কপ৩০: রাজনৈতিক গতি বাড়ছে, কিন্তু ব্রেকথ্রু এখনো অধরা

আফরোজা আখতার পারভীন, ঢাকা

কপ৩০-এর নবম দিনে বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনার কেন্দ্রস্থলে থাকা বেশ কয়েকটি অনিষ্পন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচকরা তীব্র লড়াই চালিয়ে যান। ব্রাজিলিয়ান সভাপতিত্ব নতুন আপস-মূলক ভাষা সংযোজন করলেও ফসিল ফুয়েল ফেজআউট প্রতিশ্রুতি এবং ২০৩০-পরবর্তী অর্থায়নের পরিমাণ নিয়ে দ্বন্দ্ব বহাল থাকে। চুক্তির সুযোগ ক্রমশ সংকুচিত হওয়ায় সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য মন্ত্রীদের আহ্বান করা হয়। বেলেং শহরের বাতাসে ছিল সতর্ক প্রত্যাশা, আর সঙ্গে পর্যবেক্ষক ও কর্মীদের মধ্যে বাড়তে থাকা হতাশা।

আলোচকরা কঠিন ইস্যুগুলোকে মন্ত্রী/সভাপতি পর্যায়ে পাঠিয়েছেন, যখন বিভিন্ন সরকার ও নাগরিকসমাজ ফসিল ফুয়েল ধাপে ধাপে বন্ধ করা, ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য অর্থায়ন, এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি রূপান্তরের (খনিজসহ) স্পষ্ট নিয়মকাঠামোর দাবি জানিয়ে চাপ ধরে রেখেছে। ব্রাজিলিয়ান সভাপতিত্ব “বেলেম প্যাকেজ” নামের একটি সমন্বিত চুক্তি তৈরির চেষ্টা চালালেও মূল পাঠ্য নিয়ে মতবিরোধ রয়ে গেছে। রাজনৈতিক নেতাদের—বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট লুলাকে—অ্যামাজন সুরক্ষা ও অর্থায়নে দ্রুত ও শক্ত প্রতিশ্রুতি না দেওয়ার কারণে আদিবাসী গোষ্ঠী ও কর্মীরা সমালোচনা করেছেন। বৃহৎ, অবিরাম নাগরিকসমাজ আন্দোলন (আদিবাসী গোষ্ঠী, যুব সংগঠন, এনজিও) দ্রুত এবং ন্যায্য ফসিল ফুয়েল ফেজআউট এবং অভিযোজন/অর্থায়নে শক্তিশালী প্রতিশ্রুতির দাবি অব্যাহত রেখেছে।

১) আলোচনার ফলাফল — নবম দিনের অগ্রগতি ও স্থবিরতা

  • বেলেম প্যাকেজ এখনো চূড়ান্ত নয়, তবে কঠিন ইস্যুগুলো একত্র করার চাপ অব্যাহত

ব্রাজিলের কপ সভাপতিত্ব অবশিষ্ট রাজনৈতিক ইস্যুগুলো (অর্থায়ন, ফেজআউট ভাষা, আর্টিকেল ৬ ইত্যাদি) একত্র করে একটি মন্ত্রী পর্যায়ের প্যাকেজ তৈরির চেষ্টা করে। প্রযুক্তিগত আলোচনার পর আলোচকরা মন্ত্রী পর্যায়ে চলে যান। অগ্রগতি ছিল অসম—রাজনৈতিক সমন্বয়ের অনেক কাজ বাকী।

  • ফসিল ফুয়েল/ফেজআউট ভাষায় রাজনৈতিক অগ্রগতি হলেও পাঠ্য রয়ে গেছে দুর্বল

সভাপতিত্বের খসড়ায় ফসিল ফুয়েল থেকে ধাপে ধাপে সরে যাওয়ার ভাষা যুক্ত হওয়ায় আশাবাদ তৈরি হয়, কিন্তু ভাষার অস্পষ্টতা ও ব্যতিক্রমের সুযোগ রাখায় অনেক দেশ সমালোচনা করে। প্রায় ৭০-৮০টি দেশ স্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানালেও তেল/গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলোর আপত্তি ঐকমত্য ধীর করে।

  • নতুন ইস্যু: ক্রিটিক্যাল মিনারেলস নিয়ে বিরোধ

প্রথমবারের মতো পরিচ্ছন্ন জ্বালানি রূপান্তরে প্রয়োজনীয় খনিজকে “জাস্ট ট্রানজিশন” পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আসে। চীন ও রাশিয়া এ নিয়ে আপত্তি জানায়, যা চূড়ান্ত চুক্তি বিলম্বিত করতে পারে।

  • আর্টিকেল ৬/কার্বন বাজার আনুষ্ঠানিকতা

পর্যবেক্ষকরা দ্রুত সমাধান আশা করলেও, আলোচকদের আরও কিছু প্রযুক্তিগত বিষয় চূড়ান্ত করা প্রয়োজন ছিল।

২) কপ সভাপতিত্ব — নবম দিনে কী কর

  • সক্রিয় শাটল কূটনীতি ও খসড়া “বেলেম প্যাকেজ”

সভাপতিত্ব (ব্রাজিল) বিভিন্ন আলোচনার কক্ষে ঘুরে খসড়া পাঠ্য ও “সভাপতির চিঠি” প্রকাশ করে। তিনটি সমান্তরাল ট্র্যাক—মন্ত্রী পর্যায়, প্রযুক্তিগত কাজ, এবং সরাসরি সভাপতির পরামর্শ—চলমান ছিল। COP30-কে তারা “অ্যাকশন এজেন্ডা” হিসেবে উপস্থাপন করে, যেখানে বাস্তবায়ন ও উদ্যোগের রূপায়ণে জোর দেওয়া হয়।

  • ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা

রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল বিষয়গুলো (ফসিল ট্রানজিশন ভাষা, প্রকৃতি/বন সংক্রান্ত উল্লেখ, বাস্তবায়ন উদ্যোগ) অন্তর্ভুক্ত করতে গিয়ে সভাপতিত্ব ইচ্ছাকৃতভাবে ভাষা নরম রাখে—যা দেশসমূহ ও নাগরিকসমাজের মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

৩) ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট — দৃশ্যমানতা ও সমালোচনা

  • দৃশ্যমান উপস্থিতি, কিন্তু সিদ্ধান্তমূলক অগ্রগতি সীমিত

প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা আলোচনায় অংশ নিয়ে বক্তব্য দিলেও, তার ভূমিকা কার্যকর ব্রেকথ্রুর চেয়ে হোস্ট দেশের নেতা হিসেবে বেশি প্রতীয়মান হয়। এর ফলে তিনি প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু হলেও আলোচনার চালিকা শক্তি হিসেবে দেখা যায়নি।

  • অ্যামাজন ও আদিবাসী অধিকার নিয়ে তীব্র সমালোচনা

আদিবাসী প্রতিনিধিদল ও বিক্ষোভকারীরা লুলার কাছে আরও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি ও অ্যামাজন সুরক্ষায় বাস্তব পদক্ষেপ দাবি করে। নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন কিছু প্রতিবাদও ঘটে। খবরমাধ্যমে লুলাকে “পর্যাপ্ত দ্রুত ও শক্ত প্রতিশ্রুতি দিতে না পারা নেতা” হিসেবে তুলে ধরা হয়।

৪) নাগরিক সমাজের অবস্থান

  • বৃহৎ ও দৃশ্যমান আন্দোলন

“গ্রেট পিপলস মার্চ”-এ হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়ে ন্যায়ভিত্তিক ফসিল ফুয়েল ফেজআউট, আদিবাসী ভূমি সুরক্ষা, পুনরুদ্ধার-ক্ষতিপূরণ, ও আরও বেশি অর্থায়নের দাবি জানায়।

মূল দাবি

  • ১. তেল–গ্যাস–কয়লা ধাপে ধাপে বন্ধের স্পষ্ট, সময়বদ্ধ রোডম্যাপ
  • ২. অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি তহবিলে বড় ও পূর্বানুমেয় অর্থায়ন
  • ৩. আদিবাসী অধিকার ও অ্যামাজন সুরক্ষা অ-সমঝোতামূলক
  • ৪. কর্পোরেট লবিস্টদের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা
  • কৌশল ও প্রভাব

প্রতিবাদের কারণে নিরাপত্তা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, কিছু আলোচনাও ব্যাহত হয়, এবং রাজনৈতিক চাপ আরও বাড়ে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা নাগরিক অংশগ্রহণ সীমিত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

৫) ভবিষ্যৎ প্রভাব ও নজরদারি (What to Watch Next)

১. মন্ত্রী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত — তারা কি সভাপতির “বেলেং প্যাকেজ” গ্রহণ করবে, নাকি পুনর্লিখন চাইবে।

২. ফসিল ফুয়েল ফেজআউট ভাষা — সময়সীমা, ব্যতিক্রম ও “জাস্ট ট্রানজিশন” ধারা চূড়ান্ত নথিতে কীভাবে আসবে।

৩. অর্থায়ন ও ক্ষয়ক্ষতি ফান্ড — নতুন অঙ্গীকার বা আর্থিক প্রক্রিয়া ঘোষণা হবে কি না।

৪. ক্রিটিক্যাল মিনারেলস — পাঠ্যে থাকলে জ্বালানি রূপান্তরের ভূরাজনীতি প্রভাবিত হতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve − ten =