‘জীবন ঘষে আগুন’ জ্বেলে চলে গেলেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। সোমবার রাত সোয়া ৯টার দিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বিহাস আবাসিক এলাকার নিজ বাড়ি ‘উজানে’ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। ষাটের দশকে বাংলা কথাসাহিত্যের বাঁকবদলের অন্যতম রূপকার হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুর খবরে সাহিত্যাঙ্গনসহ ভক্ত পাঠক মহলে নেমে আসে শোকের ছায়া। তার বাসায় ছুটে যান সাবেক সহকর্মী, শিক্ষার্থীরা।
হাসান আজিজুল হকের মৃত্যুতে শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক হাসান আজিজুল হকের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী তার শোকবার্তায় বলেন, হাসান আজিজুল হক তার সাহিত্যকর্ম ও সৃজনশীলতার জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান প্রধানমন্ত্রী ।
হাসান আজিজুল হক বেশ কিছু দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। গত ২১ আগস্ট এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে ঢাকায় আনা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই সপ্তাহের বেশি সময় চিকিৎসা নেন তিনি। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর তাকে রাজশাহী ফিরিয়ে নেওয়া হয়। তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগের সঙ্গে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন।
হাসান আজিজুল হক ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা সেই গ্রামেই করেন তিনি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছিলেন ১৯৫৬ সালে খুলনার বিএল কলেজ থেকে। তখন ছাত্ররাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনও সইতে হয়েছিল তাকে। একপর্যায়ে খুলনা থেকে এসে ভর্তি হন রাজশাহী সরকারি কলেজে। ১৯৫৮ সালে এই কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্রে সম্মানসহ ¯স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। এরপর রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা গার্লস কলেজ এবং খুলনার বিএল কলেজে শিক্ষকতার পর ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন হাসান আজিজুল হক। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৪ সাল পর্যন্ত একনাগাড়ে ৩১ বছর অধ্যাপনা করেন। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাশে নগরীর চৌদ্দপায় এলাকার আবাসিক এলাকা বিহাসে নিজের বাড়ি উজানে বসবাস করতেন হাসান আজিজুল হক। ১৯৫৮ সালে শামসুননাহারকে বিয়ে করেন তিনি। তাদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে।
হাসান আজিজুল হক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপনা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্মানসূচক ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
একাধারে গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ লিখেছেন। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে পদচারণা রাজশাহী কলেজে পড়ার সময়; ভাঁজপত্র ‘চারপাতা’য় প্রকাশিত এক রম্য রচনার মাধ্যমে। রাজশাহীর আম ছিল সেই রচনার উপজীব্য। এরপর শিক্ষকতা করতে খুলনায় গিয়ে লেখালেখিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। গণসংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে যে তরুণ দলটি, তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন।
আদমজী ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পর তার লেখায় আসে বৈচিত্র্য। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ তার লেখার অন্যতম বিষয় হয়ে ওঠে।
তার উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), নির্বাচিত গল্প (১৯৮৭), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), রোদে যাবো (১৯৯৫), হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৯৫), মা মেয়ের সংসার (১৯৯৭), বিধবাদের কথা ও অন্যান্য গল্প (২০০৭)।
উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘বৃত্তায়ন’, ‘আগুনপাখি’, ‘সাবিত্রী উপখ্যান’, ‘শিউলি’।
প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১), চালচিত্রের খুঁটিনাটি (১৯৮৬), অপ্রকাশের ভার (১৯৮৮), সক্রেটিস (১৯৮৬), অতলের আধি (১৯৯৮), কথা লেখা কথা (২০০৩), লোকযাত্রা আধুনিক সাহিত্য (২০০৫), একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা (২০০৫), ছড়ানো ছিটানো (২০০৮), কে বাঁচে কে বাঁচায় (২০০৯), বাচনিক আত্মজৈবনিক (২০১১), চিন্তন-কণা (২০১৩), রবীন্দ্রনাথ ও ভাষাভাবনা (২০১৪)।
‘চন্দর কোথায়’র মতো ভাষান্তরিত নাটকের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য লালঘোড়া আমি, ফুটবল থেকে সাবধানের মতো গল্প লিখেছেন।
সম্পাদনা করেছেন গোবিন্দচন্দ্র দেব রচনাবলী (তিন খন্ড, ১৯৭৯), দুই বাংলার ভালোবাসার গল্প (যৌথ, ১৯৮৯), একুশে ফেব্রুয়ারি গল্প সংকলন (২০০০), কুসুমে কুসুমে স্মারকচিহ্ন (অধ্যাপক মফিজউদ্দিন স্মারকগ্রন্থ), জন্ম যদি তব বঙ্গে (সারোয়ার জাহান স্মারকগ্রন্থ), বং বাংলা বাংলাদেশ (যৌথ, সনৎকুমার সাহা সম্মাননাগ্রন্থ, ২০১২), রমেন্দ্রনাথ ঘোষ : দার্শনিক প্রবন্ধাবলি (যৌথ, ২০১৪)। এছাড়া তিনি ‘প্রকৃতি’ নামে একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতির ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্রিকাও সম্পাদনা করেন।
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান হাসান আজিজুল হক। এরপর লেখক শিবির পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা পান। ১৯৯৯ সালে তাকে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে সরকার। ২০১৯ সালে পান দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কার। এছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আনন্দ পুরস্কারও ছিল তার মুকুটে। ২০১২ সালে তিনি আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৮-তে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি পান।
দেশ রূপান্তর