নীলাঞ্জনা নীলা
অনিল কাপুর শুধু অসাধারণ অভিনয়ই করেন না তিনি সেইসাথে সফল প্রযোজক ও গায়ক। বলিউডে সফলতার পাশাপাশি তিনি সফল হয়েছেন হলিউডের সিনেমাতেও। অনিল কাপুরের হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় উমেষ মেহরার ‘হামারে তুমহারে’ সিনেমায় একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। ১৯৮০ সালে প্রধান অভিনেতা হিসেবে বর্ষীয়ান পরিচালক বাপু পরিচালিত তেলুগু সিনেমা ‘ভামসা ভ্রুক্ষাম’ এ অভিনয় করেন। তার অসাধারণ অভিনয়ের জন্য ফিল্মফেয়ার সহ অনেক পুরস্কার পান। সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেন ইন্দ্র কুমারের ‘ব্যথা’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমা হলো: ‘সাত দিন মেরি জাং’, ‘জাংবাজ’, ‘কার্মা’, ‘মি. ইন্ডিয়া’, ‘ভিরাসাত’ (এই সিনেমার জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেন), ‘বিবি নাম্বার ওয়ান’, ‘তাল’ (এই সিনেমার জন্য তিনি তার দ্বিতীয় ফিল্মফেয়ার সেরা সহ-অভিনেতার পুরস্কার অর্জন করেন), ‘পুকার’ (এই সিনেমার জন্য তিনি সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেন), ‘নো এন্ট্রি’ (এই সিনেমার জন্যেও তিনি সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান), ‘ওয়েলকাম’, ‘রেস’ এবং ‘রেস ২’ । তার ‘স্লামডগ মিলিয়নিয়ার’ সিনেমার জন্য তিনি স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড অ্যাওয়ার্ড ফর আউটস্ট্যান্ডিং পাফরমেন্স বাই এ কাস্ট ইন এ মোশন পিকচার অর্জন করেন। ৮০ দশকে তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। একের পর এক সিনেমা সফল হতে থাকে। ‘মি. ইন্ডিয়া’ তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। প্রথমে মি. ইন্ডিয়াতে কাজ করতে চাননি। কিন্তু এরপরে মি. ইন্ডিয়াতে তার অভিনয় সকলকে তাক লাগিয়ে দেয়। ‘মি. ইন্ডিয়া’ ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
অনিল কাপুরের জন্ম ১৯৫৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুম্বাই শহরে। মুম্বাইয়ের চেম্বুরেই তিনি বেড়ে উঠেন। তার অভিনয় ক্যারিয়ারের শুরুতে প্রচুর স্ট্রাগল করতে হয়। অভাবের তাড়নায় তিনি বেশ কিছুদিন কাজ করেন রাজ কাপুরের গ্যারেজেও। দুর্দান্ত অভিনয় করলেও তাকে কখনো মেইন ক্যারেক্টার দেওয়া হতো না। ইন্ড্রাস্টির সবাই বলতো, সে হয়তো ভালো অভিনয় করে কিন্তু কখনো স্টার হতে পারবে না। তার ব্যক্তিত্ব ও স্টাইল নিয়ে অনেক আলোচনা হতো। শুরুতে অনেকেই তাকে কাজে নিতে চাইতেন না। আর নিলেও ছোট কোনো ক্যারেক্টারে অভিনয়ের সুযোগ দিতেন। অনিল কাপুর সে সময়টায় ভেঙে পড়েননি। কোনো দ্বিধা ছাড়াই যখন যে কাজের সুযোগ পেতেন তা গ্রহণ করতেন।
কিন্তু এখন তার ব্যক্তিত্ব ও স্টাইলের ভক্ত গোটা বলিউড। তাকে অনুকরণ করে নিজেদের স্টাইল করছে অনেকেই। তার ফ্যাশন সেন্স নিয়ে এখন অনেক আলোচনা। তবে তার এই স্টাইলের পেছনে হাত রয়েছে তার সহধর্মিনী সুনিতা কাপুরের। দীর্ঘ পাঁচ বছর প্রেমের পর তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অনিল কাপুরের ক্যারিয়ার জীবনে যখন উত্থান-পতন চলছে তখনি সুনিতা কাপুরের সাথে তার পরিচয় হয়। অনিল কাপুর সুনিতার কণ্ঠের প্রেমে পড়েন এবং পরিচয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রেমের প্রস্তাব দেন। সুনিতা তখন মডেলিং করছেন। বেশ নামডাক ছিল সেইসময়ে তার। আর অনিল কাপুর সবেমাত্র অভিনয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সুনিতা তার প্রতিটা খারাপ সময়ে বন্ধুর মতো তার পাশে ছিলেন। অনিল কাপুরকে বিভিন্ন জায়গায় বলতে শোনা গেছে, সুনিতা তাকে হাত খরচও দিতেন। কারণ তিনি পরিবার থেকে কোনো প্রকার আর্থিক সহযোগিতা নিতেন না। যখন ক্যারিয়ার নিয়ে তিনি প্রচণ্ড হতাশ সময় পার করছেন সুনিতা তখন নিজের হাজারো কাজ প্রত্যাখ্যান করে তাকে সময় দিতেন। অনিল কাপুর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সুনিতাকে প্রেমের প্রস্তাব খুব দ্রুত দিলেও বিয়ে করেন অনেক দেরিতে। কারণ তিনি সুনিতাকে তার প্রাপ্য সবকিছু দিতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি আগে নিজের ভিত শক্ত করেন এরপর সুনিতাকে তার ঘরে নিয়ে আসেন। বিয়ের সময় অনেকেই তাকে বলেছিলেন বিয়ে ক্যারিয়ারে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু তিনি কখনো সেসব কথায় কান দেননি।
সুনিতা তার ক্যারিয়ার গঠনে অনেক সাহায্য করেন। কখন কোন প্রোগামে কোন পোশাক পরতে হবে, কোন জুতা মানানসই হবে, কি রঙ পরবে সব সিদ্ধান্ত সুনিতা নেন। ১৯৮৪ সালে ১৯ মে তারা সাতপাকে বাঁধা পড়েছিলেন। অনিল কাপুর তাদের বিবাহবার্ষিকীতে দু’জনের ছবি পোস্ট করে লেখেন ‘১৯ মে আমার জীবনে সেরা দিন’। বর্তমান দুনিয়ায় সম্পর্কের বাঁধন যখন হালকা হয়ে যাচ্ছে তখন অনিল কাপুর ও সুনিতা কাপুরের জুটি উদাহরণ হয়ে আছে।
অনিল কাপুরের সাথে মাধুরি দীক্ষিতের প্রেমের গুঞ্জন ছিল বেশ অনেক বছর। তারা একসাথে জুটি বেঁধে অনেক সফল সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এই ব্যাপারে অনেক পুরোনো এক সাক্ষাৎকার মাধুরি দীক্ষিত বলেছিলেন, তিনি সুযোগ পেলেও কখনো অনিল কাপুরকে বিয়ে করবেন না কারণ তিনি যেমন ছেলে চান তেমন অনিল না। কারণ অনিল কাপুর নাকি স্বভাবে খুব সংবেদনশীল। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘টোটাল ধামাল’ ছবিতে তাদের শেষবার একসঙ্গে দেখা গিয়েছিল।
অনিল-সুনিতার তিন সন্তান। দুই মেয়ে সোনম কাপুর, রিয়া কাপুর আর এক ছেলে হর্ষবর্ধন কাপুর। তার কন্যা সোনম কাপুর বলিউডের বেশ জনপ্রিয় অভিনেত্রী। তিনি বাবার আদর্শে বড় হয়েছেন এবং নিজ যোগ্যতায় কাজ করে যাচ্ছেন। বাবা ও মেয়ের মধ্যে বেশ মধুর সম্পর্ক নজরে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে। বাবার জন্মদিনে সোনম লিখেন ‘পৃথিবীর সেরা বাবাকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা। তোমায় ভালোবাসি আমি। তুমিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তুমি আমাদের জন্য যা যা করেছ, সবার সেই সৌভাগ্য হওয়া উচিত। ভালোবাসি তোমায় বাবা।’ সোনম কাপুর বাবার পরিচয় ছাড়াও নিজের আলাদা করে পরিচয় তৈরি করেছেন।
অনিল কাপুরের কাজের পাশাপাশি সবচেয়ে যে ব্যাপার নিয়ে আলোচনা হয় তা হলো বয়স ৬৬ পার করেও কীভাবে এখনো যৌবন ধরে রেখেছেন। অনিল কিভাবে এখনো নিজেকে ২০ বছর আগের মতো ধরে রেখেছেন তা জানার আগ্রহ সবার। কারণ যত তার বয়স বাড়ছে, ততই তিনি যৌবন ফিরে পাচ্ছেন। তার এই ফিটনেস নিয়ে রয়েছে হাজারো গুজব। কেউ কেউ বলেন অনিল কাপুর বিশেষ ধরনের পানীয় পান করেন যা বয়স কমিয়ে রাখতে সাহায্য করে। অনেকে বলেন অনিল কাপুর প্লাস্টিক সার্জারি করেছেন। এইসব গুজবের জবাব অনিল কাপুর হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটা সাক্ষাৎকারে নিজের সৌন্দর্যের রহস্য নিয়ে কথা বলেছেন। অনিল কাপুর মনে করেন মানুষের জীবন যেমন তার প্রতিচ্ছবিই তেমনি তার চেহারা ও ব্যক্তিত্বে প্রকাশ পায়। তিনি সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দেন তাকে পরিপূর্ণ জীবন উপহার দেওয়ার জন্য। আর্থিক, মানসিক, শারীরিক সবভাবে তিনি সচ্ছলভাবে আছেন। আর এই সচ্ছলতাই তার সৌন্দর্যে প্রকাশ পায় বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, আমরা দিনে ২৪ ঘণ্টা সময় পাই। যদি এই ২৪ ঘণ্টা থেকে নিজেকে ১ ঘণ্টা সময় দিতে না পারি তাহলে এতো সময় দিয়ে কি হবে?
অনিল কাপুর জানান, শরীর ঠিক রাখতে প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করতে হবে। ঘুম ভালো হলে শরীরের পাশাপাশি মনও ভালো থাকবে। ভালো ঘুমের জন্যই তিনি সবসময় সতেজ থাকেন। কঠোর নিয়মকানুনের মধ্যে জীবনযাপন করেন তিনি।
যোগব্যায়াম ভীষণ প্রিয় তার। তিনি ঘুম থেকে উঠে হালকা গরম পানি পান করে এক ঘণ্টা ইয়োগা করেন। এছাড়া তার বাড়িতে জিম রয়েছে। ট্রেইনারের সাহায্য নিয়ে তিনি রোজ জিম করেন। সময় পেলেই বের হয়ে যান জগিং করতে। ব্যায়ামের পাশাপাশি তিনি কঠোর ডায়েট মেনে চলেন। খাদ্যতালিকায় থাকে প্রোটিন বেশি ও কার্বোহাইড্রেট কম। তিনি রোজ দুটি ডিম খান এবং খাবারের পাতে সবুজ শাকসবজি ও সালাদ থাকে। পর্যাপ্ত প্রোটিনের জন্য ত্বক এখনো উজ্জ্বল ও সুন্দর রয়েছে। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন ত্বকের যত্নে তিনি ব্যবহার করেন বেশ কিছু স্কিন প্রোডাক্ট।
অনিল কাপুর জানান, তিনি মাঝে মাঝে নিজের পছন্দের খাবারও চেখে দেখেন। ছোট মেয়ে রিয়ার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই রাস্তার খাবার উপভোগ করেন তিনি। আবার ওয়ার্ক-আউট করে তা পুষিয়ে নেন। ব্যালেন্স আনতে তিনি সপ্তাহে ২৪ ঘণ্টা পানি ছাড়া কিছুই খান না। এতে শরীর থেকে সব দূষিত পদার্থ বের হয়ে যায়।
অনিল কাপুর প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করেন এবং নানা ধরনের ডিটক্স ও ফলের রস খান। অনিল কাপুর বলেন, সঠিক রুটিন অনুসরণ করার পাশাপাশি মানসিক শান্তির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে কোনোকিছু করেই ভালো থাকা যাবে না, এর ছাপ চেহারাতে পড়বেই। তাই সবার আগে নিজের মন তরতাজা রাখতে হবে। তবেই শারিরীক ও মানসিকভাবে যৌবন ধরে রাখা যাবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি