ঈদ-পরবর্তী স্বাস্থ্য ঝুঁকি

নাহিন আশরাফ

এক মাস সিয়াম সাধনা করার পর আসে মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতল। রমজান আসলেই সবার খাদ্যাভ্যাস থেকে ঘুম, সব কিছুর পরিবর্তন আসে। টানা ৩০ দিন এক রুটিন অনুসরণ করার পর ঈদ আসলে আবার এর ছন্দপতন ঘটে। এটা আমাদের স্বাস্থ্যর উপর প্রভাব ফেলে। ঈদ-পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা হয়েছে পুষ্টিবিদ তারিন ইসলামের সাথে। তারিন ইসলাম জানান, ঈদের পর অনেকেই নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগেন এবং যাদের আগে থেকেই শরীরে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে তাদের রোগ আরও প্রকট আকার ধারণ করে।

তামান্না ইসলাম বলেন, ঈদের দিন হঠাৎ করে মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি গ্রহণ করার কারণে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণ হারায়। রক্তে সুগার লেভেল অনেক বেশি বেড়ে যায়। সুগার লেভেল বেড়ে গেলে তা কিডনির উপর প্রভাব ফেলে। হঠাৎ  সুগার বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেকের দৃষ্টিশক্তি ঘোলা হয়ে আসে এবং মারাত্মক পর্যায়ে গেলে হাত পা অবশ হয়ে যেতে পারে। ডায়বেটিস রোগীদের আজীবন কিছু ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। রমজান ও ঈদ আনন্দে তাদের ওষুধ গ্রহণে অনিয়ম হয়। সেক্ষেত্রে উচিত রমজান আসার আগেই চিকিৎসকের সাথে কথা বলে ওষুধের নতুন নিয়ম জেনে নেওয়া। কিন্তু অনেকেই তা না করে ওষুধ গ্রহণে অবহেলা করে থাকেন।

ঈদের পর আরেকটি কমন সমস্যা হচ্ছে হার্টের সমস্যা। কয়েকদিন অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করার প্রভাব হার্টের উপর পড়ে। যাদের আগে থেকেই হার্টের সমস্যা থাকে তারা অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। বুঝে শুনে খাওয়াদাওয়া না করলে তাদের সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।

অনেকের এই সময়ে রক্তচাপ বেড়ে যায়। রক্তচাপ একটি জটিল সমস্যা। এটি বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে হৃদপিণ্ড, যকৃত, চোখ ও কিডনি ঝুঁকিতে থাকে হাই প্রেশারে। ঈদের প্রতিটি খাবারে অনেক বেশি ঘি ও মশলা ব্যবহারের কারণে শরীরে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার, যেমন মাংস, মাখন ও ভাজা খাবার খেলে এই সমস্যা জটিল হয়। ডিমের হলুদ অংশ এবং কলিজা, গুর্দা, মগজ এসব খেলে রক্তে কোলেস্টেরল বেড়ে যায়। কোলেস্টেরল জমা হয় রক্তনালিতে। জমা হতে হতে রক্তনালির স্বাভাবিক যে রক্তস্রোত তা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

খারাপ কোলেস্টেরল হলেই তার প্রভাব আপনার চোখের পাতায়, রঙে ধরা পড়বে। কোলেস্টেরলের প্রভাব সবার আগে চোখের উপর পড়ে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, কর্নিয়ার আশপাশে সাদা, হলুদ পদার্থ জমতে দেখা যায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বেশ কিছু অসুস্থতার যোগসূত্র রয়েছে। যেমন মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কসন, ব্রেন স্ট্রোক ও পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ। কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি ঘটলে, বৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিক হারে এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার কারণে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দেখা দেয় অনেকের। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হলে খিদে কম পায়, পেটে গ্যাস হয়, বুক জ্বালা করে ও পেটের মাঝখানে চিনচিন ব্যথা, বুক ও পেটে চাপ অনুভূত, হজমে অসুবিধা এবং বমি হতে পারে। ঈদ-পরবর্তী সময়ে অনেকে বুকে ব্যথা নিয়ে চিকিৎসদের শরণাপন্ন হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় গ্যাস্ট্রিকের জন্য বুক ব্যথা হচ্ছে। খাওয়ার পরই যদি বুক জ্বালা করে, পেটের উপরের দিকে ব্যথা হয়, পেট ভারী মনে হয় তবে অবশ্যই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বলে বুঝতে হবে। যাদের কখনো গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থাকে না দেখা যায় তাদেরও ঈদের পর গ্যাসের সমস্যা হয়ে থাকে।

ঈদের পর ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ডায়রিয়া হলে পায়খানা ও বমির পাশাপাশি মূত্র ও ঘামের সাথে শরীর থেকে সোডিয়াম, ক্লোরাইড, পটাশিয়াম এবং বাইকার্বনেট বের হয়ে যায়। এগুলো যখন পূরণ হয় না তখন পানিশূন্যতা দেখা দেয়। ডায়রিয়া থেকে হয় ডিহাইড্রেশন। কারণ একে তো রমজানে অনেক  কম পানি পান করা হয়; আবার ঈদে অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাবারের প্রভাবে ডায়রিয়া হলে শরীর থেকে প্রচুর পানি বের হয়ে। স্বল্পমাত্রায় ডিহাইড্রেশন হলে তা প্রচুর পানি খেলে ঠিক হয়ে গেলেও, গুরুতর ডিহাইড্রেশন হলে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

ঈদের কয়েকদিন অনেক বেড়ানো হয়। অনেকে ঢাকা বাইরেও ছুটি কাটাতে চলে যান। এর ফলে বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার অনেক বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়। এর প্রভাব পড়ে লিভারে। তাই অনেকের ঈদের পর লিভারে চর্বি ধরা পড়ে। আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে এ রোগ নির্ণয় করা হয়। আমাদের লিভারে সাধারণত ৩-৪ পাউন্ড চর্বি থাকে। লিভার সেলের চারপাশেও কিছু চর্বি থাকে। এ চর্বির পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি হলে সেটিকে ফ্যাটি লিভার বলা হয়। লিভারে চর্বি জমলে খাওয়ার ইচ্ছে কমে যায়, খাবারে অরুচি হয়, দ্রুত ওজন কমা, বমি বমি ভাব, বমি হওয়া, খুব দুর্বল লাগা ও কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না। ফ্যাটি লিভার হলে মাথাব্যথা, মন খারাপ ও ডিপ্রেশন, আচমকা কাঁপুনিসহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়। এছাড়া টাইফয়েড জ্বর ও জন্ডিস দেখা দেয়।

ঈদের পর অনেকেরই অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যায়। প্রতি বেলায় হাই ক্যালরি খাবার, ব্যায়ামের অভাব, ঘুমের অনিয়ম; ওজন বেড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী। আর এই দিনে কমবেশি প্রায় সবার বাসাতেই রান্না করা হয় মুখরোচক খাবার। ঈদের কয়েকদিনে এই মুখরোচক খাবারগুলো খেয়ে সারা বছরের ডায়েট ভেস্তে যায়। এ সময়টা অতিরিক্ত চর্বি ও তেল জাতীয় খাবারের জন্য পিত্তথলিতে পাথর জমে। পিত্তথলি মানব দেহের বুকের পাঁজরের ডান দিকে পেটের ওপরে অংশের যকৃত বা লিভার বা কলিজার নিচে যুক্ত থাকে। লিভার থেকে তৈরি পিত্ত রস বা বাইল পিত্তথলি জমা রাখে এবং চর্বি জাতীয় খাবার খেলে হজমের জন্য পিত্তরস পিত্তথলি থেকে বেরিয়ে খাদ্যনালিতে আসে এবং হজমে সহায়তা করে। পিত্তরস হলুদ রঙের তরল পদার্থ। এতে থাকে কোলেস্টেরল, ক্যালসিয়াম, লবণ, এসিড ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান। এই পিত্তরসের বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি হয় পিত্তথলির পাথর।

আঁশযুক্ত খাবারের অভাবে দেখা দেয় কোষ্ঠকাঠিন্য। অস্বাস্থ্যকর এবং বাজে খাদ্যাভ্যাস, অপুষ্টিকর খাবার ইত্যাদির কারণে কোষ্ঠকাঠিন্যর মতো অস্বস্তিকর সমস্যায় পড়ে থাকেন অনেকেই। স্বাভাবিকের চেয়ে কম সংখ্যকবার মলত্যাগ করা, ছোট, শুষ্ক, শক্ত পায়খানা হওয়া, মল ত্যাগে অত্যন্ত কষ্ট হওয়া, পায়খানা করতে অধিক সময় লাগা, পায়খানা করতে অধিক চাপের দরকার হওয়া, অধিক সময় ধরে পায়খানা করার পরও পূর্ণতার অনুভূতি না আসা, পেট ফুলে থাকা, আঙুল, সাপোজিটরি কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমের সাহায্যে পায়খানা করা, মলদ্বারের আশপাশে ও তলপেটে ব্যথার অনুভব হওয়া, মলদ্বারে চাপের অনুভূতি হওয়া কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষণ।

এসব সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে বলে জানান পুষ্টিবিদ তামান্না ইসলাম।

ঈদ আনন্দে নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভুলে গেলে হবে না। কার্বোহাইড্রেট কম খেতে হবে। খাবারের পাতে লেবু থাকতে হবে। এতে ভিটামিন সি’র চাহিদা পূরন হবে। সালাদ খেতে হবে। খাবারের পর টক দই খাওয়া যেতে পারে, এতে খাবার দ্রুত হজম হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে কুসুম গরম পানি খেলে পেট পরিষ্কার থাকবে। ভাত জাতীয় খাবার কম খেয়ে সবুজ শাকসবজি খেয়ে পেট ভরতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি, ডাবের পানি, চিনি ছাড়া ফলের শরবত খেতে হবে। যারা ঈদে বেড়ে যাওয়া ওজন কমাতে চান তাদের রোজ ৪০ মিনিট জোরে জোরে হাঁটার চেষ্টা করতে হবে।

প্রতিদিন বাড়িতেই ১৫ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করতে হবে। এতে ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। ঈদের পর আঁশ জাতীয় খাবারের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। বেশি করে লাল শাক, ছোট মাছ, মিষ্টি কুমড়া, লাউ ইত্যাদি খেতে হবে। মাংসজাতীয় খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। ঈদের সময় বাড়িতে স্যালাইন রাখতে ভুলবেন না। ঈদের পরে রান্নাতে যতটা সম্ভব তেল মশলা কম ব্যবহার করুন। ঈদের পর যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে ফিরে আসতে হবে। ঈদের ছুটির পর কর্মব্যস্ত জীবনের যোগ দেবার আগে চিকিৎসক মাধ্যমে নিজের চেকআপ করিয়ে নিন। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আপনি সুস্থ আছেন কি না জানা সম্ভব। ঈদ পরবর্তী যেকোনো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ খান এবং সুস্থ থাকুন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 + 15 =