এটা আমার জীবনে বিশাল এক পাওয়া

স্বাধীনতার পর কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। উনার বিছানার পাশে একটা ফরাশে হারমোনিয়াম-তবলা রাখা থাকত। যত শিল্পী আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, যাঁরা তাঁকে গান শোনাতে চাইতেন, ওখানে বসে গাইতেন। আমি তখন কিশোরী। আমার বড় বোন জান্নাত আরা। সে-ও ছোট। আমাদের পিতার হাত ধরে প্রথম কাজী নজরুল ইসলামের বাড়ি যাই। আমাদের পিতা এ এইচ এম আবদুল হাই আমাদের দুজনকে নিয়ে কবির ধানমন্ডির বাসায় যান।

আমাদের দেখে সবাই খুব আগ্রহভরে বললেন, তোমরা গান শোনাও। নজরুলের রুমের দরজার কাছে যেতেই কপাট বন্ধ হয়ে গেল। তখন উনার কিছু পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছিল। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে আমাদের ডাকা হলো। আমরা দুই বোন বসে গেলাম। গান শুরু করলাম, ‘নীলাম্বরী শাড়ি পরে নীল যমুনায় কে যায়’। গানটি ধরলেন জান্নাত আরা। আমি তাঁর সঙ্গ নিলাম।

গানের একপর্যায়ে কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যে অস্থিরতা দেখা গেল। উনি কী যেন বলতে চাইছেন! আমরা তো ছোট। আমি খুবই ভয় পাচ্ছিলাম। একপর্যায়ে উনি আর শুয়ে থাকতে পারলেন না। বসে পড়লেন। ‘বাহ্‌’ কথাটা বেরিয়ে এল তাঁর মুখ দিয়ে। উনি বাহ্‌ বলাতে আমরা দুই বোন ভয়ে দৌড়ে বারান্দায়। সবাই আবার আমাদের ধরে নিয়ে এল। বলল, উনি ব্যস বলেননি, বাহ্‌ বলেছেন।

উনি কোনো গান পছন্দ করলে এই কথাটা বলেন। আমরা দুই বোন আবার গেলাম। গানটা শেষ করে তারপর উঠলাম। সেই থেকে আমার উপলব্ধি, যদিও আমরা তাঁকে নির্বাক বলি, তবে তাঁর উপলব্ধির এতটুকু কমতি কিন্তু আমি দেখিনি। যেভাবে উনি অস্থির চিত্তে উঠে বসলেন, ভালো লাগার চূড়ান্ত পর্যায়ে উনি আছেন, বোঝাই যাচ্ছিল। তাই আমার মনে হয়, তিনি একেবারে নির্বাক বা বুঝতেন না; এমন নয়। তাঁর উপলব্ধি পুরো প্রখর ছিল।

এটা আমার জীবনের একটা বিশাল পাওয়া যে কাজী নজরুল ইসলামকে অন্তত নিজের চোখে দেখেছি। তাঁর সামনে বসে গান শোনানোর সৌভাগ্য হয়েছে। এটা আর কতজনের হয়!

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × three =