‘ওরা ৭ জন’ নতুন কী মাত্রা আনলো

সানজিদা নূর

‘আমাদের যুদ্ধের ময়দানে সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধটা কাল ভোর হওয়ার আগেই করতে হবে’

নির্মাতারা বিভিন্ন সময় মুক্তিযুদ্ধের গল্প সেলুলয়েডে নিয়ে এসেছেন। রূপালি পর্দায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প। সংখ্যার দিক থেকে বিবেচনা করলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার সংখ্যা নিতান্তই কম। ‘ওরা ১১ জন’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘আলোর মিছিল’, ‘সংগ্রাম’, ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, ‘মেঘের অনেক রং’, ‘গেরিলা’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামল ছায়া’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সে জায়গায় ‘ওরা ৭ জন’ সিনেমা আলাদা কিছু নয়।

দেশের মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় রাজাকারদের বর্বরতা আর পাক-হানাদার বাহিনীদের নির্যাতনের প্রতিচ্ছবির দেখা মেলে। সঙ্গে একটা গোষ্ঠীর আহাজারির গল্প ফুটে ভিন্ন মোড়কে। সে জায়গায় ‘ওরা সাত জন’ সিনেমায় রণাঙ্গনের লড়াই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় ইতিপূর্বে এভাবে সম্মুখ যুদ্ধ দেখা যায়নি। যা দেখা গেছে ‘ওরা সাত জন’ সিনেমায়। অ্যাকশন সিকুয়েন্সগুলোর পাশাপাশি গোলাগুলির দৃশ্যগুলো এতটাই নিখুঁত ছিল যা পর্দায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। ‘ওরা সাত জন’ অসাধারণ সিনেমা হয়ে গিয়েছে কিংবা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সকল সিনেমাকে টপকে গিয়েছে সে প্রসঙ্গে যাব না। মোটাদাগে বলা যায় ‘ওরা সাত জন’ সিনেমার নির্মাতা ভিন্নভাবে গল্পটা বলতে চেয়েছেন। কতটুকু পেরেছেন তা বলবে দর্শক আর সমালোচকেরা।

‘ওরা সাত জন’ সিনেমার বেশ কিছু দুর্বল দিক রয়েছে। সিনেমার নাম ‘ওরা ৭ জন’ হলেও এটি সাত জন বীরশ্রেষ্ঠের গল্প নিয়ে নির্মিত কোনো সিনেমা নয়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সাত জন মুক্তিযোদ্ধা একটা মিশনে যায়। সেই সময়কার গল্প নিয়ে মূলত সিনেমাটি নির্মিত। কেউবা পুলিশ আবার কেউ চিকিৎসক, কেউ মেজর আবার কেউবা মসজিদের মুয়াজ্জিন। কেউবা আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একপর্যায়ে দেশের জন্য তারা সকলেই অস্ত্র হাতে তুলে নেন স্বাধীন করার লক্ষ্যে। সিনেমার শুরু ও সমাপ্তি সবকিছুই ঘটে যুদ্ধের ময়দানে। সাত জন মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয় করেছেন ‘ডাক্তার সাদ’ চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার, ‘মেজর লুৎফর’ চরিত্রে অভিনয় করছেন খিজির হায়াত খান, সাব-ইন্সপেক্টর ‘সাইফ’ চরিত্রে সাফি, সার্জেন্ট ‘মুক্তাদির’ চরিত্রে শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব, ‘সোলায়মান কাজী’ চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষন, ‘সুমিত’ চরিত্রে নাফিজ আহমেদ, ‘নজরুল’ চরিত্রে খালিদ মাহবুব তূর্য। সিনেমায় ডাক্তার অপর্ণা সেন চরিত্রে অভিনয় করছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম। অতিথি চরিত্রে দেখা যায় নাজিয়া হক অর্ষাকে।

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার গল্পে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যায় পরিসমাপ্তি দর্শক আগেই আন্দাজ করতে পারে। ঠিক একইভাবে ‘ওরা সাত জন’ সিনেমার গল্পে নতুনত্ব নেই বললেই চলে। তবে নির্মাণশৈলীতে নতুনত্ব এসেছে বলতেই হয়। নির্মাতার আসনে বসে খিজির হায়াত খান ব্যতিক্রমধর্মী নির্মাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন বলতেই হয়। মোটাদাগে বলা যায়, খিজির হায়াত খানের ফিল্মি ক্যারিয়ারে এখন অব্দি সবচেয়ে দুর্দান্ত কাজ এটাই।

সোলেমান, লুৎফর, নজরুল, শাফি, মুক্তাদির, সুমিত ছয়টা চরিত্র তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় ডাক্তার সাব। যারা সবাই মিলে ওরা সাত জন। একজনের গানের প্রতি ভালোবাসা, একজনের মেয়েকে না দেখার কষ্ট, একজনের আবার টানা এক মাস ভাজা ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার ইচ্ছা, একজনের ধর্মের প্রতি ভক্তি, একজনের সময়মতো আবার একটা সিগারেট ধরাতে পারলেই হয়। একেকটা মানুষ একেকটা রূপের কিন্তু তাদের কেন্দ্রবিন্দু এক জায়গায় তারা সকলেই মুক্তিবাহিনীর সদস্য। সিনেমায় সকলের পারফরম্যান্স ছিল সাবলীল। পর্দায় বাড়তি কিছু করার প্রবণতা ছিল না কারো মধ্যে। জাকিয়া বারী মম ‘অপর্ণা’ চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। তার চরিত্রে যেভাবে উঠে এসেছে সাহসী মনোভাব ঠিক তেমনিভাবে উঠে এসেছে অসহায়ত্ব। ‘লুৎফর’ চরিত্রে খিজির হায়াত খান বেশ ভালো করেছেন। ফাইটিং সিকুয়েন্সগুলোতে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন আর ডায়ালগ ডেলিভারি নিয়ে খানিকটা কাজ করতে পারতেন। ইন্তেখাব দিনার পুরোটা সময় ন্যাচারাল পারফরম্যান্স করেছেন। কিন্তু ইন্তেখাব দিনারকে কেন জানি অ্যাকশন সিকুয়েন্সগুলোতে দেখে তৃপ্তি লাগছিল না। ইমতিয়াজ বর্ষণ নিজের চরিত্রের সঙ্গে খুবই সূক্ষ্মভাবে মিশে গিয়েছেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মোল্লা বা হুজুর মানেই খারাপ সেই মিথ কিংবা ট্যাবু আবার ভেঙেছেন নির্মাতা খিজির হায়াত খান; এই চরিত্রের মাধ্যমে হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’ সিনেমার পর।

সিনেমায় আলাদা একটা রিলিফ দিচ্ছিলো ‘শাফি’ চরিত্রটা। আঞ্চলিক ভাষায় মজার সংলাপ প্রয়োগে হাসিয়েছেন দর্শকদের। যখনই স্ক্রিনে এসেছেন আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন গল্পে। শিবা শানু আন্ডারেটেড একজন অভিনেতা। ভিলেন টাইপ কাস্ট থেকে বের হয়ে তিনি ব্যতিক্রম কিছু করতে পারেন তা প্রমাণ করছেনে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্প কমান্ডার ‘মেজর মোশাররফ’ চরিত্রে অভিনয় করে। স্বল্প সময়ের উপস্থিতি। অল্প কিছু সিকুয়েন্স। কি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেন। ডায়ালগ ডেলিভারি থেকে বডি ল্যাঙ্গুয়েজ সবকিছুতে ছিল একজন বাস্তব কমান্ডারের ছাপ। নিঃসন্দেহে তিনি সিনেমার সেরা পারফর্মারদের একজন। জয়রাজ ও হামিদুর রহমান স্ব স্ব চরিত্রে বেশ ভালো অভিনয় করেছেন।

সিনেমার টেকনিক্যাল পার্ট নিয়ে বলতে গেলে হতাশ হওয়া আছে আবার তৃপ্তিও আছে। সিনেমার অ্যাকশন সিকুয়েন্সগুলোর পাশাপাশি গোলাগুলির দৃশ্যগুলো এতটাই নিখুঁত ছিল যে চোখে আলাদা তৃপ্তি দিয়েছে। সবগুলো অ্যাকশন সিকুয়েন্সে পরিপূর্ণ এফোর্টের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে বলতেই হয়। এছাড়া পুরোটা সময় জুড়ে ফাইটিং সিনগুলো ছিল একদম পাক্কা দশে দশ। কিন্তু হতাশার জায়গা হচ্ছে সিনেমার গল্পের গাঁথুনিতে পরিপক্বতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়নি। মেলোড্রামা দেখা গিয়েছে বেশ কিছু সিকুয়েন্সে। যার ফলে সিনেমা হঠাৎ ঝুলে যায় যা দর্শক হিসেবে খানিকটা হতাশ করবে। কিছু সিকুয়েন্স না রাখলেও হতো মনে হয়েছে। সিনেমার দৈর্ঘ্য খানিকটা কম হলে মন্দ হতো না। ইংরেজি শব্দের অতিরিক্ত ব্যবহার দেখা যায় কমান্ডারের কাছ থেকে। যা মুক্তিযুদ্ধের সমসাময়িক সময়ের সঙ্গে মানানসই নয়। এছাড়া সিনেমার কালার গ্রেডিং ছিল খুবই সাধারণ। সবকিছুর মিশেলে এত সুন্দর একটা সিনেমায় রূপ নিতো সিনেমাটি সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কালার টোন।

কিন্তু সে আক্ষেপ ঘুচিয়ে দিয়েছে সিনেমার গান। এই সিনেমার প্রতিটি গান অতিরিক্ত সুন্দর। প্রতিটি গান আলাদা অনূভুতি দিয়েছে। একটি গান আনন্দোচ্ছ্বাসের অনূভুতি জাগ্রত করে আবার আরেকটা গান বিজয়ের অনূভুতি দেয়। অন্যদিকে শেষ গানটা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন করে। প্রতিটি গানের কথা, সুর, গায়কী ছিল সুন্দর। গানের প্লেসমেন্ট ছিল পারফেক্ট। সিলেটের নানান লোকেশন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমায়। ক্যামেরার কাজ ছিল খুবই আই ক্যাচিং। সিলেটের অপরূপ সৌন্দর্য্য ধরা দিয়েছে ড্রোন শটে। গানের পাশাপাশি আরেকটা বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে সংলাপে একটা ফাঙ্কি ব্যাপার রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। যার ফলে সিনেমা দেখার সময় মনের অজান্তেই হেসে ফেলতে হয়। নির্মাতা খিজির হায়াত খানের ভাষ্যমতে এটি দেশের প্রথম পরিপূর্ণ একটা ব্যাটালিয়ন সিনেমা। কতটুকু সফল তার এই প্রয়াস তা নিয়ে বলবো না। তবে ভিন্নভাবে ভাবনার যে পরিকল্পনা করেছেন এই ভদ্রলোক সেজন্য একটা ধন্যবাদ তার প্রাপ্য।

সিনেমার শেষাংশে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানানোর সিকুয়েন্সটা আবেগে আপ্লুত করবে। শরীরে গুজবাম্প ধরিয়ে দেবে। হৃদয় শীতল হয়ে উঠবে। মুক্তিযুদ্ধ সময়কার কথা কল্পনা করে মনের অজান্তেই শ্রদ্ধা জানাবেন মুক্তিবাহিনীদের।

সিনেমা: ওরা সাত জন, পরিচালক: খিজির হায়াত খান, দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ২৮ মিনিট, ধরন: মুক্তিযুদ্ধ

অভিনয়: ইন্তেখাব দিনার, জাকিয়া বারী মম, ইমতিয়াজ বর্ষণ, সাইফ খান, খালিদ মাহবুব তুর্য, শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব, শিবা সানু, তাসনিম তাসফি, জয়রাজ, নাফিস আহমেদ, হামিদুর রহমান, খিজির হায়াত প্রমুখ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সিনেমালজি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − nine =