একজন আয়েশা আখতার

মাসুম আওয়াল

রজনীগন্ধার ঘ্রাণ মেখে ঢাকার বনানী কবরস্থানে ঘুমিয়ে আছেন আয়েশা আখতার। তার নাম শুনেছেন কখনো! কোনো দিন কী দেখা হয়েছে তার সঙ্গে! চেনা চেনা লাগছে নামটি? ষাট-সত্তর-আশির দশকের বাংলা সিনেমার দর্শকরা ঠিক চিনবেন আয়শা আখতারকে। সেই সময়ের একজন নন্দিত অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন। অনেক সিনেমায় মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। জানুয়ারি মাসে জন্মেছিলেন এই গুণী অভিনেত্রী। তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছে রঙবেরঙ। বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৯২ বছর। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই গুণী শিল্পী সম্পর্কে কিছু তথ্য।

নরসিংদীর মেয়ে আয়েশা

আয়েশা আখতার ১৯৩১ সালের ১ জানুয়ারি, নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার চকতাতারদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এখনো রয়েছে সেই বাড়িটি। সেখানে বসবাস করছেন তার আত্মীয় স্বজনরা। অল্প বয়সেই ঢাকা শহরে চলে আসেন তিনি। ১৯৭৩ সালে থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত অনেকগুলো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। নিজের যোগ্যতায় সবার পছন্দের অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন। আর এখনো স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন।

যেভাবে অভিনয়ে পথ চলা শুরু আয়েশার

মঞ্চ-বেতার-চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের একজন জনপ্রিয় গুণী অভিনেত্রী ছিলেন আয়েশা আখতার। তিনি টেলিভিশনের অনেক বিজ্ঞাপনচিত্রেও কাজ করেছেন। চল্লিশ দশকের শেষের দিকে মঞ্চনাটকের মাধ্যমে অভিনয়জগতে আসেন আয়েশা। বাংলাদেশের নাট্যজগতের ৫০ দশকের সুপরিচিত ও জনপ্রিয় নাট্যাভিনেত্রী ছিলেন তিনি। তখনকার সময়ে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টংগী, জয়দেবপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তান আমলে, রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘বুনিয়াদি গণতন্ত্রের আসর’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা পর নাম ছিল ‘আমার দেশ’)-এ ‘মজিদের মা’ নামে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন আয়েশা আখতার।

আয়েশা আখতার অভিনীত যতো চলচ্চিত্র

জনপ্রিয় এই অভিনেত্রী পরবর্তীতে বহু চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেছন। আয়েশা আখতার অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ: আসিয়া, লালন ফকির, ঝড়ের পাখি, সংগ্রাম, জানোয়ার, ওয়াদা, নয়নমনি, অমর প্রেম, তুফান, অলংকার, দিন যায় কথা থাকে, জীবন নৌকা, মানসী, সওদাগর, দুই পয়সার আলতা, আলী আসমা, নতুন বউ, জাদু মহল, জীবন ধারা, মায়ের দোয়া, ভাই ভাই, সেলিম জাভেদ, রাজা সাহেব, ভাঙ্গাগড়া, স্বামীর ঘর, জবাব, চাষীর মেয়ে, সেতু, নোলক, অলংকার, অনুরাগ, মাটির ঘর, বন্দুক, ঈমান, দি ফাদার, বৌরানী, সংঘর্ষ, বাদল, সুলতানা ডাকু, সাক্ষী, জন্ম থেকে জ্বলছি, ভাঙাগড়া, স্বামীর ঘর, গাঁয়ের ছেলে, মাটির কোলে, ভাগ্যলিপি, নওজোয়ান, শুভরাত্রি, সানাই, আশার আলো, নতুন বউ, রজনীগন্ধা, বৌ মা, এই নিয়ে সংসার, নরম গরম, নদীর নাম মধুমতী, সিপাহী ইত্যাদি।

মায়ের চরিত্রে সেরা আয়েশা

আয়েশা আখতার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে স্নেহময়ী আদর্শবান মা হিসেবেই পরিচিতি পেয়েছিলেন। মমতাময়ী মায়ের চরিত্রে অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি মন ভরানো অভিনয় করেছেন। আদর্শ মায়ের চরিত্রে যে সাবলীল অভিনয় দক্ষতা তিনি দেখিয়েছেন, দর্শক-শ্রোতাদের আবেগে ভাসিয়েছেন তা অত্যন্ত বিরল। তার চেহারাটাই ছিল স্নেহময়ী আদর্শ মায়ের প্রতিচ্ছবি। স্নেহময়ী জননী হিসেবে চলচ্চিত্রের পর্দায় আয়েশা আখতার আজও জীবন্ত।

আয়েশা আখতারের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

এক জীবনে অভিনয় করে প্রচুর দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছেন আয়েশা আখতার। দর্শকরা তাকে ভালোবাসতেন বলেই একের পর এক সিনেমায় অভিনয়ের ডাক পেয়েছেন। অভিনয় করে গেছেন। দর্শকের ভালোবাসার পাশাপাশি সরকারের স্বীকৃতিও পেয়েছেন এই অভিনেত্রী। ১৯৮২ সালে ‘রজনীগন্ধা’ সিনেমায় অভিনয় করে ৭ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেত্রী হিসেবে, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন আয়েশা। ‘রজনীগন্ধা’ সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৮২ সালের ১৪ অক্টোবর। পরিচালক ছিলেন কামাল আহমেদ। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক, শাবানা, অঞ্জনা রহমান, আলমগীর, প্রমুখ।

শিক্ষক আয়েশা

তথ্য পাওয়া যায় এক সময় শিক্ষকতার পেশার সঙ্গেও ছিলেন আয়েশা আখতার। ১৯৪৬ সালে এসএসসি পাস করে জিটি ট্রেনিং লাভ করেন তিনি। প্রথমে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কয়েকটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অভিনয়ে নিয়মিত হওয়ার পরে সেটাই ছিল তার একমাত্র পেশা।

আয়েশা আখতারের পরিবার

আয়েশা আখতাররা ছিলেন পাঁচ বোন, দুই ভাই। আর সংসার জীবনে তিনি হয়েছিলেন তিন ছেলের মা। বর্তমানে তার কোনো ছেলেও বেঁচে নেই। অতিরিক্ত সচিব, সংবাদপাঠক, কবি ও লেখক আফতাব আহমদ, আয়েশা আখতারের ছেলে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে মারা গেছেন কবি আফতাব আহমদ। প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাবেক স্ত্রী গুলতেকিন খানের সঙ্গে আফতাব আহমদের বিয়ে হয়েছিল ২০১৯ সালে। আফতাব আহমেদ অতিরিক্ত সচিব হিসেবে তিনি অবসরে যান। আয়েশা আখতার ও তার সন্তানেরা কেউ আর নেই এই পৃথিবীতে।

আয়েশা আখতারের মৃত্যু

২০০৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান আয়েশা আখতার। সেই সময় তার বয়স হয়েছিলো ৭২ বছর। বনানী কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে। সব শেষে আবারও প্রয়াত এই গুণী অভিনয়শিল্পীর প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। আমরা জানি শিল্পীরা কখনো হারিয়ে যান না। তারা থেকে যান তাদের শিল্পে, তাদের কাজের মাঝে। তাই আমরা বলতেই পারি, যতদিন বাংলা সিনেমা থাকবে ততদিন এই অসাধারণ প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের, স্নেহময়ী আদর্শবান মায়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে বেঁচে থাকবেন। আর আমরা গর্ব করেই বলতে পারি আমাদের একজন আয়েশা আখতার ছিলেন। তরুণ প্রজন্মের অভিনয় শিল্পীদের আইডল হয়ে থাকবেন তিনি। শুধু নায়িকা না হয়েও যে বড় তারকা হওয়া যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আয়েশা আখতার। ওপারে ভালো থাকুক সিনেপর্দার মমতাময়ী মা।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্মরণ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty + 3 =