নাহিন আশরাফ
মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট কাঁচা বাজারের কাছে তাজমহল রোডে অবস্থিত এই ‘মাজা রেস্টুরেন্ট’ ২০১০ সালে ২৭ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে। রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করতেই এক অন্য অনুভূতি ছুঁয়ে যাবে। মজাদার খাবারের ঘ্রাণে কিছুক্ষণের জন্য আপনি হারিয়ে যাবেন। ভেতরে রয়েছে দুটি রুম ও একটি বারান্দা। যেখানে বসে আপনি খাবার উপভোগ করতে পারবেন। রুমগুলোর কিন্তু রয়েছে আবার ভিন্ন সব নাম। একটির নাম রবার্ট ফ্রস্ট, আরেকটির নাম লালন সাঁই। এমন নাম যে কাউকেই চমৎকৃত করবে। মাজা রেস্টুরেন্টে প্রতি বেলায় মেন্যুতে আনা হয় পরিবর্তন। যেমন সকালে পাওয়া যাবে পরোটা, তান্দুরি পরোটা, রুটি, মিক্স সবজি, মুগ ডাল, বুটের ডাল, খাসির পায়া, খাসির কলিজা, চিকেন সুপ, ভুনা খিচুড়ি, বিফ খিচুড়ি ও চা। চা বানানোর জন্য রয়েছে আলাদা দুজন কারিগর। সকালের নাস্তা পাওয়া যাবে সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা।
এরপর থেকে শুরু হবে দুপুরের খাবারের মেন্যু। কাচ্চি, চিকেন খিচুড়ি, বাসমতি চালের ভাত, যে কোনো প্রকার শাক, টাকি মাছ, চিংড়ি, বেগুন, টমেটো ভর্তা, শুটকি ভুনা, করলা ভাজি, মলা মাছ, রুই মাছ। দুপুরের খাবার পাওয়া যাবে বিকাল ৪টা অবধি। বিকালে থাকবে নানা পদের কাবাব। চিকেন বটি, মাসালা চিকেন, চিকেন গ্রিল, চিকেন বারবিকিউ ইত্যাদি। মোহাম্মদপুরে তাদের কাবারের বেশ নামডাক রয়েছে। কাবাবের সাথে রয়েছে স্পেশাল একটি সালাদ; যা শসা, টমেটো, গাজর, ধনেপাতা, বরইসহ নানা উপকরণ দিয়ে করা হয়ে থাকে। কাবারের সাথে সালাদটি যেন আরো জমে যায়। এছাড়া রাতে পাওয়া যায় স্পেশাল পরোটা, বাটার নান, কাচ্চি, মোরগ পোলাও ইত্যাদি।
রেস্টুরেন্টে ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। রেস্টুরেন্টের নকশা ও খাবারের মেন্যু সব কিছুই বাঙালির ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দিবে। এই রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশন করা হয় কাসার প্লেট, গ্লাস, বাটি ও চামচে। যা যে কারো নজর কাড়বে। এতো গেল রেস্টুরেন্টের খাবার ও সাজসজ্জার কথা। কিন্তু এমন এক ভিন্নধর্মী রেস্টুরেন্টের পেছনে কারা কাজ করছেন তাদের কথা শোনা যাক।
রেস্টুরেন্টের প্রতিষ্ঠাতা জেরিয়া হাসনাইন ইরমা নিজেই এটি দেখাশোনা করছেন। ২০১০ সালে তার বাবা এই ‘মাজার রেস্টুরেন্ট’ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাবার পর জেরিয়া হাসনাইন ইরমাই এখন দায়িত্ব পালন করছেন, আগলে রেখেছেন বাবার প্রিয় রেস্টুরেন্টে। জেরিয়ার বাবা লন্ডনের একটি রেস্টুরেন্টে কর্মরত ছিলেন। মূলত সেই রেস্টুরেন্টে কাজ করতে করতেই তার ইচ্ছে হয় নিজের একটি রেস্টুরেন্ট শুরু করবার। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজ লাগিয়ে তিনি মাজা রেস্টুরেন্ট শুরু করেন। শুরুতে তিনি খুব বেশি প্রচার করতেন না। প্রচার বলতে শুধু ছিল নিজের ফেইসবুকে মাজা রেস্টুরেন্টের কার্যক্রম শেয়ার করা। শুরুর দিকে কাস্টমার ছিল শুধু তার বাবার ফেসবুক বন্ধুরা।
কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের নাম সবদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তখন শুধু মোহাম্মদপুর না ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে তাদের খাবার খেতে মানুষ ভিড় করতে থাকে। ইরমার বাবা সংস্কৃতমনা ছিলেন। তিনি কবিতা ও গান শুনতে ভালোবাসতেন। তার বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে রেস্টুরেন্টের আনাচে-কানাচে। মাজা রেস্টুরেন্ট শুরু হবার পর তিনি পুরো সময় রেস্টুরেন্টের কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি রেস্টুরেন্টে থাকতেন, সবকিছু তদারকি করতেন। তিনি এখানে খেতে আসা কাস্টমারদের কাছ থেকেই পরামর্শ চাইতেন, কিভাবে আরো ভালো সেবা দেওয়া যায়। এভাবেই তার তত্ত্বাবধানে মাজা রেস্টুরেন্ট পথ চলতে থাকে। কিন্তু কয়েক বছর পর তিনি রেস্টুরেন্টের সব দায়িত্ব ম্যানেজার ও স্টাফদের উপর দিয়ে দুবাই চলে যান। তখন ম্যানেজার ও স্টাফরাই রেস্টুরেন্ট সামলাতে থাকে।
এদিকে তার মেয়ে জেরিয়া হাসনাইন ইরমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে একটি ব্যাংকে চাকরিতে জয়েন করেন। চাকরি করলেও ইরমা সবসময় ভাবতেন, জীবনের এক পর্যায়ে তিনি ব্যবসা করবেন। কিন্তু বাবার ব্যবসার হাল ধরবেন এমনটা কখনো ভাবেননি। অনেকেই তাকে বলতো কেন তিনি ব্যবসা না করে চাকরি করছেন। সেই কথার সূত্রে তিনি একটি অভিজ্ঞতার কথা জানান। তিনি যেই ব্যাংকে কাজ করতেন সেই ব্যাংকের সব শাখার ম্যানেজারদের নিয়ে একটি রেস্টুরেন্টে মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। যেটি ছিল তাদের ‘মাজা রেস্টুরেন্ট’। কিন্তু তারা জানতো না তাদেরই একজন কর্মচারীর বাবার রেস্টুরেন্ট এটি। পরবর্তীতে মিটিংয়ে গিয়ে তারা যখন জানতে পারেন রেস্টুরেন্টটি ইরমার তখন তারা খুব অবাক হন ও রেস্টুরেন্টের প্রশংসা করেন। তখন তারাও ইরমাকে বলেন যে কেন সে নিজেদের এমন সুন্দর সাজানো গোছানো রেস্টুরেন্ট থাকতে চাকরি করছে। ইরমারও তখন মনে হয় যেহেতু ব্যবসা করার ইচ্ছা ছিল তাহলে এখন থেকে শুরু করা যাক।
২০২২ সালে ইরমা চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২০২৩ এর শুরুতে চাকরি ছেড়ে দেন। মার্চ মাস থেকে পুরোদমে ব্যবসার সাথে জড়িয়ে পড়েন। এইভাবেই শুরু হয় মাজা রেস্টুরেন্টের সাথে তার পথ চলা। প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে যান, সব কাজ দেখেন ও নিজে কাস্টমারদের খেয়াল রাখেন। যেহেতু ব্যবসায় নতুন তাই কিছুটা হলেও তাকে হিমসিম খেতে হয়। তবে ইরমা প্রতিদিনই নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করেন। রোজ তাকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, কাস্টমারদের চাহিদা ও সুবিধা অনুযায়ী চলতে হয়। ইরমা বলেন, সব কাস্টমারদের মন রক্ষা করে চলা বেশ কঠিন। তাদের অভিযোগগুলো হাসি মুখে গ্রহণ করতে হয় এবং তার সমাধান দিতে হয়। তবে তিনি মনে করেন, এখন যতটুকু গুছিয়ে ব্যবসা করতে পারছেন তার কারণ তার বাবা। ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখে তিনি অনেক কিছু শিখেছেন। কাস্টমারদের মুখোমুখি হওয়ার দক্ষতা তিনি অর্জন করেছেন চাকরি করার মাধ্যমে। চাকরির সুবাদে তাকে বিভিন্ন কাস্টমারদের ডিল করতে হতো, যা তাকে এখন সাহায্য করছে।
ইরমার এখন প্রতিদিনের ভাবনা কিভাবে মাজা রেস্টুরেন্টকে এগিয়ে নেওয়া যায়। পরিচিতি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ যারা তাদের কাছে আসবেন তাদের সবচেয়ে ভালো সার্ভিস দেওয়া। তার বাবার সম্মানকে ধরে রাখা। ইরমা জানান, চাকরি থেকে তিনি ব্যবসা বেশি উপভোগ করছেন। এখানে রয়েছে পূর্ণ স্বাধীনতা, যা তিনি সবসময় চেয়েছিলেন। তবে রয়েছে অনেক দায়িত্ব। কারণ এখন সবকিছুর দায়ভার শুধু তারই। এই বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন।
যারা নিজেদের ব্যবসা শুরু করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, অনেক বেশি ধৈর্য থাকলে তবেই ব্যবসা করার কথা ভাবতে হবে। কারণ কবে ও কখন থেকে সফলতার দেখা পাওয়া যাবে তা নিশ্চিত না। তবে ভালো ও নতুন কিছু করলে অবশ্যই গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যাবে। এখন অনেক প্রতিযোগিতা। আর সবাই ভালো কাজ করছে। নিজের কাজে নতুনত্ব থাকলে তবেই টিকে থাকা যাবে। আর খাবারের ব্যবসায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ। কারণ সবাই নিজের কষ্টের উপার্জনের টাকা দিয়ে একটু ভালো সময় কাটাতে আসে। খেতে আসে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি তিনি সন্তুষ্ট না থাকেন তবে দ্বিতীয়বার আর আসবেন না। ব্যবসার মূল মন্ত্র হচ্ছে ধৈর্য, নতুন কিছু করার ইচ্ছা ও কমিউনিকেশন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রিনিওর