ইরানী বিশ্বাস
বর্তমান সমাজে নারী উত্যক্তকরণ অর্থাৎ ইভ টিজিং একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ‘ইভ টিজিং’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নারীদের উত্যক্ত করা। ইভ টিজিং কথাটি বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি বা কিছু মেয়ে স্কুলে যাওয়া আসার পথে কিছু বখাটে ছেলে তাদের দেখে অশালীন মন্তব্য করছে বা শিস দিচ্ছে। শুধু শিক্ষার্থী নয়, অফিসে নারী সহকর্মীকে হেয় করে কিছু বলাও ইভ টিজিং। নারী শিক্ষার্থীকে তুচ্ছজ্ঞানে বা অবহেলা করে পুরুষ শিক্ষকের কিছু বলাও ইভ টিজিং। জীবনে একদিনও ইভ টিজিংয়ের শিকার হননি এমন মেয়ে বাংলাদেশে পাওয়া বিরল। ইভ টিজিং মূলত একটি শক্তির খেলা। কারণ সামাজিকভাবে নারীকে দুর্বল মনে করা হয়। আর পুরুষ নিজেকে শক্তিশালী মনে করে। একটি মেয়ে যখন বাড়ি এসে ইভ টিজিংয়ের কথা বলে তখন তাকে প্রথমেই বলা হয়, ‘নিশ্চয়ই তুমি কিছু করেছো, তা না হলে ছেলেরা এমনি এমনি এমন করে না।’ আবার একটি ছেলে যখন ইভ টিজিং করতে গিয়ে ধরা পড়ে তখন সমাজ মেয়েটার পোশাক, চাল-চলন নিয়ে প্রশ্ন তোলে। সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে, যে কোনোভাবে যদি নারীর চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা যায়; তাহলে তাকে সহজেই দমন করা সম্ভব। এভাবেই পুরুষতন্ত্রকে পক্ষপাতিত্ব করা হয়।
বর্তমানে ইভ টিজিং একটি দুষ্টু ক্ষত হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের হাজারো সমস্যা ছাপিয়ে ইভ টিজিং এখন অন্যতম প্রধান সমস্যার। ভয়ংকর এ সমস্যার হিংস্র থাবার ক্ষত-বিক্ষত ও অপমানের দহনে জ্বলতে থাকা বহু কিশোরী তরুণী আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। ইভ টিজিংয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটেদের হাতে জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষক, মমতাময়ী মা ও অভিভাবকের মৃত্যুতে সৃষ্টি হয়েছে গভীর উদ্বেগ। দেশে যখন ভয়াবহ আকারে ইভ টিজিং ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৩ জুন ‘ইভ টিজিং প্রতিরোধ’ দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণা করা হয়। ইভ টিজিং রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিকভাবে স্বীকৃত একটি অপরাধ।
নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ক্রমশ ইভ টিজাররা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। রাস্তা-ঘাটে নারীদের প্রতি অশালীন মন্তব্য, বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করা, গোপন অঙ্গ প্রদর্শন, বিকৃত নামে ডাকা, উপহাস করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়ে দাঁড়িয়েছে। যা ক্রমশ সমাজের একটি কঠিন অসুখে পরিণত হয়েছে।
নারী-পুরুষ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজ এগিয়ে যায় দুজনের সহযোগিতায়। অথচ প্রতিনিয়ত পুরুষ দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে নারী। প্রতিনিয়ত তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে অপদস্ত হচ্ছে। শুধু নারী নয় ইভ টিজিংয়ের থাবা থেকে মুক্তি পাচ্ছে না ছোট্ট শিশু থেকে বয়স্ক নারীও। পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতি ও আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ভুক্তভোগীদের প্রতিবাদে অনীহা, বইবিমুখ, প্রযুক্তির অপপ্রভাব, বিনোদনে অশ্লীলতাসহ অনেক কারণে যৌন হয়রানিকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। এছাড়া দেশে নারীরা অর্থিকভাবে পুরোপুরি স্বচ্ছল নয়। তাই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবে নারীকে হেয় করা যেন প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কর্মক্ষেত্রে ইভ টিজিংয়ের শিকার হতে হয় এদেশের অধিকাংশ নারীকে। বিশেষ করে পোশাকশ্রমিক নারীরা সবচেয়ে বেশি এর শিকার হচ্ছে। ইভ টিজিংয়ের ভয়াবহ কালো থাবা থেকে নারী সমাজকে রক্ষা করা জরুরি। এ জন্য কঠিন, কঠোর আইনের মাধ্যমে এসব ইভ টিজারদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অনেক সময় ইভ টিজারদের চিহ্নিত করা গেলেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভয়াবহ কুফল, ক্ষমতার প্রভাব, রাজনৈতিক জটিলতার কারণে আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন পরিলক্ষিত হয় না। ফলে নারীদের প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হতে হয়।
ইভ টিজিং থেকে মুক্তি পেতে নারী-পুরুষ উভয়েরই সোচ্চার হওয়া জরুরি। এজন্য প্রথমেই নারীর অধিকার আদায়ে সচেতন হতে হবে। নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে প্রাপ্ত সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে। উত্যক্তকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। ইভ টিজিং ভারতে ৬০-এর দশকে প্রথম গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৭০-দশকে অধিকসংখ্যক মেয়েরা পুরুষের সাহচর্য ছাড়া বিদ্যালয়ে ও কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত করতে থাকে। এভাবেই ভারতে ইভ টিজিংয়ের মাত্রা কমতে থাকে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও রয়েছে ইভ টিজিং বা সেক্সুয়াল হেরাসমেন্ট। সেক্সুয়াল হেরাসমেন্ট শব্দটি আমেরিকায় প্রথম পরিচিত পায় ১৭৭৫ সালে। মুসলিম প্রধান দেশের রাজনীতিবিদ বা নীতিনির্ধারকগণ তা বুঝতে অনেক সময় নিয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ‘ইভ টিজিং’ শব্দটি পরিবর্তন করে ‘ওমেন টিজিং’ নামে একে সংজ্ঞায়িত করেছিল। নানাবিধ কারণে সমাজে ইভ টিজিংয়ের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো; নারীকে পণ্য ও ভোগবস্তু হিসেবে মনে করা এবং পরবর্তীতে ব্যবহার করা। নারীর পোশাক ও চলাফেরার প্রতি উগ্র দৃষ্টিভক্তি। মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা। স্যাটেলাইট টিভির অবাধ ও অনিয়ন্ত্রিত প্রদর্শন। সুস্থ সংস্কৃতির চর্চার অভাব। পারিবারিক শিক্ষার অভাব। অসৎ সঙ্গ, মাদকাসক্তি, বেকারত্ব ও অশিক্ষা। লিঙ্গ বৈষম্যমূলক সামাজিক ব্যবস্থাপনা। শিক্ষাব্যবস্থায় সুস্থ চরিত্র গঠন উপযোগী শিক্ষা বাস্তবায়ন না হওয়া। সুনির্দিষ্ট আইনের প্রয়োগ না থাকা ইত্যাদি।
ইভ টিজিং নিয়ে বাংলাদেশের আইন খুব শক্তিশালী নয়। এখানে পেনাল কোড ৫০৯-এ শুধু বলা আছে, কোনো নারীর শালীনতা ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যে; কোনো শব্দ উচ্চারণ, আওয়াজ বা অঙ্গভঙ্গি করা বা কোনো কিছু প্রদর্শন করে এটা জেনে যে উক্ত নারী সেই শব্দ, আওয়াজ শুনবেন বা উক্ত নারী সেই অঙ্গভঙ্গি দেখবেন বা তা উক্ত নারীর গোপনীয়তায় আঘাত হানবে, সেক্ষেত্রে তিনি সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনের এই ধারায় ইভ টিজারকে শাস্তির আওতায় আনতে একজন নারীকে অনেক বাধা পার করতে হবে। সমাজ উল্টো তার উপর দায় চাপিয়ে দেবে। অনেক ক্ষেত্রেই এইসব আইনের মারপ্যাঁচ ছাড়ানোর আগে তাকে শক্তি খরচ করতে হবে সামাজিক শৃঙ্খল ছিঁড়তে। এরপরেও যদি ধরে নেওয়া হয়, অপরাধীর শাস্তি হবে, তাহলে কে বলতে পারবে এ সমাজে শক্তিশালী পুরুষ এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করে এসে সেই নারীর জীবন ধ্বংস করে দেবে না!
ইভ টিজিংয়ের ভয়াবহ ছোবল থেকে সমাজকে রক্ষা করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে প্রতিটি পরিবার। কারণ পরিবার থেকেই ভালো-মন্দের পার্থক্য বা নৈতিক শিক্ষার প্রাথমিক ধারনা পেয়ে থাকে। ছোট থেকেই নৈতিক শিক্ষায় দীক্ষিত করতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষকগণও ইভ টিজিং রোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। এখনই ইভ টিজিং রোধ করতে না পারলে একসময় তা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এসিড সন্ত্রাস, ধর্ষণ, হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ বেড়ে যাবে। সমাজে শুধুমাত্র নারীর কারণেই ইভ টিজিং হয়; এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে পুরুষের পাশাপাশি নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অথচ নারীর স্বকীয়তা বিকাশে এবং সফলতার পথে অনেক ক্ষেত্রেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় ইভ টিজিং। অনেক সম্ভাবনাময়ী নারী ঝরে যাচ্ছে শিশু এবং কিশোরী বয়সেই। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিয়ে ইভ টিজিং প্রতিরোধ করা উচিত। তা না হলে আগামীতে আরো কঠিন-কঠোর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ