নীলাঞ্জনা নীলা
‘আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া গেল রে মরার কোকিলে…’, এই গানের সঙ্গে তাল মেলায়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কালজয়ী অনেক গান দিয়ে গানের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন। বাংলা গান ভালোবাসেন, কিন্তু প্রিয় গানের তালিকায় বেবী নাজনীনের গান নেই এ যেন সম্ভব নয়। বিশেষ করে নব্বই দশকের পর বেবী নাজনীন বাংলা গানের জগতকে আলোকিত করে রেখেছিলেন তার কোকিল কণ্ঠ দিয়ে। এমন সব গান উপহার দিয়েছেন যা বাংলার মানুষের মুখে মুখে এখনও রয়েছে। মানুষ নিষ্পাপ পৃথিবীতে আসে, আমার একটা মানুষ আছে, এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল, কাল সারারাত ছিল স্বপ্নেরও রাত, দু চোখে ঘুম আসে না, লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে, আজ পাশা খেলবো রে শাম, সারা বাংলা খুঁজি তোমারে; ইত্যাদি অনেক জনপ্রিয় গান তিনি উপহার দিয়েছেন।
১৯৬৫ সালের ২৩ আগস্ট সৈয়দপুর নীলফামারীতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বেড়ে উঠেন গান শুনতে শুনতেই। কারণ তার দাদা ও বাবা দুজনই গানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বাবা মনসুর সরকারের হাত ধরেই গান করা শুরু বেবীর। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি মঞ্চে গান গাওয়া শুরু করেন। এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। উপহার দিয়েছেন একের পর এক অসাধারণ গান। ভারতের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী আশা ভোঁশলে, বাপ্পি লাহিড়ী, কুমার শানুর সঙ্গে বেবী নাজনীন একাধিক অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। শুধু বাংলার মাটিতে নয় বিশ্বজুড়ে তার সুরেলা কণ্ঠ ছড়িয়েছে। প্রবাসী বাঙালিদের কাছেও তিনি এখনও জনপ্রিয়। অনেকের কাছে বেবী নাজনীনের গান শুধু গান নয়, এটি ছোটবেলার স্মৃতি ও আবেগের নাম। একটা সময় তিনি যা গাইতেন তাই শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠতো। চলচ্চিত্র মানেই ছিল বেবী নাজনীনের গান। প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে তার রয়েছে অনেক খ্যাতি। ১৯৮৪ সালে ‘লাগাম’ সিনেমাতে তিনি প্রথম প্লেব্যাক করেন। এরপর থেকে এখন অবধি তিনি প্রায় দুইশর বেশি সিনেমাতে গান করেছেন। বেবী নাজনীন ২০০৩ সালে শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
১৯৮৭ সালে তার প্রথম গানের অ্যালবাম ‘পত্রমিতা’ প্রকাশিত হয়। এ অ্যালবাম তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। সবার প্রিয় তারকা হয়ে উঠেন তিনি। বেবী নাজনীন আধুনিক গানের জন্য বিখ্যাত হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, লালনের গানেও তার বিচরণ রয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে ১৯৮৭ সালে তিনি কবি ও ব্যবসায়ী সোহেল অমিতাভের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু সে সংসারে বিচ্ছেদ ঘটে। বেবী নাজনীনের একমাত্র সন্তান যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন।
হৃদয়ের গভীর থেকে ভালোবেসেও দেশ থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল বেবী নাজনীনকে। যে মানুষ শুধু দেশের জন্য ও বাংলার জন্য গান উপহার দিয়েছেন তার জন্য দেশের মাটি থেকে দূরে থাকা কষ্টের। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বরাবরই বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করলেও তার দেশের জন্য সব সময় মন কাঁদে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন। প্রায় আট বছর তিনি দেশ থেকে দূরে যুক্তরাষ্ট্রে নিউ জার্সিতে বসবাস করছিলেন।
শিল্পী ছাড়াও বেবী নাজনীনের আরেকটি পরিচয় তিনি রাজনীতিবিদ। সঙ্গীতের মতো রাজনীতকেও তিনি তার ক্যারিয়ার হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই গানের ব্যস্ততা থাকলেও তিনি কখনও রাজনীতি থেকে দূরে থাকেননি। অনেকেই তাকে প্রশ্ন করেন, কিভাবে তিনি গান ও একাধারে রাজনীতি করে যাচ্ছেন এত বছর ধরে। উত্তরে তিনি বলেন, জীবনের প্রতিটি বিষয়ে ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে পারলেই সফলতা আসবে। একটি কাজ ভালো করে করতে গিয়ে আরেকটি কাজ ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে নেই। তাছাড়া কাজের প্রতি ভালোবাসা থাকলে যেকোনো কাজই তখন সহজ মনে হয়, চাপ মনে হয় না। বেবী নাজনীন যেমন গান ভালোবাসেন তেমনি রাজনীতির প্রতিও তার রয়েছে নেশা। তিনি যেহেতু সংস্কৃতি জগতের মানুষ তাই বরাবরই তার চেষ্টা থাকে রাজনীতির মাধ্যমে কিভাবে সংস্কৃতি জগতকে আরও সমৃদ্ধ করা যায়।
এই রাজনীতির জন্যই জীবনের একটা পর্যায়ে তাকে দেখতে হয়েছে নানা রকম উথান পতন। ২০০৮ সালের পর থেকে বেবী নাজনীনের বাংলাদেশের মঞ্চে গান গাওয়া কমে যেতে থাকে। ২০১৪ সালের পর থেকে তা একদমই বন্ধ হয়ে যায়। দেশের মঞ্চে তার গান গাওয়া কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক কারণ। কিন্তু তিনি কখনওই রাজনীতি আর গানকে মেলাতে চাননি। কারণ এ দুটি তার কাছে সম্পূর্ণ ভিন্ন জগত। বেবী নাজনীন মনে করেন একজন যোগ্য শিল্পীকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়া উচিত। রাজনীতি দিয়ে কখনও শিল্পীকে বিচার করা উচিত নয়। শিল্পীর কাজ তার দর্শক ও শ্রোতাদের বিনোদন দেওয়া, এছাড়া শিল্পীর আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। শিল্পীর ব্যক্তিগত জীবন কিংবা রাজনৈতিক জীবন টেনে নিয়ে না আসাই ভালো। রাজনৈতিক কারণে এক সময় তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। তবে তিনি জানান, বিদেশে তাকে কোনো প্রতিবদ্ধকতার শিকার হতে হয়নি। পরিস্থিতি মেনে নিয়ে তিনি বিদেশে গিয়ে নতুন করে আবার কাজ শুরু করেন। বাঙালি সোসাইটির আয়োজনে বিভিন্ন মঞ্চে তিনি গান করেন। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গান করেছেন। বিদেশে থাকা অবস্থায় তিনি সেখানে বাঙালি এবং স্থানীয় মানুষদের কাছে যথেষ্ট সম্মান পান। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে রয়েছে তার সমান খ্যাতি। বিদেশে তিনি গানের পাশাপাশি সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনাও করেন। তিনি এক মুহূর্তের জন্য তার গানের চর্চা থামিয়ে দেননি। রাজনীতি এবং গান এই দুটি মাধ্যমেই তিনি নিজেকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত রাখতেন। বিদেশ থেকে তার দেশের সহকর্মীদের খোঁজ খবর রাখতেন। বিদেশের মাটিতে থাকলেও সব সময় তার দেশের কথা মনে পড়তো। কারণ এই দেশই তাকে তার পরিচিতি দিয়েছে। আজকের বিখ্যাত বেবী নাজনীন তিনি হয়ে উঠতে পেরেছেন শুধুমাত্র দেশের শ্রোতাদের ভালোবাসার জন্য। শ্রোতাদের ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা এবং গ্রহণযোগ্যতা না পেলে তিনি কখনোই আজকের শিল্পী হয়ে উঠতে পারতেন না বলে তিনি মনে করেন।
সব সময় হাসিমুখে থাকা এই শিল্পীকে তার শ্রোতাদের পাশাপাশি সহকর্মীরাও ভীষণ ভালবাসেন। তার ব্যবহার ও আচরণ দিয়ে সবাইকে খুব কম সময়ে আপন করে নিতে পারেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি মজার ছলে বলেন, ‘আমি ছোটবেলায় আমার মা’কে বলতাম, মা আমি তো দেখতে কালো সুন্দর না তাই আমাকে গুণবতী হতে হবে। তখন আমার মা বলতেন, কে বলেছে তুমি সুন্দর না? তুমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। মায়ের কথায় আমার মন ভরে যেত এবং আমি আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতাম।’ বেবী নাজনীন বলেন, সৌন্দর্যের কোনো সংজ্ঞা হয় না এবং সৌন্দর্য কখনোই গায়ের রঙ দিয়ে বিবেচনা করা যায় না। একজন মানুষের আসল সৌন্দর্য তার ব্যক্তিত্ব, কতটুকু জ্ঞানে সমৃদ্ধ তার উপর নির্ভর করে। সুন্দর মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে অবশ্যই তার মধ্যে সততা থাকতে হবে এবং ভালো মানসিকতার হতে হবে।
বেবী নাজনীন মনে করেন নিজেকে শিল্পী পরিচয় দেওয়া খুব কঠিন। কারণ একজন শিল্পী তখনি হয়ে ওঠা সম্ভব যখন অনেক সাধনা করা হয়। সাধনা আর পরিশ্রম ছাড়া কখনও শিল্পী হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। গানের জন্য প্রয়োজন ভীষণ সাধনা। একটি গান গেয়ে ফেললেই হলো না। গানের পেছনে দিতে হবে প্রচুর শ্রম। শ্রম ছাড়া শিল্পী হয়ে গেলেও তারা বেশি দিন টিকে থাকতে পারেন না। বেবী নাজনীন সবসময় তার শ্রোতাদের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ তাদের অনুপ্রেরণাতে তিনি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছেন। তিনি বলেন, একজন শিল্পীর যেমন দায়িত্ব তার শ্রোতাদের বিনোদন দেওয়া তেমন শ্রোতাদেরও দায়িত্ব শিল্পীদের অনুপ্রেরণা এবং সাহস দেওয়া।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি