কঠিন পরিস্থিতিতে উপর্যুপরি ম্যাচ জয়ে সিরিজ জয় বাংলাদেশের

সালেক সুফী

বাংলাদেশে যখন মখা নামের মহা ঘূর্ণিঝড় তাণ্ডব চালাচ্ছে ঠিক তখন হাজার মাইল দূরে ক্রিকেট মাতার দেশ ইংল্যান্ডের এসেক্স কাউন্টির মাঠ চেল্মসফোর্ডের ক্লাউড স্টেডিয়ামে ২৭৪ করে নিশ্চিত হেরে যাওয়ার অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচ ৫ রানে জিতেছে বাংলাদেশ। জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল করেও বাংলাদেশের মুস্তাফিজ, হাসান মাহমুদ আর শান্তর বিধ্বংসী বোলিং এবং তুখোড় ফিল্ডিংয়ের কাজে পরাজয় মেনে নেয় আয়ারল্যান্ড। প্রতিবেশী দেশে এবং সফরে বাংলাদেশে উপর্যপুরি সিরিজ পরাজয় হলেও বলবো আয়ারল্যান্ড ক্রিকেট শিখেছে অনেক কিছু, অর্জন আছে যথেষ্ট।

বৈরী আবহাওয়া আর ভিন্ন পরিবেশে পর পর দুটি কঠিন ওডিআই ম্যাচ জিতে বাংলাদেশের সিরিজ জয় বাংলাদেশের হার না মানা মানসিকতা প্রতিফলিত করেছে। শীতের শেষ সময় মেঘলা  আকাশের নিচে ইংল্যান্ডের সবুজ ঘাসে ঢাকা উইকেটে দ্বিতীয় ওডিআই জিতেছে বাংলাদেশ ৪৫ ওভারে সীমিত ম্যাচে ৩২০ রান তাড়া করে। সেই জয়ে ছিল দুই তরুণ নাজমুল শান্ত এবং তাওহীদ হৃদয়ের ভয় ডরহীন আগ্রাসী ব্যাটিং।

কাল টস হেরে  প্রথম ব্যাটিং করে ২৭৪ রান করেও ম্যাচটি জিতেছে প্রতিকূল অবস্থান থেকে সংগ্রামী মনোভাবের কারণে। হতে পারে প্রতিপক্ষ স্বল্প অভিজ্ঞ আয়ারল্যান্ড কিন্তু নবীন প্রবীনের সমাহার বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মাঝে কোনো অবস্থায় হার না মানা জয়ের মানসিকতা গড়ে ওঠা বাংলাদেশকে বড় দলে পরিণত করছে। আইসিসি ওডিআই লীগের বর্তমান পর্যায় শেষে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়।  পরিবর্তিত বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারায় বড় আসরে আরো বড় অর্জন আশা করা যেতেই পারে।

আগের ম্যাচে বিশাল রান তারা করতে শুরুতেই তামিম, লিটন, সাকিব ফিরে যাবার পর দুই তরুণ শান্ত, হৃদয় হাল ধরে দলকে জয়ের পথে ধাবিত করেছিল।  শেষ দিকে বাংলাদেশের নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান লিটল মাস্টার মুশফিক ছিনিয়ে এনেছিল জয়। সাকিব আহত থাকায় কাল তিনটি পরিবর্তন নিয়ে শুরু করেছিল বাংলাদেশ। সাকিবের জায়গায় অভিষেক হলো রনি তালুকদার, তাইজুল এবং শরিফুলকে পাল্টে আনা হলো মুস্তাফিজ এবং মৃত্যুঞ্জয়কে।

টস হেরে ব্যাটিং করা বাংলাদেশের সূচনা সুবিধার হয়নি। অভিষেক ম্যাচে রনি শুরুতেই ফিরে যায়। তামিমের কাছ থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর লম্বা ইনিংস আসলো ৮২ বলে ৬৯ রানের। অযথা ঝুঁকিপূর্ণ স্ট্রোকস না নিলে আরো বড় হতে পারতো ইনিংস। নাজমুল (৩৫), লিটন (৩৫) ভালো খেলতে থাকলেও উইকেটে স্থিতু হয়ে ফিরে যায়।

কাল তরুণ হৃদয় নিজেকে রাঙাতে পারেনি। মেহেদী মিরাজকে (৩৭) নিয়ে মুশফিক (৪৫) হাল ধরলেও একসময় মড়ক  লাগে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে।  ২৬১ থেকে ২৭৪ মাত্র ১৩ রানে বাংলাদেশ হারায় শেষ পাঁচ উইকেট। সম্ভাব্য ৩০০ রানের পরিবর্তে রান দাঁড়ায় ২৭৪। মার্ক আদায়ের ৪/৪০, জর্জ ডকরেল ২/৩১ এবং এন্ডি ম্যাকব্রাইন ২/৩৯ বাহবা পেতেই পারে ভালো বোলিংয়ের জন্য।

কাল কিন্তু ছিল মুস্তাফিজের প্রত্যাবর্তনের ম্যাচ। নিজেকে প্রমাণের জন্য ফিজ ছিল উদগ্রিব।  শুরু থেকেই ওর বোলিংয়ে ছিল পরিকল্পনার চাপ। শুরুতে হাসান মাহমুদ ভালো বোলিং করে। উইকেটে হাস ফাঁস করতে থাকা দোহানি ফিরে যাবার পর দলের হাল ধরে দুই অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান পল স্টার্লিং আর অধিনায়ক এন্ডি বালব্রাইন। ওদের যোগাযোগে দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১০৯ রান যোগ হলে স্বাগতিকরা স্বস্তির অবস্থানে পৌঁছে।

এবাদতের শর্ট বল তুলে মারতে গিয়ে মিড্ উইকেটে রনির হাতে ধরা পড়ে বালবার্নি।  কিছু পরে পল স্টার্লিংকেও (৬০) রানে ফেরায় মিরাজ। অভিষিক্ত মৃত্যুঞ্জয় চমৎকার ক্যাচ লুফে নেয় ওর বলে। এই অবস্থায় জুটি বাধে হ্যারি টেক্টর আর লড়কান টাকার। ওদের উন্নতমানের পরিমিত ব্যাটিং দলকে জয়ের পথে নিয়ে যায় ১৪৬-২২৫।

ম্যাচটি যখন স্বাগতিক দলের সামর্থের সীমানায় তখনও  হাল ছাড়েনি বাংলাদেশ। তামিম আক্রমণে নিয়ে আসে অনিয়মিত বলার নাজমুল শান্তকে। আর তাতেই বাজিমাত।  ওর বলে  লিটনের অসামান্য দক্ষতায় লুফে নেওয়া ক্যাচ ফেরায় হ্যারি টেক্টরকে (৪৫)। মুস্তাফিজ ফিরে আসে দ্বিতীয় স্পেলে। কার্টিস কাম্ফার, জর্জ ডকরেল এবং বিশেষ করে লৰ্কান টাকার (৫০) ফিরে যায় ফিজের সংহারী বোলিংয়ে।

বদলি খেলোয়াড় ইয়াসির আলী চোখ চেয়ে দেখার মত ক্যাচ লুফে নেয়। টাকারকে সরাসরি বোল্ড করে ফিজ। হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে আয়ারল্যান্ড ব্যাটিং। শেষ ওভারে হাসান মাহমুদ মার্ক আদায়ের আর এন্ডি ম্যাকব্রাইনকে ফিরিয়ে দলকে ৫ রানের জয় উপহার দেয়।

আয়ারল্যান্ডের জন্য সমবেদনা। পর পর দুটি ম্যাচ জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েও জয় হাতছানি দিয়ে চলে গেলো। এমনি পরিস্থিতি বাংলাদেশের বহুবার হয়েছে। হারতে হারতে জিততে শিখেছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে বাংলাদেশকে পরিবর্তিত দল নিয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে।

কালকের ম্যাচ এবং এই সিরিজ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার আছে। বাংলাদেশের লেট্ মিডল অর্ডার মুশফিক, মেরাজের সক্রিয়তায় কার্যকরী হলেও লেজের অবস্থা নড়বড়ে।  কঠিন ম্যাচে বড় দলের বিরুদ্ধে সংকট হবে। মাহমুদুল্লাহকে উপেক্ষা করা ঠিক হচ্ছে না। টপ অর্ডারে বিশেষত ওপেনিং পার্টনারশিপ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। শুভ লক্ষণ তামিম শেষ ম্যাচে রান পেয়েছে।

যদিও পরিবেশ এবং উইকেট ভিন্ন তবুও কঠিন পরিস্থিতিতে বিদেশে ম্যাচ এবং সিরিজ জয় বাংলাদেশকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলছে। মুস্তাফিজ ছন্দে ফিরছে। হাসান মাহমুদ পরিণত হচ্ছে।  ভাগ্য সহায়তা না করায় মৃত্যুঞ্জয় উইকেট পায়নি। শান্ত নিজেকে বিকশিত করেছে, হৃদয় জাত চিনিয়েছে।  মুশফিক নতুন ভূমিকায় সফল হয়েছে। দলের ফিল্ডিং বিশ্বমানের বলাই যায়।

আশা করি এক্সপেরিমেন্ট শেষ হয়েছে। সামনে এশিয়া কাপ।  দলে রিয়াদ, আফিফদের প্রত্যাবর্তন প্রয়োজন।

সালেক সুফী: আন্তর্জাতিক ক্রীড়া বিশ্লেষক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

1 + 12 =