একাত্তর, বাহাত্তর ও দুই হাজার বাইশের ‘জয় বাংলা’

মৌ সন্ধ্যা

‘জয় বাংলা’ শব্দবন্ধ ও বাংলাদেশ এক সুতায় গাঁথা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সবচেয়ে বেশি প্রেরণা দিয়েছিল এই দুই শব্দের স্লোগান। মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়েও বাঙালির শক্তি সাহস একইভাবে যুগিয়ে এসেছে এই স্লোগান। বাংলাদেশের নাটক, সিনেমায়, প্রামাণ্যচিত্রে, সাহিত্যে, নানাভাবে বারবার উঠে এসেছে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান।

তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে এবার আমরা আলোচনা করব ‘জয় বাংলা’ শিরোনামের চলচ্চিত্র নিয়ে। ‘জয় বাংলা’ শিরোনামে তিনটিরও অধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭১ সালে নির্মিত হয় ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘জয় বাংলা’। এর পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে নির্মিত হয়ে মুক্তি পায় একই নামের চলচ্চিত্র। মুক্তিযুদ্ধের ৫২ বছর পরে ২০২২ সালে নির্মিত হয়েছে ‘জয় বাংলা’ শিরোনামে আরো একটি চলচ্চিত্র।

একাত্তরের ‘জয়বাংলা’

১৯৭১ সালে উমাপ্রসাদ মৈত্র’র পরিচালনায় নির্মিত হয় ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র ‘জয় বাংলা’। ওই বছরই কলকাতায় মুক্তি পায় চলচ্চিত্রটি। এই ‘জয় বাংলা’ সিনেমার প্রযোজক ছিলেন ধীরেন দাশগুপ্ত, রচয়িতা ছিলেন মিহির সেন আর চিত্রনাট্য করেছিলেন মিহির সেন ও উৎস। সিনেমার গানগুলোর সুরকার ছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত। চিত্রগ্রাহক ছিলেন মিহির সিংহ। সেসময় এই চলচ্চিত্রটি পশ্চিমবঙ্গে জনমত গঠনে একটি বড় ভূমিকা রেখেছিল।

যারা অভিনয় করেছিলেন ‘জয় বাংলা’য়

১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অবলম্বন করে সেসময় কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশি কলাকুশলীদের নিয়ে নির্মিত হয়েছিল সিনেমাটি। এতে অভিনয় করেছিলেন এসএম আলাউদ্দিন, আব্দুল হক, লোকমান হোসেন, গোলাম মুস্তফা, অরবিন্দু কুণ্ডু, মোহাম্মদ বাবর, আলী আবদুল হামিদ, নুরুল আলম, মোহাম্মদ ইউসুফ, কোরবান আলী ও মোহাম্মদ রহমান প্রমুখ। ১৩ রিলে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল।

১৯৭২ সালে নির্মিত ‘জয়বাংলা’

বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় মুক্তিযুদ্ধের আরেকটি চলচ্চিত্র ‘জয় বাংলা’। নাম একই হলেও ভারতীয় ‘জয় বাংলা’ সিনেমার সঙ্গে বাংলাদেশের সিনেমাটির কোনোই মিল নেই। দেশের মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত সিনেমাগুলোর মধ্যে এই সিনেমাটির নামও পাওয়া যায় না। তার কারণ হলো এটি তেমন প্রচার পায়নি কখনো। সিনেমাটি অনেকটা নিখোঁজ হওয়ার মতোই। সোশ্যাল মিডিয়ায় এক ফেসবুক ওয়ালে ভাসছিল এই সিনেমাটি নিয়ে কিছু তথ্য। যার প্রমাণ হিসেবে পাওয়া যায় বেশ কিছু পুরোনো দিনের পেপার কাটিং। সিনেমাটি নিয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায় সেখান থেকেই।

‘জয়বাংলা’ সিনেমাটি নিয়ে যে তথ্য মিলেছে সোস্যাল মিডিয়া থেকে তারই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো: ‘১৯৭২ সালে মুক্তি পেলেও ‘জয় বাংলা’ সিনেমাটি নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু হয় বেশ আগেই। ১৯৭০ সালের মে মাসে ‘জয় বাংলা’ নামে একটি সিনেমা তৈরির ঘোষণা দেন তৎকালীন সময়ের এক সাদামাটা পরিচালক ফখরুল আলম। সিনেমাটির প্রযোজক ছিলেন এম এ খায়ের। যিনি একটি গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানির মালিক ছিলেন। বিশেষ করে ৭ই মার্চের ভাষণ রেকর্ড ও বাজারজাত করার কারণে বিখ্যাত হয়েছিল কোম্পানিটি।

জানা যায়, সিনেমাটি যখন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় তখন সত্তুরের নির্বাচনের মনোনয়ন মৌসুম। এম এ খায়ের কোনো বড় মাপের রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তবে তার নির্বাচন করার খুব ইচ্ছা ছিল। দলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সিনেমাটি প্রযোজনা করেন তিনি। সিনেমাটির মহরত হয় ৭০ সালের ১৯ জুন এবং সেদিন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আহ্বান করা হয়। পরিচালক ও সিনেমাটির কাহিনীকার মাহবুব তালুকদার দু’বার সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, সিনেমাটির সঙ্গে রাজনীতির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। স্বল্প বাজেটের এ সিনেমাটি মাত্র দুই মাসে নির্মাণ হয়। পরে প্রযোজক এম এ খায়ের আওয়ামী লেিগর নমিনেশন পেয়ে যান এবং নির্বাচনে জয়লাভও করেন।

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তির জন্য সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়া হয় সিনেমাটি। বোর্ড অনেকদিন ঝুলিয়ে রাখার পর শুধু নামের কারণে সিনেমাটির সেন্সর সার্টিফিকেট দেয়নি। সিনেমাটিকে সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য তৎকালীন ছাত্রনেতা আসম আব্দুর রব বিবৃতি দিয়েছিলেন। এ সিনেমার নায়ক ছিলেন মাসুম এবং নায়িকা ছিলেন আতিয়া ওরফে শাহানা। পরবর্তীতে ৭২ সালে ঈদের দিনে সিনেমাটি মুক্তি পেলেও কোনো সাড়া পায়নি। ঈদের আগে সিনেমার বিজ্ঞাপন পত্রিকায় দেখা গেলেও ঈদের পর আর তেমন দেখা যায়নি। সিনেমাটি কোনদিন টেলিভিশনে প্রচার হয়েছে কি না সন্দেহ আছে। এই সিনেমায় ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটি ব্যবহার করা হয়েছিল শাহনাজ বেগমের কণ্ঠে। যা কোনো রাজনৈতিক চেতনা থেকে ব্যবহার হয়নি। বরং পরে ৭১ সালে এ গানটি কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। আরও পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের কণ্ঠে কোরাস সংগীত হিসেবে গাওয়া এ গানটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। গানটি যন্ত্রসংগীত হিসেবে ব্যবহার হয়েছে বেশি। বিশেষ করে বেতার কেন্দ্রের অধিবেশনের শুরুতে ও শেষে। এ গানের যে রেকর্ড বের করেছিলেন এম এ খায়ের তা ছিল সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক এবং অরাজনৈতিক। একই নামে ৭১ সালের শুরুতে আওয়ামী লীগকে ফোকাস করে আরেকটি রেকর্ড বের করে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। সে রেকর্ডে ছিল দেশাত্মবোধক গানটি। স্বাধীনতার পর কাহিনীকার মাহবুব তালুকদারকে রাষ্ট্রপতির স্পেশাল অফিসার (উপসচিব) নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর তিনি ছিলেন নির্বাচন কমিশনার।

বাইশের ‘জয় বাংলা’

বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় পরিচালক কাজী হায়াত ২০২২ সালে দর্শকদের উপহার দিয়েছেন আবারও ‘জয় বাংলা’ শিরোনামের আরও একটি চলচ্চিত্র। এটি ছিল সরকারি অনুদানের সিনেমা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ‘জয় বাংলা’ সিনেমাটি নির্মাণের জন্য সরকারি অনুদান পায়। সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন জনপ্রিয় অভিনেতা বাপ্পি চৌধুরী এবং নবাগত নায়িকা জাহারা মিতু। ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ‘জয়বাংলা’ সিনেমাটি। দুঃখজনক ব্যাপার হলো সিনেমাটির ট্রেলার এবং পোস্টার রিলিজের পরই কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। যেখানে মানহীন পোস্টার এবং নির্মাণকেই দুষেছেন দর্শকরা। একইসঙ্গে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নৈপুণ্য নিয়েও হয় সমালোচনা। সিনেমাটি প্রচার শুরু হলেও এতে অংশ নেননি কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করা বাপ্পি-মিতু। লেখক মুনতাসির মামুনের ‘জয় বাংলা’ উপন্যাস অবলম্বনে বানানো হয়েছে সিনেমাটি।

শেষ কথা ও ‘জয় বাংলা’ নিয়ে কিছু তথ্য

‘জয় বাংলা’ স্লোগান জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ সরকার। ‘জয় বাংলা’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয় স্লোগান। জয় বাংলা ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি শুরু হয়েছিল কীভাবে? জানা যায় ১৯৬৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একটি সভা হয়। সে সভায় ১৭ মার্চ শিক্ষা দিবস পালনের কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা চলছিল। আলোচনার একপর্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা আফতাব উদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন) এবং দর্শন বিভাগের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক চিশতি শাহ হেলালুর রহমান (একাত্তরে শহীদ হন) ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি প্রথম উচ্চারণ করেন। সভা চলাকালীন সময়ে আকস্মিকভাবে সবাইকে চমকে দিয়ে তারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন। সঙ্গে সঙ্গে সাত-আটজন কর্মী প্রতিধ্বনি করে ওঠেন ‘জয় বাংলা’। ওইসময় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ হাতে লেখা তিন পাতার একটি পত্রিকাও প্রকাশ করে। যার নাম ছিল ‘জয় বাংলা’। শুরুর দিকে এই স্লোগান নিয়ে তৎকালীন নেতা-কর্মীদের অনেকের ভেতরই নানা আলোচনা-পর্যালোচনা হতে থাকে। নেতাদের অনেকেই আপত্তিও তোলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন জয় বাংলা’র পক্ষে। ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭০। পল্টনে বিশাল জনসভা চলছে। মঞ্চের শামিয়ানায় আটকানো হার্ডবোর্ডের উপর লাগানো কাঠের খণ্ডে উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা হয়েছে ‘জয় বাংলা’ শব্দ দুটি। ওই সভায় সভাপতিত্ব করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাজউদ্দীন আহমদের বক্তব্যের পরই তিনি মঞ্চে বসা অবস্থায় বললেন, ‘সিরাজ (সিরাজুল আলম খান) স্লোগান দে’। দ্রুত মাইকের সামনে গিয়ে সিরাজুল আলম খান আবেগঘন কণ্ঠে বললেন: আসুন, সাত কোটি মানুষের পক্ষ হয়ে আমরা সকলকে জানিয়ে দেই, যার কণ্ঠে যতো জোর আছে আমরা একসঙ্গে বলে উঠি ‘জয় বাংলা’। লাখো কণ্ঠে তখন আওয়াজ ওঠে ‘জয় বাংলা’। এমন ইতিহাসের কথা জানা যায় বিভিন্ন গ্রন্থ ও আত্মজীবনী থেকে। ১৯৭০-এর ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বিশাল এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে প্রথম যুক্ত করেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি। ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়েই তার অবিস্মরণীয় বক্তৃতা শেষ করেছিলেন। জয় বাংলা বাঙালির আত্মপরিচয়ের স্লোগান। এ স্লোগান বাঙালি জাতিকে করেছে ঐক্যবদ্ধ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × three =