এক সময়ের সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য  বাগমারা এখন শান্তির নীড়

সালেক সুফী: রাজশাহীর প্রান্তিক অঞ্চল বাগমারা একসময় নোংরা রাজনীতির কারণে একসময় সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য হলেও এখন ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। আমি সম্প্রতি ঝটিকা সফরে রাজশাহী আর বাগমারায় দুই দিন ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছি।

আমার শকুন চোখে সমগ্র রাজশাহী অঞ্চলকেই অত্যন্ত সম্ভাবনাময় মনে হলেও বাগমারাকে অনেক প্রাণস্পর্শী মনে হয়েছে। জানিনা কেন এই শান্তিনিবাস প্রথমে সর্বহারাদের ঘাঁটি এবং একসময় কুখ্যাত বাংলাভাইয়ের অভয়ারণ্য হয়েছিল।  নাহলে জাতীয় উন্নয়নে বাগমারা আরো অনেক অবদান রাখতে পারতো।

বহুদিন থেকেই ইচ্ছা ছিল আমার অনুজপ্রতিম প্রখ্যাত সাংবাদিক (এনার্জি এবং পাওয়ার পত্রিকার সম্পাদক) মোল্লাহ আমজাদের পৈতৃক নিবাস বাগমারা দেখার আর জানার।  আমজাদের সহধর্মিনী রীপা আমার অত্যন্ত আদূরে বোন। ভিন্ন কারণে রীপা আমাদের সফরসঙ্গী হতে না পারলেও আমজাদ ছিল।

ঢাকা থেকে রাজশাহী যাত্রাপথে আমার হাতেগড়া বা পরিকল্পনায় থাকা প্রাকৃতিক গ্যাসের স্টেশন আছে। প্রায় সবাই আমাকে আমন্ত্রণ করেছিল তাদের সাথে সময় কাটানোর।  সময় সক্ষিপ্ত থাকায় শুধুমাত্র হাটিকুমরুল ম্যানিফোল্ড স্টেশনে যাত্রাবিরতি করি। হাটিকুমরুল থেকে একটি পাইপ লাইন বগুড়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত; যা এখন দিনাজপুর হয়ে রংপুর পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। অপর দিকে হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া হয়ে একটি পাইপলাইন রাজশাহী গেছে।  বনপাড়া থেকে আরেকটি পাইপলাইন ঈশ্বরদী – ভেড়ামারা – কুষ্টিয়া – যশোর হয়ে খুলনা পর্যন্ত বিস্তৃত। আমরা রাজশাহী শহরে গ্যাস সরবরাহের জন্য নির্মিত রাজশাহী সিটি গেট স্টেশন পরিদর্শন করেছি।  এগুলো নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন আলাদা  করে লিখবো।

রাজশাহী সফরের প্রথম রাত এবং পরের দিন দুপুর পর্যন্ত কেটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে। সন্ধ্যায় ভাইস চ্যান্সেলর মহোদয়ের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লিংকেজ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ মত বিনিময় হয়।  রাতে আমরা অতিথি ভবনে অবস্থান করি।  রাজশাহীর প্রখ্যাত রাহমানিয়া রেস্টুরেন্টে উপাদেয় রাতের খাবার খাই। রাতে পদ্মার পাড়সহ গোটা রাজশাহী শহরকে রমণীয় মনে হয়।

পরদিন সকালে আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত ব্যাতিক্রমধর্মী স্মৃতিসৌধ এবং অসাধারণ সংগ্রহশালা পরিদর্শন করি। এগুলো নিয়েও পরের পর্বে লিখবো।

রাজশাহী থেকে বাগমারা যাত্রাপথ আমার অনেক ভালো লেগেছে।  সড়ক অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ হলেও মসৃণ এবং দুইপাশে সবুজের সমারোহে আকর্ষণীয়। পানের বরজ, মাছের ঘের, আমের বাগান আমাকে শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।  ভুলে যাই প্রচণ্ড গরম আর আর্দ্রতায় কাতর হবার অনুভূতি।

বাগমারা পৌঁছানো মাত্রই আমজাদের ছেলেবেলার খেলার সাথীরা উপস্থিত।  এই সেই বাগমারা যেখানে একসময় সর্বহারা সন্ত্রাসীরা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। প্রতিশোধ নেশায় বাংলাভাই  একের পর এক মানুষ নির্মমভাবে খুন করেছে। চায়ের দোকানে বসে মিষ্টি আর মালাই চা খেতে খেতে প্রশ্ন করলাম,সবুজ পরিবেশ কেন সন্ত্রাসে হলুদ হয়েছিল?

জবাবে আমজাদ এবং বন্ধুরা জানালো, একসময় সর্বহারা বাহিনী সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। প্রতিশোধ হিসাবে বগুড়া অঞ্চলে বাংলাভাই বাহিনী গড়ে উঠে। প্রথম দিকে বাগমারাবাসি মোটামুটি সমর্থন দিলেও কিছুদিনের মাঝে বাংলাভাই বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে।  বাংলাভাই বাহিনীর উত্থান আর পতন নাটকীয় ভাবেই ঘটে।

আমজাদ আমাকে ওদের পারিবারিক আম বাগান আর মাছের পুকুর দেখায়। আমি পরের দিন সকালে মাছ ধরার বায়না ধরি। বাগমারার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওদের পারিবারিক বাসস্থানটি আমার মরুর মাঝে মরুদ্যান মনে হয়। সন্ধ্যায় আমরা ওখানে বসে এশিয়া কাপ ক্রিকেট উপভোগ করি। সবার আন্তরিকতায় গুন্ গুন্ করতে থাকি “ভাইয়ের মায়ের এতো স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ…”

রাতে মুষলধারায় বৃষ্টি নামে।  যথারীতি ভোর রাতে উঠে লেখালেখির পর নামাজ পড়ে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেই। আমাদের সাথী ছিল আমজাদের ঘনিষ্ট বন্ধু রফিক যাকে আমরা রাজশাহী থেকেই সঙ্গী করেছিলাম। দুই ঘণ্টায় বেশ কিছু মাছ ধরা পড়ে।  প্রচণ্ড গরম আর আমাদের ফেরার সময় হয়ে আসায় ঘরে ফিরে সকালের নাস্তা গ্রহণ করি। ঘুরে ঘুরে আমজাদের পারিবারিক সম্পত্তি পরিদর্শন করি।  উপাদেয় খাবার খেয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে যাত্রা করি।

ঝটিকা সফরে স্বল্পকালীন অবস্থান সত্ত্বেও আমার কাছে বাগমারা নানা কারণে শান্তির নীড় এবং বিপুল সম্ভাবনাময় মনে হয়। দেখলাম, বাংলাদেশের মিষ্টি পানের একটা বিরাট অংশ এখানে চাষ হচ্ছে, অসংখ্য মাছের পুকুর থেকে প্রতিদিন তাজা মাছ ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বিশেষ ব্যবস্থায় পাঠানো হচ্ছে। সুস্বাদু আম, পেয়ারা, পেঁপে সহ অন্যান্য ফলের ব্যাপক চাষ হচ্ছে।

কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্ভরশীল না হওয়ায় এবং গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা না থাকায় শিল্প বলতে কিছু নেই। দেখলাম, তরুণ সমাজ বেশ বেকার।  আমি বাগমারার কাঁচামাল, বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ যুবকদের কাজে লাগিয়ে কৃষিভিত্তিক শিপ্ল প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করছি। এখানে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। মোদ্দা কথা একসময়ের সন্ত্রাসী জনপদ এখন শান্তির নীড় বলেই আমার কাছে মনে ধরেছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three − 3 =