এবার একটু ঘুরে দাঁড়াও বিপিএল

নিবিড় চৌধুরী

সময়টা এখন টি-টোয়েন্টির। ক্রিকেটের আদি সংস্করণ টেস্ট নিয়ে যতোই দুশ্চিন্তা বাড়ছে, তার সঙ্গে যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট। এখন তো প্রায় প্রতিটি টেস্ট খেলুড়ে দেশেই প্রতি মৌসুমে ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টি আয়োজিত হচ্ছে। নতুন বছরের শুরুতেই একসঙ্গে চলছে চারটি ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ – অস্ট্রেলিয়ার বিগ ব্যাশ (বিবিএল), বাংলাদেশের বিপিএল, দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ২০, আরব আমিরাতের আইএলটি২০। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হবে পাকিস্তানের পিএসএল। পরের মাসে ভারতে আইপিএল। দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সূচির ভিড়ে এত এত টুর্নামেন্ট, ভাবা যায়! ক্রিকেটারদের তো নাভিশ্বাস ওঠার কথা!

বলতে গেলে, ফ্র্যাঞ্চাইজি টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বিপিএল বেশ পুরোনো। আইপিএল (২০০৮) ও বিগ ব্যাশের (২০১১-১২) পরেই ২০১২ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) মাঠে নিয়ে আসে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আইপিএল ও বিবিএলে উন্নতি এলেও বিপিএলে তার ছোঁয়া লাগেনি। আগের দুই ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ জনপ্রিয়তা ধরে রাখলেও বিপিএল পারেনি। এমনকি পরে শুরু হওয়া সিপিএল (২০১৩) ও পিএসএলও (২০১৬) এখন বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু আয়োজনের দিক থেকে বিপিএল এক যুগ কাটিয়ে ফেললেও খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। কেন হয়নি?

একটি দেশের ক্রিকেটের বড় ভূমিকাটা রেখে থাকে পাইপলাইন, অর্থাৎ পরবর্তী প্রজন্মের ক্রিকেটাররা। শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়দের বিদায়ের পর ভারতকে ক্রিকেটে কখনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। কারণটা অনুমেয়, পাইপলাইন শক্ত ছিল। শচীন-সৌরভদের বিদায় বেলায় উঠে এসেছিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি, বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মাদের মতো ক্রিকেটাররা। আর ভারতের এখন যা অবস্থা, জাতীয় দল ছাড়া আর তিন-চারটা দল বানাতে পারে। এখন অবশ্য ভারত-ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া সেটিই করে আসছে। তাদের একদল ঘরের মাটিতে টেস্ট খেলছে তো আরেকদল সীমিত ওভারের ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে সফরে। বড় কোনো তারকা চোটে পড়লেও সমস্যা নেই। বিকল্প আছে। আমাদের এখানে সেসব তো ভাবাই যায় না। সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবাল-মুশফিকুর রহিম না থাকলে তাদের জায়গায় কে খেলবেন, সেসব নিয়ে ভাবতেই গলদঘর্ম হতে হয়।

আমরা এখন বাংলাদেশের কথিত পঞ্চপাণ্ডবর বিকল্প খুঁজে পাইনি। যারা আসছেন, তারা কিছুদিন ভালো খেললেও পরে দলে জায়গা ধরে রাখতে পারছেন না। শ্রীলঙ্কায় কুমার সাঙ্গাকারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে, তিলকারত্নে দিলশান, মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো তারকারা বছর দুয়েকের ব্যবধানে অবসর নেওয়ার পর দলটি যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। এখন থাবার জন্য সিংহলিজদের নখরে নেই আগের সেই শক্তি। পাইপলাইন শক্ত না হওয়ায় এই সমস্যায় পড়েছে লঙ্কানরা। বাংলাদেশকেও না সামনে এই সমস্যায় পড়তে না হয়।

আপাতদৃষ্টিতে, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে কেবল বিনোদনমূলক ভাবা হলেও এর নেতি ও ইতিবাচক দুই প্রভাবই আছে। খেলাটা এখন কেবল অর্থের ঝনঝনানি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে যারা আগে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট খেলে সামান্য কিছু অর্থ পেতো, তারা এখন টাকা-পয়সা পাচ্ছে। ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এসব ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে ঝলক দেখিয়ে অনেকে জায়গা করে নিচ্ছে জাতীয় দলে, পূরণ হচ্ছে স্বপ্ন। ভারতের সঞ্জু স্যামসন, সূর্যকুমার যাদব, রিংকু সিংকে আবিষ্কার করা গেছে আইপিএল থেকে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দৃশ্যটা ভিন্ন। খুব বেশি তারকা কি উঠে এসেছেন বিপিএল থেকে? যাদের আমরা বাংলাদেশ জাতীয় দলে দেখি তাদের অধিকাংশ উঠে এসেছেন বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণি ও লিস্ট-এ ক্রিকেট এনসিএল-বিসিএল খেলে। তাহলে বিপিএল কি শুধু নামসর্বস্ব আয়োজন?

এসব আলোচনা-সমালোচনার মাঝে গত ১৯ জানুয়ারি সাত দল – কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস, রংপুর রাইডার্স, খুলনা টাইগার্স, চট্টগ্রাম চ্যালেঞ্জার্স, ফরচুন বরিশাল, সিলেট স্টাইকার্স ও দুর্দান্ত ঢাকাকে নিয়ে শুরু হয়েছে বিপিএলের ১০ম আসর। উদ্বোধনী ম্যাচে আগের দুবার এবং সর্বোচ্চ চারবারের শিরোপাজয়ী কুমিল্লাকে হারিয়ে দারুণ শুরু করেছে বরিশাল। রাজনৈতিক কারণে ২০১৪ ও করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ ছাড়া প্রতিবার মাঠে গড়িয়েছে বিপিএল। তবে শুরুর দিকে যে জাকজমক ছিল, সেটি এখন মলিন। আগের মতো তারকারাও নেই। একসময় বিপিএল মাতিয়ে গেছেন ক্রিস গেইল-এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতোন সীমিত ওভারের সেরা তারকারা। এখন তেমন তারকা নেই বললেই চলে। বিদেশি কোটায় যারা আসেন তারাও কয়েক ম্যাচ খেলে অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি খেলতে উড়াল দেন।

মাঠে দর্শকখরা দেখে বুঝা যায় না বিপিএল চলছে। গত মৌসুমেও মাঠে দর্শকের উপস্থিতি ছিল হাতেগোনা। এবার অবশ্য শীত উপেক্ষা করে ঢাকা পর্বে কিছু দর্শক দেখা গেছে। ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রাম – এই তিন পর্বের বিপিএলে আশা করা যায়, দর্শক সমাগম হবে। এবারের বিপিএলে বিদেশিদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক বাবর আজম। নিজের প্রথম ম্যাচেই অপরাজিত ফিফটিতে ম্যাচসেরাও হয়েছেন রংপুর রাইডার্স ব্যাটার। তার জাতীয় দলের সতীর্থ মোহাম্মদ রিজওয়ান তো আছেনই। এছাড়া বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেল, সুনীল নারাইন, ইংল্যান্ডের মঈন আলী, আফগানিস্তানের রশিদ খান, শ্রীলঙ্কার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার মতোন তারকারা যদি এসে পড়েন তবে শীতে বিপিএল উষ্ণতা ছড়াবে, এমনটা আশা করায় যায়।

তবে তাদের অনেককে হয়তো কদিন পর ছেড়েও দিতে হবে। কারণ, ফেব্রুয়ারির মাঝখানে শুরু হচ্ছে পিএসএল। আর বিপিএলের ফাইনাল ১ মার্চ। বেশ কয়েকজন বাংলাদেশিও পাকিস্তান যেতে পারেন পিএসএল খেলতে। যার কারণে, সেমিফাইনাল-ফাইনাল না আবার তারকাশূন্য হয়ে পড়ে! এমনিতে বিপিএলে ভারতের কথা বাদই দিলাম; অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, নিউ জিল্যান্ডের মতো দলের তারকা ক্রিকেটারদের পাওয়া যায় না। একই সময়ে এসএ২০ লিগ না চললে হয়তো বেশ কয়েকজন দক্ষিণ আফ্রিকানকে দেখা যেত। বিভিন্ন দেশের তারকা খেলোয়াড়রা যদি আসতেন, তাদের সঙ্গে ড্রেসিংরুম শেয়ার করার পাশাপাশি অনুশীলনে নিজেদের কলাকৌশলের অনেককিছু শিখে নিতে পারত দেশের তরুণ খেলোয়াড়েরা। সাকিব আল হাসান-মোস্তাফিজুর রহমান আইপিএল খেলার সুবাদে তাদের সতীর্থদের থেকে শিখেছেন অনেক কিছু।

চাইলে বিশে^র সেরা ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মধ্যে দুই-তিনে থাকা সম্ভব ছিল বিপিএলের। সেই আশা নিয়েই শুরু হয়েছিল এই লিগ। ধনী ক্রিকেট বোর্ডগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থানও বেশ উঁচুতে, চারে। কিন্তু কর্মকর্তাদের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার অভাবে সেটি হয়নি, এগোয়নি দেশের ক্রিকেট। বিশে^র অন্যান্য ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আফগানিস্তানের মতো ক্রিকেটারদের চাহিদা বেশি। খুব কম সুযোগই পায় বাংলাদেশিরা। বিপিএল যদি আরও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা যেত, ভালো ক্রিকেটার বেরিয়ে আসত। তাদের সুযোগ থাকত বিদেশের লিগগুলোতে খেলার। সঙ্গে মিটত জাতীয় দলের টি-টোয়েন্টির সমস্যাও। হিটার নেই হিটার নেই, বলে যে আফসোস সেটি অন্তত খানিক হলেও ঘুচত। তবে বিপিএল সেসবের খুব কমই মিটাতে পেরেছে।

আইপিএলের কথায় চিন্তা করুন। তাদের স্পন্সর সত্ব কিনতেই লাইন পড়ে যায়। টাটা পাঁচ বছরের জন্য আইপিএল টাইটেল স্পন্সরের জন্য খরচ করছে ৫ হাজার কোটি রুপি! বুঝলাম, ভারত ক্রিকেট পাগল দেশ। সাফল্য তেমন না পেলেও গত আড়াই দশকে বাংলাদেশেও ক্রিকেট পাগল দেশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এখানে বিপিএল আয়োজনের জন্য স্পন্সর খুঁজে পাওয়ায় মুশকিল। আয়োজক থেকে শুরু করে ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকদের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্নও ওঠে। ২০২৪ বিপিএল শুরুর আগেই সামাজিক মাধ্যমে বেশ কয়েক ক্রিকেটারের অভিযোগ, তারা গত সংস্করণের টাকাই এখনো পাননি। ঢাকা পর্বের শুরুতে মাঠে এ নিয়ে বেশ কয়েকজন প্রতিবাদও জানান। এখানের ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর নামও প্রায় প্রতি সংস্করণে পাল্টে যায়। এক ঢাকা ও সিলেট ফ্র্যাঞ্চাইজির নামই পাল্টেছে সর্বোচ্চ ছয়বার করে! এ যেন কোনো পাড়ার দলের টুর্নামেন্ট! যা একটু এখন পর্যন্ত পেশাদারিত্ব দেখা গেছে, শুধু কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের মধ্যে।

আইপিএলে মেগা নিলাম না হোক, মিনি নিলামগুলো নিয়েও মানুষের আগ্রহের শেষ থাকে না। তবে বিপিএলে কখন কার সঙ্গে চুক্তি হচ্ছে, কাকে ছেড়ে দিচ্ছে, কাকে রেখে দিচ্ছে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে তা নিয়ে কারও হদিশও থাকে না। অথচ এসব দেখে কে বলবে, এ দেশের মানুষ মাঠে জাতীয় দলের জার্সি পরা সাকিব-মুশফিকদের জন্য গলা ফাটায়! এমন নয় যে, বিপিএলে উন্নতি আনার সুযোগ নেই। যেমন-তেমন আয়োজন না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনামাফিকভাবে এগোলে আবারও প্রাণ ফিরবে টুর্নামেন্টের। দর্শক মাঠমুখি হবে। কিন্তু শত আলোচনা-সমালোচনার পরও সেসব দেখা যায় না। আমাদের দেশের আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামের অবস্থায় এমন যে, রাতে ম্যাচ চালানোর জন্য এক স্টেডিয়ামের ফ্লাইডলাইট খুলে অন্য স্টেডিয়ামে নিতে হয়। সেটিই তো দেখা গেল, সিলেট পর্বের আগে। রাজশাহী স্টেডিয়ামে বাল্ব নেওয়া হয়েছে সিলেট স্টেডিয়ামে। নেই ডিআরএস ব্যবস্থা। সম্প্রচার কেমন ঘোলা, যেন ভালো ক্যামেরার অভাব। টিভি দর্শকেরা স্পষ্ট ছবি দেখতেই পছন্দ করে। সেটিতেও তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।

সর্বোপরি বিপিএল নিয়ে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের অভিযোগের শেষ নেই। তার সঙ্গে এবার শুরুতেই যোগ হয়েছে, পুরোপুরি ফিট না হয়েই মাশরাফি-সাকিবের খেলা। তাদের দলে থাকা মানেই যে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর লাভ, সেই চিন্তা থেকেই হয়তো এ দুই তারকার এভাবে খেলে যাওয়া। কিন্তু সেটি শেষ পর্যন্ত পরবর্তী প্রজন্মের জন্য খারাপ উদাহরণই তৈরি করে। শুরুর দিকে বিসিবি জানিয়েছিল, আইপিএলের পরে বিপিএলের অবস্থান তৈরি করবে। গত বছর এসএ২০ (৪ মিলিয়ন ডলার) লিগ আসার আগে প্রাইজ মানিতে আইপিএলের (৫.৬ মিলিয়ন ডলার) পরে ছিল বিপিএলের (২.২ মিলিয়ন ডলার) অবস্থান। কিন্তু প্রাইজ মানিতে অবস্থান খুব বেশি নড়বড়ে না হলেও বিপিএল নিয়ে মাতামাতি যে কমে এসেছে, সেটি হয়তো বিসিবি, বিপিএল কর্তৃপক্ষ ও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোও বুঝে। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে হলে এখান থেকে ঘুরে না দাঁড়ালে হয়তো একদিন বিপিএলের মান নামতে নামতে তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। সেই দিন না আসুক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × five =