আফরোজা আখতার পারভীন
দুই সপ্তাহব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার পর ১৩ জুন শেষ হয়েছে বন জলবায়ু সম্মেলন। আগামী নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিতব্য কপ২৯ জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনের জন্য বেশকিছু বিষয় এখানে আলোচনার কথা ছিল।
ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ নিউজ জানিয়েছে, এই সম্মেলনে নতুন জলবায়ু তহবিল সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করেছে সবগুলো পক্ষ। সবাই চেয়েছে কপ২৯ সম্মেলনের আগে একটি পরিষ্কার কাঠামো তৈরি করতে।
ভবিষ্যৎমুখী অভিযোজন সূচক নির্ধারণেও পক্ষগুলো কাজ করেছে। এসব সূচক ব্যবহার করে আরো সুবিন্যস্ত এবং বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত কার্বন বাজার তৈরি করা সম্ভব হবে।
জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি সিমন স্টিয়েল বলেন, আমরা বন-এ ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছি। কিন্তু এখনো গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় আলোচনা হয়নি। বাকুতে সত্যিকারের সাফল্য পেতে গেলে আমাদের উচ্চাশার সুউচ্চ পর্বতে আরোহণ করতে হবে।
বন সম্মেলন শুরু থেকেই পৃথিবীর প্রায় সবগুলো দেশের মোট ৬ হাজার বিশেষজ্ঞ জলবায়ু অর্থায়নের আলোচিত এবং সমালোচিত বিষয়গুলো সমাধান নিয়ে কাজ করেছেন। ২০০৬ সাল থেকেই বিষয়টি এমন ছিল যে, ধনী দেশগুলো তুলনামূলক দরিদ্র দেশগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তার ঘোষণা দেবে। ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনে নিশ্চিত করা হয় এ ধরনের সহায়তা ২০২৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
আশা করা হচ্ছে যে, বাকুতে অনুষ্ঠিতব্য আগামী কপ২৯ সম্মেলনে এ ব্যাপারে স্থায়ী এবং কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জলবায়ু অর্থায়নের নতুন লক্ষ্যমাত্রা
এই বৈঠকে কারিগরি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আলাদা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যা টেড১০ নামে পরিচিত। এর উদ্দেশ্য ছিল, জলবায়ু অর্থায়নের নতুন সমষ্টিগত ও পরিমাণগত লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো। এছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে এটা নিশ্চিত করা যে, এই লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাকাক্সক্ষী হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু অর্থায়নের মান উন্নত করবে।
এছাড়াও এই বন সম্মেলনে সবগুলো পক্ষ থেকে আগামী কপ২৯ সম্মেলনে যে লিখিত ঘোষণা দেওয়া হবে সেটির কাঠামো নিয়েও আলোচনা করেছে।
স্টিয়েল মনে করিয়ে দিয়েছেন, জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলনগুলোর বাইরেও জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হতে হবে। কিন্তু জি৭ দেশগুলোকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে। তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলোর হাত অনেক শক্তিশালী। এমনকি উন্নয়নশীল দেশের ব্যাংকগুলোতে শেয়ার হোল্ডার হিসেবেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
অভিযোজন ও সহনশীলতা তৈরি
গত ডিসেম্বর মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছিল অভিযোজন এবং সহনশীলতা তৈরির জন্য একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। এ সময় এ বিষয়গুলোকে বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন সবাই।
বৈশ্বিক অংশীদারীত্বের অংশ হিসেবে জাতিসংঘ সবগুলো পক্ষকে আবারো ২০২৫ সালের মধ্যে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান বা এনএপি গ্রহণের উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানিয়েছে। এছাড়াও ২০৩০ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অনুচ্ছেদ ছয়ের অধীনে আন্তর্জাতিক কার্বন বাজার
এই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলো অনুচ্ছেদ ছয়ের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কার্বন ক্রেডিট অথোরাইজেশন-এর মতো বিষয়। এছাড়াও আন্তর্জাতিক কার্বন বাজারের একটি রেজিস্ট্রি তৈরিরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এখানে।
কপ২৯ সম্মেলনে অনুচ্ছেদ নম্বর ৬.২ এবং ৬.৪ দুটি আরও বিস্তারিত এবং পরিষ্কার করার জন্য গঠনমূলক কাজ করা হয়েছে বন-এ। বিশেষজ্ঞরা সিদ্ধান্তে এসেছেন এই দুটি অনুচ্ছেদকে আরো শাণিত করার জন্য নভেম্বরের আগেই তারা একটি কর্মশালার আয়োজন করবেন। ফলশ্রুতিতে বাকুতে বিষয়টি আলোচনা করা আরও সহজ হবে। এবং এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠবে একটি পরিচ্ছন্ন কার্বন বাজার।
কপ২৯ সম্মেলনকে সামনে রেখে ৬.৪ নম্বর অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করে আরো অতিরিক্ত কিছু কাজ করা হয়েছে। বৈশ্বিক কার্বন বাজারের জন্য নির্ধারিত জাতিসংঘের সংস্থাটি বাকু সম্মেলনের আগেই আলাদা বৈঠকে মিলিত হবে। এই বৈঠকে আলোচনা হবে কার্বন সরিয়ে ফেলার পদ্ধতি এবং নিঃসরণ কমানো বিষয়ক খুঁটিনাটি নিয়ে।
ক্রমবর্ধমান স্বচ্ছতা
আসন্ন কপ২৯-এর সভাপতি অংশগ্রহণকারী দেশগুলোকে তাদের দ্বিবার্ষিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন জমা দিতে বলেছেন। এসব প্রতিবেদন তাদের উচ্চাকাক্সক্ষা উপর ভিত্তি করে শক্তিশালী প্রমাণ দাখিলে সহায়তা করবে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তার উপর বন-এর বৈঠকে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, যার মধ্যে ইটিএফ-এর উপর কর্মশালা ছিল।
এই মাসের শেষের দিকে, ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ নতুন উন্নত স্বচ্ছতা ফ্রেমওয়ার্ক রিপোর্টিং টুল সরবরাহ করবে যা গ্রিনহাউস গ্যাস ইনভেন্টরি, অ্যাকশন এবং সহায়তা ট্র্যাকিংকে একীভূত করবে। মাইক্রোসফট-এর সাথে অংশীদারিত্বে, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন এই তথ্যমালাকে সচল করার জন্য একটি নতুন জলবায়ু ডেটা হাবও তৈরি করছে।
জাতিসংঘ ইতিমধ্যে ১৫০ দেশের ১১০০ এরও বেশি বিশেষজ্ঞকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে সরকারি সংস্থাসহ হাজারো ব্যক্তি এ বিষয়ে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করেছেন।
এনডিসি ঘিরে বাড়ছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা
আগামী বছরের শুরুতেই পক্ষগুলোকে তাদের ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড এমবিশন বা এনডিসি প্রদান করতে হবে। এই এনডিসি হবে ১.৫ ডিগ্রি সীমানাকে মাথায় রেখে এবং মনে রাখতে হবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বিষয়টিও। বন-এ অনুষ্ঠিত বৈঠকে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন এবং এনডিসি পার্টনারশিপ মিলে এনডিসি ৩.০ নেভিগেটর চালু করেছে। যা পক্ষগুলোকে বিভিন্ন তথ্য প্রদানের মাধ্যমে এনডিসি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা করবে।
১৩০টি দেশে পরিচালিত প্রায় ১৯ শতাধিক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংগঠন ‘ক্লাইমেট একশন নেটওয়ার্ক ইন্টারন্যাশনাল’ বন সম্মেলনের ফলাফল নিয়ে বলেছে, বন পুরোপুরি ব্যর্থ। জাতিসংঘের সব ধরনের আলোচনাই ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা একটি জলবায়ু জরুরি অবস্থার মধ্যে আছি। আর ধনী দেশগুলো খুব সহজেই এ কথাটি ভুলে যাচ্ছে। আলোচনার টেবিলে কোনো অগ্রগতি হয়নি। জুনের মধ্যবর্তী সম্মেলন একটি ফাঁপা বেলুন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
সংস্থাটি মনে করে ট্রিলিয়ন ডলারের জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিশ্রুত ছাড়া এই সমস্যার কোনো ধরনের সমাধান সম্ভব নয়। তারা আরো বলছে দশকের পর দশক ধরে ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি তাদের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছে।
সেন্টার ফর সাইন্স অ্যান্ড এনভারমেন্ট বিজ্ঞানীরা বলছেন আগামী বাকু সম্মেলনে বিশ্বকে কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। কারণ আমরা বন-এর মধ্যবর্তী সম্মেলনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ব্যর্থ হয়েছি।
জলবায়ু অর্থায়নের নিউ কালেক্টিভ কোয়ান্টিফায়েড গোল (এনসিকিউজি) এর শিরোনাম ইস্যুতে, এই আলোচনা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উভয়পক্ষের প্রতিনিধিরা এই প্রক্রিয়া নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের জন্য স্টিকিং পয়েন্ট হলো নতুন লক্ষ্যের আকার নিয়ে আলোচনার অভাব, যা প্রযুক্তিগত ভাষায় ‘কোয়ান্টাম’ নামে পরিচিত। উন্নত দেশের সরকার ইতিমধ্যে সম্মত হয়েছে যে নতুন লক্ষ্যমাত্রা ‘প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফ্লোর থেকে’ বিদ্যমান প্রতিশ্রুতি নির্ধারণ করা উচিত এবং ‘উন্নয়নশীল দেশের চাহিদা এবং অগ্রাধিকার’ বিবেচনায় নেওয়া উচিত। উন্নত দেশগুলো তাদের প্রতিপক্ষদের অভিযুক্ত করেছে যে, তারা অভিন্ন পথ সন্ধান না করে তাদের নিজেদের অবস্থানে অনড় রয়েছে।
লেখক: আফরোজা আখতার পারভীন, সম্পাদক, রঙবেরঙ
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেশ