কক্স সাহেবের বাজার থেকে কক্সবাজার

হাসান নীল

বালুর নরম বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে আছে ঝাউয়ের সারি। সামনেই পাতা বিশাল নীল জলরাশি। সব মিলিয়ে যেন ক্যানভাসে আঁকা এক অপূর্ব চিত্রকর্ম। বলছিলাম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা। শতাব্দীর পর শতাব্দী এভাবেই প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর ছবি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এ সৈকত। যার নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে রোজই ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের সৌন্দর্য পিপাসু পর্যটকরা।

নামকরণ

কীভাবে এর নামকরণ করা হলো কক্সবাজার? সে ইতিহাস জানতে আমাদের চলে যেতে হবে সপ্তম অষ্টম শতকে। তখন থেকেই কক্সবাজার ছিল ভিনদেশিদের আনাগোনায় মুখর। এরমধ্যে ছিল ধর্মপ্রচারক ও আরব ব্যবসায়ীরা। সেসময় চট্টগ্রাম ও আকিয়াব বন্দরে আগমন ঘটত পর্যটকদের। এই দুই বন্দরের মাঝেই ছিল কক্সবাজার। ফলে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে সমুদ্রকন্যার সৌন্দর্য উপভোগে ঢুঁ মারতেন অনেকেই। সেসময় কক্সবাজার ছিল চট্টগ্রামের হরিকেলার রাজা কান্তিদেবের অধীনে। তবে এর ওপর লোলুপ দৃষ্টি ছিল আরকান রাজ সুলাত ইঙ্গের। এ অঞ্চল দখল নিতে পায়তারা কম করেননি। অবশেষে ৯৩০ সালে রাজা সুলাত দখল করে নেন অঞ্চলটি। কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের একাংশের ওপর আরকানদের অধিকার ছিল দীর্ঘদিন। তা প্রায় ষোলো শতক পর্যন্ত। তবে ষোলর পর আরকানদের পথচলা আর দীর্ঘ হয়নি। কেননা ততদিনে মোঘল সম্রাজ্যের অধীনে চলে যায় এ অঞ্চল। সেসময় মোঘলদের অধিকর্তা ছিলেন সম্রাট শাহ সুজা। শাহ সুজাকে ঘিরে কক্সবাজারের একটি বিশেষ গল্প রয়েছে। একবার মোঘল সম্রাট শাহ সুজা লোক-লস্কর নিয়ে আরাকান যাচ্ছিলেন। তার সে বহরে ছিল এক হাজার পালকি। সুজা চলছিলেন সাগরের তীর ঘেঁষে। সমুদ্রের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সেখানে খানিক জিরিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। সম্রাটের যেমন ইচ্ছা। আদেশ অনুযায়ী হাজার পালকি নামানো হয় সাগরের তীরে। সম্রাট বিশ্রামে যান লোক-লস্কর নিয়ে। শাহ সুজার বিশ্রামের ওই জায়গাটি হচ্ছে কক্সবাজারের চকোরিয়ার ডুলাহাজারা। ডুলাহাজারা শব্দের আভিধানিক অর্থ হাজার পালকি। ধারনা করা হয় এই হাজার পালকি থেকেই জায়গাটির নামকরণ করা হয় ডুলাহাজারা। অবশ্য এর কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত নেই।

কক্সবাজারের নামকরণের গল্পটা আরও একটু বৈচিত্র্যপূর্ণ। এ অঞ্চলের প্রাচীন নাম প্যানায়া। প্যানায়া অর্থ হলুদ ফুল। এছাড়া পালঙ্কি নামেও ডাকা হতো। কক্সবাজার নাম দেওয়া হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। তার আগে অন্য একটি ঘটনায় জানা যাক। ১৯৮৪ সালে বার্মার রাজা বোধাপায়ার দখলে চলে যায় চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী আরাকান রাজ্য। এতে করে কক্সবাজার অঞ্চলটিও চলে যায় বোধাপায়ার অধীনে। তার অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে প্রায় দশ হাজার আরাকান পালিয়ে যায় কক্সবাজার থেকে। এরপর পরই চট্টগ্রাম, কক্সবাজার অধিগ্রহণ করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সে সময় এ অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স নামের এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার ওপর। হিরাম কক্স দায়িত্ব নেওয়ার পর তাৎক্ষণিক কিছু উদ্যোগ নেন। তিনি অঞ্চলটির ওপর ব্রিটিশরাজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য চাষীদের মাঝে জমি বিতরণ শুরু করেন। এ ঘটনা চাউর হলে পালিয়ে যাওয়া আরাকানদের অনেকেই কক্সবাজারে ফিরে আাসা শুরু করে। তাদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ারও কাজ চলছিল। এসময় আরাকান ও রাখাইনদের মধ্যে চলমান সংঘাত নিরসনেও কাজ করছিলেন কক্স। কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। তবে হিরাম কক্সকে মনে রাখে ওই অঞ্চলের বাসিন্দারা। হিরাম কক্স একটি বাজার স্থাপন করেছিলেন। তার নামানুসারে ওই বাজারের নাম দেওয়া হয়েছিল কক্স সাহেবের বাজার। তার মৃত্যুর পর সম্মানার্থে গোটা অঞ্চলের নাম আস্তে আস্তে হয়ে যায় কক্সবাজার।

পৃথিবীর অন্যতম সৈকত

এই সৈকতের নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন না এমন মানুষ কমই আছে। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকতগুলোর একটি। এর দৈর্ঘ্য ১৫০ কিলোমিটার তথা ৯৩ মাইল। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ব্রাজিলে অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ২১২ কিলোমিটার অর্থাৎ ১৩২ মাইল। এরপরই রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্র সৈকত। ১৫১ কিমি দীর্ঘ এ সৈকত। তবে এর কিছু অংশ আবার মানুষের বানানো। অন্যদিকে কক্সবাজার সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। সৌন্দর্যের দিক দিয়েও অন্যতম।

সৌন্দর্যের লীলাভূমি

সাগরকে ছুঁয়ে দেখতেই দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে যায় কক্সবাজার। সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যের ডুবে যাওয়া ও ভোরে ঘুম ভেঙে সমুদ্রের বুক থেকে সুয্যি মামার পুব আকাশে উঠে আসার দৃশ্যটি উপভোগ করার ইচ্ছাও থাকে সবার। কক্সবাজারে রয়েছে কয়েকটি সৈকত। এরমধ্যে লাবনী বিচ, সুগন্ধা বিচ, কলাতলি বিচ, হিমছড়ি, ইনানী বিচ, মেরিন রোড উল্লেখযোগ্য। এসব সৈকত থেকে দেখা যায় সাগরের সৌন্দর্য। পর্যটকরা ঝাঁপিয়ে পড়েন নীল জলরাশিতে। অথবা সাগরের বালিয়াড়িতে বসে থাকেন। সাগরের গা ঘেঁষে হেঁটে যাওয়া যায় যতক্ষণ মন চায়। সৈকতগুলোতে বিশ্রামের জন্য রয়েছে চেয়ারের ব্যবস্থা। চাইলে একাকি বা সঙ্গীদের নিয়ে চেয়ারগুলোতে হেলান দিয়ে রোদ্র স্নান করতে পারবেন। তবে এর জন্য অর্থ পরিশোধ করতে হবে। স্থানীয়দের তত্ত্বাবধানে থাকে এই সারি বেঁধে পেতে রাখা বসার আসনগুলো। আপনাকে তা ভাড়া নিতে হবে ঘণ্টা চুক্তিতে। অনেকেই সৈকতে কাটানো সময়ের ছবি তুলে রাখতে পছন্দ করেন। কেউবা সাগরের জলে নেমে ছবি তুলতে চান। সে ব্যবস্থাও রয়েছে। আশেপাশেই রয়েছে অনেক ফটোগ্রাফার। আপনাকে ডেকে তারা প্রস্তাব করবেন ছবি তুলে দেওয়ার। ছবিগুলো হাতে পেতেও ঝাক্কি পোহাতে হবে না। শুধু হোটেলের নাম ও ফোন নাম্বার দিয়ে এলেই হবে। সন্ধ্যা নামার আগেই আপনার কাছে তারা হাজির হবেন ছবিগুলো দিতে। এছাড়া চাইলে সমুদ্রের বুকে দুঃসাহসী অভিযাত্রী সাজতে পারেন। সৈকতের কাছাকাছি ভাড়ায় চালিত স্পিডবোট রয়েছে। সাহস করে তার যে কোনোটায় চড়ে ঘুরে আসতে পারেন।

কক্সবাজার ঘিরে গড়ে ওঠা কর্মসংস্থান

এই পর্যটন কেন্দ্র ঘিরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যা পর্যটকদের দিয়েছে বাড়তি সুবিধা, আর স্থানীয়দের দিয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। এখানে কেনাকাটার জন্য অন্যতম সুবিধাজনক স্থান ঝিনুক মার্কেট। এছাড়া আরও একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা হচ্ছে বার্মিজ মার্কেট। কক্সবাজার গেছেন কিন্তু ঝিনুক কিংবা বার্মিজ মার্কেটে যাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন থেকে আসা হরেকরকম পণ্যে গড়ে উঠেছে এই বার্মিজ মার্কেট। পর্যটকদের ভিড়ে সর্বদাই মুখর থাকে এ মার্কেট। সমুদ্র সৈকত থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় বার্মিজ মার্কেট থেকে প্রিয়জনদের জন্য উপহার সামগ্রী কেনা যেন প্রায় রীতিতে পরিণত হয়েছে।

আরও যা যা রয়েছে কক্সবাজারে

এখানে রয়েছে প্যারাসেলিং, ওয়াটার বাইকিং, বিচ বাইকিং, কক্স কার্নিভাল সার্কাস শো, দরিয়া নগর ইকোপার্ক, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মিত অনেক স্থাপত্য, ফিউচার পার্ক, শিশুপার্ক এবং ফটোশুট স্পট। এখানে উপভোগের জন্য রয়েছে নাইট বিচ কনসার্ট। আপনি চাইলেই উপভোগ করতে পারেন সেসব। এছাড়া সমুদ্র সৈকতে লাইটিংয়ের ব্যবস্থা থাকায় সাগরের সৌন্দর্য রাতেও হয়েছে উপভোগ করার মতো।

কীভাবে যাবেন

সড়ক, রেল ও আকাশ পথে ঢাকা থেকে কক্সবাজার যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী বাসের মধ্যে সৌদিয়া, গ্রিন লাইন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, এস আলম পরিবহন, সোহাগ পরিবহনসহ আরও বেশকিছু বাস রয়েছে। বাসগুলোতে শ্রেণিভেদে ভাড়ার তফাৎ রয়েছে। এ বাসগুলোতে যেতে চাইলে ভাড়া গুনতে হবে ১১০০-৩০০০ টাকা পর্যন্ত। ট্রেনে যেতে চাইলে প্রথমে যেতে হবে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। কমলাপুর বা বিমানবন্দর ট্রেন স্টেশন থেকে আপনি উঠতে পারবেন ট্রেনে। সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, প্রভাতীসহ বেশকিছু ট্রেন আপনাকে নিয়ে যাবে চট্টগ্রাম পর্যন্ত। এরপর চট্টগ্রাম দামপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে আপনি কক্সবাজারের বাসে চেপে বসতে পারেন। এক্ষেত্রে এসি-নন এসিভেদে ভাড়া গুনতে হবে ৪৫০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। আর বিমানে যেতে চাইলে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস বাংলা বা নভোএয়ার এয়ারলাইন্সে করে উড়ে যেতে পারবেন।

কোথায় থাকবেন

কক্সবাজার থাকার জায়গার অভাব নেই। এখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন হোটেল, মোটেল। সাধ্য অনুযায়ী ভাড়া নিতে পারবেন। অল্প টাকায় হোটেল নিতে চাইলে সৈকত থেকে একটু দূরে খুঁজতে হবে। সেক্ষেত্রে কলাতলী বিচ থেকে কিছুটা দূরে লংবিচ হোটেলের সামনের দিকে বিপরীত গলিতে খোঁজ করতে পারেন। এছাড়া সিএনজি, রিকশাওয়ালাদের থেকেও জেনে নিতে পারেন এ সম্পর্কে। আর যদি একটু বেশি দামের হোটেলে থাকতে চান তবে মারমেইড বিচ রিসোর্ট, সায়মন বিচ রিসোর্ট, ওশান প্যারাডাইজ, লং বিচ, কক্স প্যারাডাইজে যেতে পারেন। এসব হোটেলগুলোর রুম ভাড়া গুনতে হবে ৬০০-১২০০ টাকা। আর ৮০০-৩০০০ এর মধ্যে হোটেল পেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে সেন্টমার্টিন রিসোর্ট, ঊর্মি গেস্ট হাউস, হানিমুন রিসোর্ট, নিলীমা রিসোর্টে। এরকম আরও হোটেল রয়েছে কক্সবাজারে। আপনি চাইলেই ইন্টারনেট থেকে হোটেলগুলো সম্পর্কে জেনে নিতে পারবেন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: কোথায় কি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three + 20 =