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার। লক্ষ্য, ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষকে চরম তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করা। তবে একটি শহরে শুধু তাপমাত্রার কারণেই চিফ হিট অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয় না। বিভিন্ন উদ্ভাবনী সমাধানের প্রতি ওই শহরের মেয়র ও স্থানীয় সরকারের আগ্রহের বিষয়টাও দেখা হয়।

নিজ শহরে তাপমাত্রা কমানোর পরিকল্পনা করেন ওই শহরের চিফ হিট অফিসার। ঢাকায় এ দায়িত্ব বুশরা আফরিনের। কাজটি অন্য শহরের চিফ হিট অফিসারদের থেকে শিখতে আগ্রহী তিনি। বললেন, ‘আমি আসলেই তাদের কাছ থেকে জানতে এবং তাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। তাদের অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমি নিশ্চিত, সেগুলো আমাকে আরও ভালোভাবে কাজ করতে সাহায্য করবে।’

চিফ হিট অফিসার পদে কেন শুধু নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তা জানালেন অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের পরিচালক ক্যাথি বাগম্যান ম্যাকলর্ড। চিফ হিট অফিসার প্রকল্পের পরিকল্পনাটা এসেছে তাঁর মাথা থেকেই। তিনি বলেন, এই পদে শুধু নারীদের নির্বাচিত করা হয়। কারণ, চরম তাপমাত্রার বড় শিকার নারী ও মেয়েশিশুরা।

২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বে উষ্ণ দিনের সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর বড় বোঝা চাপবে নারী ও মেয়েশিশুদের ঘাড়ে। চরম তাপমাত্রার প্রভাব শুধু নারীদের শরীরের ওপরই পড়বে না, তাদের বড় একটি অংশ যে কাজের সঙ্গে জড়িত, যেমন গৃহস্থালির কাজ, শিশু ও বৃদ্ধদের দেখভাল করা, তার ওপরও পড়বে।

দরিদ্র দেশগুলোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর জলবায়ু ও পরিবেশগত বড় হুমকির মুখে রয়েছে। ২ কোটি ২০ লাখের বেশি জনসংখ্যা নিয়ে ঢাকা এই শহরগুলোর তালিকায় পড়ে। দিন দিন বাড়তে থাকা জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে সংকটে পড়া ঢাকার তাপমাত্রা গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বুশরা জানালেন, প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি মানুষ ঢাকায় আসছেন বাস করতে। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে তারা বিভিন্ন বস্তিতে থাকছেন। এই বস্তিগুলোয় পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ও খাওয়ার পানির ঘাটতি রয়েছে। আর সেখানকার ঘরগুলো তৈরি ধাতু দিয়ে। গরমে সেগুলো ভয়াবহ আকার ধারণ করে। চুলার মতো হয়ে যায়। সরবরাহ লাইন দিয়ে আসা খাওয়ার পানিও প্রচণ্ড গরম হয়ে থাকে।

ক্যাথি বাগম্যান ম্যাকলর্ড ইনডিপেনডেন্টকে বলেন , গরম কমাতে দীর্ঘ মেয়াদে অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে সময় লাগবে। চিফ হিট অফিসারদের প্রথম অগ্রাধিকার হলো জনসচেতনতা বাড়ানো। এটাই শহরগুলোতে উষ্ণতা থেকে জীবন বাঁচানোর জন্য সবচেয়ে দ্রুত সমাধান।

চলতি গ্রীষ্মকালে এ কাজই করছেন বুশরা আফরিন। ঢাকায় জনসচেতনতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছেন। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের কাছে দ্রুত পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছেন তিনি। বুশরা বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে গেলে, কাজ করার এটাই উপযুক্ত সময়। সবাই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শুধু আমার মেয়ের জন্য নয়; বরং সব শিশুর জন্য শীতল ও আরও সমতার একটি ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে চাই।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

two × 5 =