এশিয়া কাপ ২০২৩: ঘোষিত বাংলাদেশ দলে রিয়াদ উপেক্ষিত

সালেক সুফী

অনেক নাটকের পর আসন্ন এশিয়া কাপ ২০২৩ খেলার জন্য বাংলাদেশ জাতীয় দল ঘোষণা করেছে বিসিবি নির্বাচক ত্রয়ী মিনহাজুল আবেদীন, হাবিবুল বাসার এবং আব্দুর রাজ্জাক। আগের দিন বিসিবি সভাপতির বাসার গ্যারেজ থেকে সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল সাকিব আল হাসান নেতৃত্ব দিবে বাংলাদেশ দলকে। সাকিব এখন তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। পরের ঘোষণায় দ্বিমত নেই।  কিন্তু দল ঘোষণা বিষয়ে বিশেষত বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক জয়ের নায়ক, এখনো সক্রিয়, অন্যতম অভিজ্ঞ খেলোয়াড়, নীরব ঘাতক খ্যাত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে উপেক্ষা করায় ক্রিকেট অভিজ্ঞ মহল ক্ষুব্ধ, আহত এবং বিস্মিত হয়েছে।

এমনিতেই দলে বর্তমানে ম্যাচ ফিটনেসের কারণে তামিম ইকবাল নেই, তারপরও অভিজ্ঞ খেলোয়াড় মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে এভাবে বাদ দেওয়াকে সহজভাবে মেনে নেয়া যায় না। যাদের রিয়াদের বিকল্প হিসাবে দলে নেওয়া হলো সেই খেলোয়াড়দের সাম্প্রতিক পারফরমেন্স কোনোভাবেই রিয়াদ থেকে উন্নততর নয়। না হয় বাদ রাখলাম রিয়াদের বিশাল অভিজ্ঞতা আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অনেক ম্যাচজয়ী সাফল্যের কথা। বেতনভুক্ত হেড কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের অশুভ প্রভাবে এভাবে দলের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে বাদ দেওয়ার পরিণতি হয়তো শুভ হবে না।

এশিয়া কাপ শেষে বাংলাদেশের অনুশোচনার সময় থাকবে না। রিয়াদকে উপেক্ষা বাংলাদেশ দলে বেশকিছু সময় জুড়ে বিদ্যমান অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ বললে অত্যুক্তি হবে না। এভাবে একটি দেশ তার বিজয়ী বীরদের উপেক্ষা করতে পারে না। রিয়াদের এভাবে বাদ পড়া থেকে মনে পড়ে বহুচর্চিত আপ্ত বাক্য ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেই দেশে গুণী জন্মায় না’।

সবাই জানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বর্তমান অবস্থানে এসেছে মূলত সোনালি প্রজন্মের পাঁচ জন কিংবদন্তি খেলোয়াড় মাশরাফি মুর্তজা, মুশফিকুর রহিম, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল এবং মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের ব্যক্তিগত এবং সমিষ্টগত অবদানে। অথচ এদের সবার সাথেই বাংলাদেশ হেড কোচ হাথুরুসিংহের শীতল সম্পর্কের কারণে দল এবং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাশরাফি টি২০ সিরিজ থেকে অবসর, তামিম, মুশফিকের টি ২০ সিরিজ থেকে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়া, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের টেস্ট থেকে অবসর এবং অবশেষে এশিয়া কাপ দল থেকে বাদ পড়া সব কিছুর নেপথ্যের কারিগর ওই হাথুরুসিংহে।

শুনেছি সাকিবের প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পেরে না উঠা হাথুরুসিংহের সঙ্গে  যে অচিরে সাকিবের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবে না সেটি নিশ্চিত বলা যাবে না। যাহোক হয়তো নীরব ঘাতক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যাত্রা শেষ হয়ে গেলো। ২০১৫ বিশ্বকাপ, নিদ্হাস ট্রফির বিস্ফোরক ইনিংস ক্রিকেট প্রেমিকদের স্মৃতিতে জেগে থাকবে।

এশিয়া কাপে বাংলাদেশের স্কোয়াড

সাকিব আল হাসান (অধিনায়ক), লিটন দাস, তানজীদ হাসান, নাজমুল হোসেন, তাওহিদ হৃদয়, মুশফিকুর রহিম, মেহেদী হাসান মিরাজ, তাসকিন আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, মেহেদী হাসান, হাসান মাহমুদ, শামীম হোসেন, আফিফ হোসেন, শরীফুল ইসলাম, ইবাদত হোসেন, মোহাম্মদ নাঈম ও নাসুম আহমেদ।

স্মরণে আছে কিছুদিন আগে অনেকটা বিরক্তি আর অসন্তোষের সঙ্গেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলো ওডিআই ক্রিকেট অধিনায়ক বাংলাদেশ ক্রিকেটের এযাবৎ কালের সেরা ওপেনিং ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল। পরে অনেক নাটকীয়তার পর ক্রিকেট অনুরাগী বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে তামিম অবসর ভাঙার ঘোষণা দিলেও শারীরিকভাবে ম্যাচ ফিট না থাকায় স্বেচ্ছায় অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।  এশিয়া কাপ স্কোয়াডে নেই তামিম। অধিনায়ক নির্বাচন নিয়ে নানা তালবাহানার পর সম্প্রতি বিসিবির প্রেসিডেন্ট তার বাসার গ্যারেজে নাটকীয় ভঙ্গিতে সাকিব আল হাসানকে অধিনায়ক হিসেবে ঘোষণা দেন।  বিসিবি দেশের ক্রিকেটের শীর্ষ সংগঠন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ বিসিবি দপ্তর থেকে ঘোষণা দেওয়াই রীতি হওয়া উচিত।

যাহোক, তামিম না থাকায় দলকে ওপেনিং করার জন্য লিটন দাসের যোগ্য সঙ্গী খুঁজে নেয়ার পাশাপাশি একজন বিকল্পের সন্ধান করতে হয়। লিটন নিজেও বর্তমানে সেরা ফর্মে নেই। ওর সঙ্গে ওপেনার হিসাবে বেছে নেওয়া মোহাম্মদ নাঈম উপর্যুপুরি সুযোগ পেয়েও ভালো করেনি। তবে তরুণ প্রতিশ্রুতিময় তানজিদ তামিমের অন্তর্ভুক্তি আমি সমর্থন করি। নাজমুল শান্ত, তাওহীদ হৃদয়, সাকিব, মুশফিক, মেহেদী মিরাজ স্বয়ংক্রিয় চয়েস।

এখন আসুন ৭ নম্বর ব্যাটিং পজিশনে। একদিনের ক্রিকেটে পজিশনটি ইদানিং নিয়মিত ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।  বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশ এই পজিশনে মাহমুদুল্লার বিকল্প খুঁজছে। নানা তালবাহানা করে মাহমুদুল্লাহকে দূরে সরিয়ে রেখে কখনো ইয়াসির রাব্বি, কখনো আফিফা হোসাইন বা শামীম পাটোয়ারীকে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেউ থিতু হয় নি। অথচ টপ অর্ডারে ব্যাটিং করার প্রমাণিত সক্ষম মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ নিকট অতীতেও সফল হওয়ার নজির থাকা সত্ত্বেও উপেক্ষিত থাকলো। বলা হলো এশিয়া কাপ এবং বিশ্বকাপের বিবেচনায় রিয়াদ আছে, তাকে বিশ্রামে রাখা হয়েছে। অনুশীলনে ডাকার পরেও এভাবে তাকে উপেক্ষা করা সমীচীন হয়নি।

তামিমের অবর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার বিশ্বমানের নতুন বলের আক্রমণ সামাল দিতে হিমসিম খেতে পারে বাংলাদেশের টপ অর্ডার।  সেই ক্ষেত্রে লোয়ার মিডল অর্ডারে সাকিব, মুশফিক সঙ্গী হিসাবে রিয়াদকে দারুনভাবে মিস করবে। জানিনা আফিফ বা শামীম পাটোয়ারী সেই অভাব কতটুকু পূরণ করবে। আমি শ্রীলংকা, পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য এশিয়া কাপে ৫ জন পেস বোলার নেয়াকে সমর্থন করি। তবে বিকল্প স্পিনার হিসাবে তাজুলকে উপেক্ষা করে নাসুমকে নেওয়া সঠিক বলে মনে করি না। ১৫ জন সদস্যের স্থানে ১৭ জন নেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত।  তবে ক্রিকেট বিশ্বের সবার কাছেই বিস্ময় মনে হবে ১৭ জনের স্কোয়াডেও মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের স্থান হলো না।

বাংলাদেশকে গ্রুপ পর্যায়ে আফগানিস্তান এবং শ্রীলংকা দুটো দলের মোকাবিলা করতে হবে। শ্রীলংকা কিন্তু সম্প্রতি অনেক পরিণত দল মনে হচ্ছে।  ওদের মাটিতে ওদের হারানো সহজ হবে না। আর আফগান দল কিছুদিন আগে বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশকে ২-১ হারিয়ে গেছে। এশিয়া কাপকে সামনে রেখে আফগানিস্তান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শ্রীলংকায় ওডিআই সিরিজ খেলবে। গ্রুপ পর্যায় উৎরে গেলে বাংলাদেশকে গ্রুপ অফ ফোরে তুখোড় পাকিস্তান এবং ভারতকে মোকাবিলা করতে হবে। হাতুরার আঘাতে চূর্ণ হওয়া বাংলাদেশের স্বর্ণযুগের প্রজন্ম  হয়তো সুযোগ পেলো না শেষবারের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের শিরোপা জয়ের স্বপ্ন চূড়ায় পৌঁছে দেওয়ার।

যাহোক তবুও শুভ কামনা টাইগার বাহিনীর জন্য।

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

17 + two =