কবি দাউদ হায়দারের নির্বাসিত জীবনের চিরমুক্তি

‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’- পংক্তিমালা এসেছিল যার কলম হয়ে, সেই নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার চলে গেলেন জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে।

শনিবার রাতে জার্মানির রাজধানী বার্লিনের একটি বয়স্ক নিরাময় কেন্দ্রে মৃত্যু হয় ৭৩ বছর বয়সী এই কবির। খবর বিডিনিউজ২৪.কম

তার ভাতিজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাওন্তী হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্থানীয় সময়ে রাত ৯টা ২০ মিনিটে মারা গেছেন চাচা। বিস্তারিত পরে আমরা জানাতে পারব।”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক আরিফ হায়দার বলেন, তার ভাই দাউদ হায়দার জার্মান সরকারের ব্যবস্থাপনায় থাকায় তার শেষকাজ সেখানকার সরকারি ব্যবস্থাপনায় হতে পারে।

“বাঙালি কমিউনিটি চাইলে তাদের ব্যবস্থাপনাতেও হতে পারে।”

১৯৭৪ সালে দেশ ছাড়ার পর কয়েক বছর কলকাতায় কাটিয়ে ১৯৮৭ সালে সেখান থেকে জার্মানিতে চলে যান দাউদ হায়দার। এরপর থেকে সেখানেই ছিলেন তিনি।

চিরকুমার দাউদ হায়দার আগে থেকেই নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। গতবছর ডিসেম্বরে বার্লিনের বাসার সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে তিনি মাথায় আঘাত পান। সে সময় তাকে হাসপাতালের আইসিইউতেও নিতে হয়।

এরপর হাসপাতাল ছাড়লেও আর সুস্থ জীবনে ফিরতে পারেননি দাউদ হায়দার।

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পাবনায় দাউদ হায়দারের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, লেখক এবং সাংবাদিক।

১৯৭৪ এর ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার কবিতা ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ প্রকাশিত হলে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের’ অভিযোগে তার বিরূদ্ধে মামলা হয়। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হলে ১১ মার্চ তাকে আটক করে পুলিশ।

২০ মে মুক্তি দেওয়া হলেও কবিকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি তখনকার সরকার। পরদিন সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তাকে একপ্রকার খালি হাতে কলকাতায় পাঠানো হয়।

কবি লিখেছিলেন, সে সময় তার কাছে ছিল মাত্র ৬০ পয়সা, কাঁধে ঝোলানো একটি ব্যাগে ছিল কবিতার বই, দুজোড়া শার্ট, প্যান্ট, স্লিপার আর টুথব্রাশ।

“আমার কোনো উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। সরকারও হয়ত আমার মৃত্যু কামনা করছিল,” লিখেছিলেন দাউদ হায়দার।

আরিফ হায়দার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কবি দাউদ হায়দার ১-২ বছরের নিয়মিত বিরতিতে কলকাতায় আসতেন।

“সেখানে ভাই-বোনরা মিলে যেতাম, সবার দেখা হতো।”

সবশেষ ২০২৪ সালে সাক্ষাৎ হওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণত কলকাতা বইমেলায় উনি আসতেন।

“মাসখানেকের মতো সময়ের জন্য আসতেন। উনি জার্মানিতে একাই থাকতেন।”

দাউদ হায়দারের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’, ‘সম্পন্ন মানুষ নই’, ‘নারকীয় ভূবনের কবিতা’, ‘যে দেশে সবাই অন্ধ’, ‘ধূসর গোধূলি ধূলিময়’, ‘আমি ভালো আছি, তুমি?’

তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আরও রয়েছে-‘নির্বাসিত’, ‘সংগস অব ডেস্পায়ার’, ‘এই শাওনে এই পরবাসে’, ‘বানিশম্যান্ট’, ‘আমি পুড়েছি জ্বালা ও আগুনে’, ‘এলোন ইন ডার্কনেস অ্যান্ড আদার পোয়েমস’, ‘হোল্ডিং অ্যান আফটারনুন অ্যান্ড আ লিথ্যাল ফায়ার আর্ম’, ‘অবসিডিয়ান’।

দাউদ হায়দারের বহুল আলোচিত আত্মজীবনী ‘ইল্লিন ঝিল্লিন’-এ উঠে এসেছে পাবনার দোহারপাড়া গ্রামে কবির বেড়ে ওঠার কাহিনী। অন্যদিকে ষাট দশকের শেষভাগ থেকে তার কবি ও বহুমাত্রায় প্রেমিক হয়ে ওঠার সত্য গল্পের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ সময়ের খণ্ড ছবি আছে তাতে।

দাউদ হায়দারের ভাইদের মধ্যে প্রয়াত হয়েছেন নাট্যকার জিয়া হায়দার, কথাশিল্পী রশীদ হায়দার ও কবি মাকিদ হায়দার। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন জাহিদ হায়দার, আবিদ হায়দার ও আরিফ হায়দার। তারা সবাই সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twelve + sixteen =