ই-সিগারেট হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এক মাদক

এম জসীম উদ্দিন

রাজধানীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বারান্দায় একমাত্র সন্তান যুবায়েরকে(৩৫) হারিয়ে পাগল প্রায় রহিমা বেগম। মধ্যবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত ছেলে যুবায়ের। বাবা মারা গেছেন প্রায় দশ বছর আগে তার পর থেকে সেই ছিলো রহিমা বেগমের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তার মৃত্যুতে রহিমা বেগমের পরিবারের ওপর নেমে এলো মহাবিপযয়। যুবায়ের ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশনে মারা গেছে। তাঁর মায়ের সাথে কথা বলে জানা যায় যুবায়ের দীর্ঘদিন যাবৎ ধূমপানে আসক্ত ছিলো। অনেক চেষ্টা করেও তাকে নিবৃত্ত করা যায়নি। আর এভাবেই ধূমপান জাতীয় নেশার কারণে অনেক পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এর তথ্যানুসারে ধূমপানসহ তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৭০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হচ্ছে। সেই সাথে তামাকের উৎপাদন, বিপণন ও তামাক থেকে উৎপন্ন বর্জ্যের পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাবের ব্যাপারেও সতর্ক করেছে সংস্থাটি। ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে হু বলছে, এক শতাব্দীর ব্যবধানে তামাক ৪০ লাখ থেকে বেড়ে ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণে পরিণত হয়েছে যা একই সাথে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ।

বেশ কয়েক বছর ধরে সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকে সিগারেট ছাড়ার জন্য ই-সিগারেট ব্যবহার করে। সাধারণ সিগারেটের বিকল্প হিসেবে ‘ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম’ (এন্ডস) বা ‘ইলেকট্রনিক সিগারেট’ ব্যবহার করা হয়। সিগারেটের মতই দেখতে ফাইবার বা প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এই ব্যাটারিচালিত যন্ত্রগুলির মধ্যে একটি প্রকোষ্ঠ থাকে। তার মধ্যে ভরা থাকে বিশেষ ধরনের তরল মিশ্রণ। যখন কেউ ই-সিগারেট পান করে, তখন একটি সেন্সর ব্যাটারিকে সক্রিয় করে এবং ডিভাইসটির মাথার দিকে লাল হয়ে ধোঁয়া তৈরি করে এবং অ্যাটোমাইজারকে গরম করে তোলে। এই পদ্ধতিটি প্রোপিলিন গ্লাইকলকে বাষ্প করে তোলে। এই সিগারেটে টান দিলে তখন নিকোটিনের স্বাদ পাওয়া যায় এবং তা সাধারণ সিগারেটের মতোই ফুসফুসে চলে যায়। এই পদ্ধতিকে বলে ‘ভ্যাপিং’। এই সিগারেটের ভেতরে নিকোটিন, প্রপাইলিন গ্লাইকল অথবা ভেজিটেবল গ্লিসারিন এবং সুগন্ধি মিশ্রিত থাকে।

ইলেক্ট্রনিক সিগারেটের ধারণা ২০০৩ সালের শেষদিকে প্রথম দুনিয়ার সামনে নিয়ে আসেন হন লিক (Hon Lik) নামের এই চাইনিজ ফার্মাসিস্ট। পরবর্তীতে, ২০০৭ সালে তিনি এই প্রোডাক্টের পেটেন্ট লাভ করেন। বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট) এর ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ই-সিগারেটের বিষয়টি অনেকের কাছে নতুন মনে হলেও কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি হচ্ছে এবং শহরের তরুণদের মধ্যে ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠেছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ই-সিগারেটের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত না হয়েই এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। অনেক তরুণের কাছে ইলেকট্রনিক সিগারেট এখন ফ্যাশন হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশে যেহেতু এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, সেহেতু এটাকে রোধ করা দরকার। এজন্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ যেভাবে এটাকে নিষিদ্ধ করেছে সেভাবে আমাদের দেশেও নিষিদ্ধ করা দরকার।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সালে সংশোধিত) অধিকতর শক্তিশালীকরণের লক্ষে খসড়া সংশোধনী প্রস্তুত করেছে, যেখানে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম (ই-সিগারেট, ভ্যাপিং), হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্টসহ এ ধরনের সব পণ্য নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হয়েছে। ই-সিগারেট ব্যবহার করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়াও ই-সিগারেট ও তার যন্ত্রাংশের আমদানি, রফতানি, মজুত, বিক্রি, পরিবহণ ও অংশবিশেষ উৎপাদন নিষিদ্ধের কথাও বলা হয়েছে নতুন খসড়া আইনে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের খসড়া সংশোধনীতে ই-সিগারেট, ভেইপ কিংবা নিকোটিন পাউচ নিষিদ্ধের বিধান রাখা হয়েছে। বিদ্যমান আইনে ই-সিগারেট নিয়ে কিছু বলা নেই। প্রস্তাবিত সংশোধিত আইনের ধারা প্রথমবার লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে। কিন্তু বারবার একই অপরাধ করলে শাস্তি দ্বিগুণহারে বেড়ে যাবে।ইতিমধ্যে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাবের উপর অংশীজনের মতামত গ্রহণের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়েছে। অবিলম্বে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবিতে প্রতীকী মরদেহের কফিন নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে একাধিক মাদক বিরোধী সংগঠন।

বাংলাদেশে বছরে তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যায়। আইন সংশোধনে যত দেরি হবে, তামাকজনিত মৃত্যু ততই বাড়তে থাকবে। ধুমপান ছাড়ার চেষ্টা করা শুধুমাত্র নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নির্ভর হওয়া খুব যুক্তিসংগত কাজ নয়, তাতে অন্য আরেকটি পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। গবেষণা থেকে জানা গেছে, ই-সিগারেটে অ্যাসিটালডিহাইড (সম্ভাব্য কার্সিনোজেন), ফরমালডিহাইড (পরিচিত কার্সিনোজেন), অ্যাক্রোলিন (টক্সিন) এবং নিকেল, ক্রোমিয়াম ও সিসার মতো ধাতুসহ কমপক্ষে ৮০টি ক্ষতিকারক উপাদান রয়েছে। বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারী (৬৫ শতাংশ) স্বাদের কারণে ই-সিগারেটব্যবহারকরারচেষ্টাকরেন। ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তামাক নিয়ে তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে ই-সিগারেটকে সুনিশ্চিতভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। একসময় ই-সিগারেট জাতীয় পণ্যকে সিগারেটের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হলেও এখন বিভিন্ন গবেষণায় এর ক্ষতির বিষয়গুলো সামনে আসছে। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা ভেবে এটি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। ভারতেও ই-সিগারেট উৎপাদন, আমদানি ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কানাডাসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশেও ই-সিগারেট নিষিদ্ধ। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, সিগারেট বা ধূমপানের তুলনায় এভাবে ধোঁযা নেয়া ৯৫ শতাংশ কম ক্ষতির কারণ হতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, এগুলো পুরোপুরি ঝুঁকি মুক্ত। ই-সিগারেটের ভেতরে থাকা তরল পদার্থ এবং ধোঁয়া অনেক সময় এমন সব ক্ষতিকর রাসায়নিক বহন করতে পারে, যা সাধারণ সিগারেটের ভেতরেও থাকে। তবে এর মাত্রা অনেক কম। ই-সিগারেটে রয়েছে কার্সিনোজেনিক রাসায়নিক পদার্থ। যা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়াও ই-সিগারেটে থাকা রাসায়নিক পদার্থ ফুসফুসের রোগ ও শ্বাসযন্ত্রে ইনফেকশন ঘটাতে পারে বলে দাবি করছেন গবেষকেরা।এখন সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ই-সিগারেটে মানুষের হার্টের (হৃৎপিণ্ড) বেশি ক্ষতি করে। অনেকেই মনে করেন, ই-সিগারেট ধূমপানের অভ্যাস ত্যাগ করতে সাহায্য করে। কিন্তু ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-সিগারেট ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর প্রভাব সাধারণ সিগারেটের চেয়ে ক্ষতিকর। সাধারণ ধূমপান অথবা ভেপিং করার ১৫ মিনিট পর মানুষের হৃদস্পন্দন (হার্টরেট) বেড়ে যায় এবং মানুষকে ‘ফাইট অথবা ফ্লাইট মোডে’ নিয়ে যায়। উভয় ধূমপানেই হাতে এবং বাহুতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীকে সঙ্কুচিত করে দেয়। গবেষণায় বলা হয়েছে,উচ্চ রক্তচাপ এবং সঙ্কুচিত রক্তনালী উভয়ই হার্টে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত পৌঁছাতে বাধা দেয় এবং সময়ের সাথে সাথে ভেপিং ও ধূমপান অব্যাহত রাখলে তা হৃদরোগ সৃষ্টির কারণ হয়ে থাকে। একে নিরাপদ ইলেকট্রিক যন্ত্র বলেই মনে করা হয়। কিন্তু তা মোটেও নিরাপদ নয়। ই-সিগারেট আপনার মুখে বিস্ফোরিত হতে পারে। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো জানায়, চার্জারে সমস্যা থাকলে সিগারেট বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

জাপানে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ই-সিগারেট সাধারণ সিগারেটের চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। ক্যানসার বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত এর মধ্যে থাকা নিকোটিনের পরিমাণ নিয়ে। তাদের মতে, ই-সিগারেটের প্রধান উপকরণ নিকোটিন থেকে দ্রুত আসক্তি তৈরি হয়। সিগারেট ছাড়তে চেয়ে যাঁরা এটি ব্যবহার করেন তাঁদের এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা থেকে দেখা দিতে পারে ফুসফুসের বিভিন্ন অসুখ। তবে ই-সিগারেটের মধ্যে থাকা নিকোটিন নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে অনেকদিন থেকেই। কিন্তু ই-সিগারেটে যেভাবে রাসায়নিক নিকোটিন ব্যবহার করা হয় তা স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা অনুমোদিত নয় বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাধারণ সিগারেট হোক বা ই-সিগারেট সব নেশাকেই পরিত্যাগ করা জরুরি। ই-সিগারেট এর যন্ত্রগুলো বৈধভাবে বাংলাদেশে আসে না, বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানির অনুমতিও নেই। তারপরও এসব পণ্য বাজারজাত হচ্ছে। শিগগিরই ই-সিগারেটের ডিভাইস বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এর ব্যবহারের প্রবণতা বেড়ে গিয়ে মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করবে। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এ সম্পর্কে জানে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ সিগারেটের প্যাকেটের গায়েই লেখা থাকে ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’ আর ইংরেজিতে ‘Smoking is injurious to health it causes cancer’। পরিশেষে বলতে চাই ধূমপান একটি নেশা, আর নেশা মানেই ক্ষতিকর তাই সাধারণ সিগারেটের পাশাপাশি ই-সিগারেটের ব্যাপারেও জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে যাতে যুবায়েরের মতো আর কেউ অকালে প্রাণ না হারায়।

লেখক: তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর
পিআইডি ফিচার

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × one =