গরমে নাজেহাল অবস্থা। একটু স্বস্তির খোঁজে মানুষ অফিস, আদালত সহ নিজের ঘরে এসি লাগাচ্ছে। কিন্তু আপনি কি জানেন গরম থেকে বাঁচতে মানুষ এসি ব্যবহার করলেও এটি তৈরির উদ্দেশ্য মোটেও তা ছিল না। চলুন জেনে নেওয়া যাক কিভাবে আবিষ্কার করা হলো ঘর শীতল করা এই যন্ত্র।
এসি বা এয়ার কন্ডিশনারের মাধ্যমে ঘর ঠান্ডা করা এবং বাইরে থেকে আসা দূষিত বাতাস শুদ্ধ করা যায়। অর্থাৎ আবদ্ধ ঘরে বা স্থানে বাষ্প মিশ্রিত ঠান্ডা বাতাস, বাতাসের আর্দ্রতা, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ধুলাবালি পরিষ্কার, রোগমুক্তকরণ ও বাতাস আদান-প্রদানের মাধ্যমে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টির কৌশলকে এয়ার কন্ডিশনিং বলে।
আজ থেকে ১০০ বছর আগে বাড়িতে এসি ব্যবহারের কোনো সুযোগ ছিল না। ১৯২০ সালের পর থেকে বাড়িতে এসি ব্যবহার করা অল্প পরিসরে শুরু হয়। মূলত খাবার সংরক্ষণ ও ছাপাখানার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই এসি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে ঘরের সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা খাদ্যদ্রব্য সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। তবে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি দ্রুত হ্রাস পায়। তাই শুরুতে মূলত ব্যাকটেরিয়াা আক্রমণ থেকে খাদ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র আবিষ্কার করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে বিজ্ঞানীরা। আপনি কোনো বড় খাবার ফ্যাক্টরিতে গেলে দেখবেন কতটা শীতল আবহাওয়া থাকে সেখানে। তার একমাত্র কারণ খাবার সংরক্ষণ রাখা।
প্রাচীন মিসরীয়দের সময় থেকেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে মানুষ। ১৭৫৮ সালে মার্কিন বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন হিমাঙ্কের নিচে তাপমাত্রা অর্জনের জন্য বাষ্পীভবন ও অ্যালকোহল নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালান। ১৮২৪ সালে তরল অ্যামোনিয়া বাষ্পীভবনের মাধ্যমে বাতাসকে শীতল করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। বলা যায় তিনি প্রথমদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র উদ্ভাবন নিয়ে কাজ করেছিলেন। ১৮৪০ সালে পদার্থবিদ জন গরি উচ্চ তাপমাত্রা থেকে নগরবাসীকে বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রাজ্যের শহরগুলোকে শীতল করার একটি ধারণা প্রস্তাব করেন। তার মতে, ম্যালেরিয়ার মতো বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের একমাত্র সমাধান হতে পারে এই শীতলীকরণ পদ্ধতি।
উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার নামের এক ভদ্রলোক একটি ছাপাখানায় কাজ করতেন। ছাপাখানায় বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রার কারণে কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছিল। তখন তিনি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য একটি যন্ত্রের নকশা তৈরি করেছিলেন। সেই যন্ত্রটি হচ্ছে বৈদ্যুতিক এয়ার কন্ডিশনার। তিনি এসি তৈরিতে আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ কৌশল প্রয়োগ করেন। ১৯০২ সালে আমেরিকান প্রকৌশলী উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার এটি প্রথম আবিষ্কার করেন। আধুনিক এসির জনক হিসেবে আলোচনায় এজন্য তার নামটি সর্বপ্রথম চলে আসে। শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য তার আবিষ্কৃত এসিটি প্রস্তুত করা হয়েছিল। মূলত বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ছাপা কাগজের আকার ও কালির যথার্থ ব্যবহার ঠিক রাখতে এসি ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ১৯০৬ সালে উইলিস হ্যাভিল্যান্ড এসির জন্য আমেরিকান সরকারের পেটেন্ট পান। কৃত্রিম শীতলীকরণ পদ্ধতির ধারাবাহিকতায় জন গরি কমপ্রেশার ব্যবহার করে রেফ্রিজারেটর তৈরি করেন, কিন্তু তিনি পেটেন্ট নিতে ব্যর্থ হন।
এরপর উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার এয়ার কন্ডিশন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত বেশকিছু বছর কৃত্রিম শীতলীকরণ ব্যবস্থার কাজ বন্ধ ছিল। ১৯১৫ সালে উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার ও ছয় প্রকৌশলী মিলে বিশ্বের বৃহত্তম এসি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৬ সাল থেকে আবাসিক গৃহে এসির ব্যবহার শুরু হয়। তখন এসিতে অ্যামোনিয়া, প্রপেন ও মিথাইল ক্লোরাইডের মতো বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহৃত হতো। তবে তাদের উদ্ভাবিত এসি এতটাই বিশাল ছিল যে এটি রাখতে একটি ঘরের প্রয়োজন হতো। ফলে বড় বড় কারখানা ছাড়া এই এসি তেমন একটা ব্যবহার করা যেত না। ১৯২৮ সালে টমাস মিগলি জুনিয়র ফ্রেয়ন আবিষ্কারের মাধ্যমে আবাসিক, শিল্প ও বাণিজ্যিক কাজে মানুষের জন্য নিরাপদ এসি উদ্ভাবন করেন। ১৯৩০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউস শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়।
১৯৪৫ সালে রবার্ট শেরম্যান পোর্টেবল এসি আবিষ্কার করেন, যা জানালার পাশে রেখে ব্যবহার করা যেত। এই এসি ঘরের বাতাস ফিল্টার করার পাশাপাশি গরমের দিনে ঘর ঠান্ডা রাখত এবং শীতের দিনে গরম রাখত। ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার মারা যান। ১৯৭৯ সালে আমেরিকার ইউনাইটেড টেকনোলজিস উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠিত ক্যারিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন কোম্পানি কিনে নেয়। তখন এসি তৈরি বাড়তে থাকে এবং সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে ১৯৪৬ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে এসি উৎপাদনের চাহিদা বাড়তে থাকে। সে বছর ৩০ হাজার এসি উৎপাদিত হয়। ১৯৫৩ সালেই তা ১০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এরপর প্রতিবছরই উৎপাদন বেড়েছে কমবেশি।
বাংলাদেশে এসির ব্যবহার কিভাবে শুরু হলো এটা সম্পর্কে জানতে হলে দুই যুগ আগে ফিরে যেতে হবে। বর্তমানে দেশের মানুষের এসি ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে, সাথে সাথে এসি ব্যবহার করার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। কিন্তু এই চিত্রটা ছিল ভিন্নরকম ২০০০ সালের আগে। তখন দেশে এসির বাজার পুরোপুরি ছিল আমদানি নির্ভর। জাপান, কোরিয়া ও তাইওয়ান থেকে ব্র্যান্ডের এসি আমদানি করা হতো। একটা সময় চীন থেকে এসি আমদানি শুরু হয়। চীনা এসি বাজারে দাম কমাতে ভূমিকা রাখে। অবস্থা বদলাতে থাকে ২০০০ সালের দিকে। আমদানিকারকদের অনেকেই চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে খুচরা যন্ত্রাংশ এনে দেশে সংযোজন করে এসি বাজারজাত করতে থাকে। ২০০০ সালে এই দৃশ্য পুরোপুরি বদলে যায়। দেশে শুরু হয় এসি উৎপাদন। যার ফলশ্রুতিতে মধ্যবিত্তের নাগালে চলে আসে ঘর শীতল করার যন্ত্রটি। জেনারেল, হিতাচি, এলজি, গ্রি, ওয়ালটন, সিঙ্গার, মিনিস্টার, মাই ওয়ান সহ অনান্য প্রতিষ্ঠানের এসির চাহিদা বেশি দেশের মার্কেটে।
এসি নিয়ে কিছু জানা অজানা
ফিল্টার নোংরা, কম ঠান্ডা: এসির ফিল্টার নোংরা থাকলে সমস্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। নোংরা ফিল্টারের এসি ঘর ঠান্ডা করতে বেশি সময় নেবে সেইসঙ্গে ইলেকট্রিক বিল আসবে অনেক বেশি। এসির ফিল্টার প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করা উচিৎ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তত দুই সপ্তাহ পর পর এসির ফিল্টার পরিষ্কার করা প্রয়োজন।
সূর্যের আলো থেকে দূরে: এসি সবসময় সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখতে হবে। সরাসরি সূর্যের আলো থেকে এসি দূরে থাকে, তাহলে বেশিক্ষণ চালিয়ে রাখলেও অতিরিক্ত গরম হবে না। আর তাতে ওভারহিটিং সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে এসি। শুধু তাই নয়, ঘর ঠান্ডাও হবে খুব দ্রুত। এসি অন করার আগে যদি সেটি খুব গরম থাকে, তাহলে ঘর ঠান্ডা করতে অনেক সময় নিতে পারে।
বেশি মানুষ কম ঠান্ডা: হয়তো লক্ষ্য করেছেন, রেস্তোরাঁয় একাধিক এসি থাকে। থিয়েটার বা পাবলিক প্লেসের ক্ষেত্রেও বিষয়টি এক। কারণ একটি ঘরে যত বেশি মানুষ থাকবে, ঘর ঠান্ডা করতে তত বেশি সময় লাগবে। এসির কুলিং এফিশিয়েন্সি নির্ভর করে সেই ঘরের ক্যাপাসিটি এবং ঘরটিতে কত মানুষ থাকছে। খুব সহজ ভাষায় বলতে গেলে একটা ঘরে যত বেশি মানুষ থাকবে, তত বেশি ঠান্ডা হতে সময় নেবে ঘরটি।
সার্ভিসিং না করা ভুল: বেশির ভাগ এসি প্রস্তুতকারক সংস্থা দাবি করে থাকে যে, এসি কেনার পর এক বছর অন্তত সার্ভিসিং নিয়ে চিন্তার কোনও কারণ নেই। এটি কিন্তু সম্পূর্ণ একটি ভ্রান্ত ধারণা। বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, একটা এসি যত বেশি সার্ভিস করবেন, ততই তার কুলিং এফিশিয়েন্সি ভালো হবে। অন্তত গ্রীষ্মকালীন দেশে তা খুবই জরুরি। এসি নিশ্চয়ই সারা বছর ব্যবহার করবেন না। দীর্ঘদিন অব্যবহারের কারণেও এসি ঘর ঠান্ডা করতে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় নিয়ে নেয়।
কেন সাদা রঙের: এসি কেনার ক্ষেত্রে প্রিয় রঙের এসি কেনার সুযোগ নেই তেমন। কারণ বেশিরভাগ এসির রঙ হয় সাদা। এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। কিন্তু জানেন কি, কেন বেশিরভাগ এসির রঙ সাদা হয়। স্প্লিট হোক বা উইন্ডো, সবই সাদা। এটার পেছনে রয়েছে বড় একটা কারণ। আসলে সাদা রঙ হিট রিফ্লেক্ট করে। ফলে এসির ভেতরে কম্প্রেসার গরম হলেও সমস্যা হয় না। এছাড়া আউটডোর ইউনিট বেশিরভাগ জায়গায় রোদে ইনস্টল করা হয়ে থাকে। ফলে সেটি সাদা ছাড়া অন্য রঙের হলে বেশি তাপে সমস্যা হতে পারে। অবশ্য এখন কিছু অত্যাধুনিক এসি লাল, কালো ইত্যাদি রঙেরও হয়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার