কমরেড রনোর মহাকাল যাত্রা

মাহবুব আলম

বাংলাদেশের রাজনীতির সাহসী ও পরিচ্ছন্ন মুখ কমরেড হায়দার আকবর খান রনো আর নেই। তিনি প্রয়াত হয়েছেন। ১১ মে শনিবার রাত ২:০৫ মিনিটে (শুক্রবার দিবাগত রাতে) দেহবসান হয়েছে। তিনি যাত্রা করেছেন মহাকালের পথে। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন তিনি সিওপিডি রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। ২৪ ঘণ্টাই তাকে অক্সিজেন দিয়ে থাকতে হতো। সেইসাথে ছিল কাশি। ভুল চিকিৎসার কারণে এক চোখে একদম দেখতে পেতেন না। আরেক চোখে ঝাপসা দেখতেন। তারপরও তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের যে লড়াই তা চালিয়ে গেছেন। লড়েছেন সাহসের সাথে। পার্টির বৈঠকে হাজির হয়েছেন অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ। আর লেখালেখি চালিয়েছেন পুরো দমে। দৃষ্টিশক্তি হারানোর জন্য পড়তে পারতেন না। এজন্য দুঃখ করতেন। বলতেন, আমি অসুস্থ, গুরুতর অসুস্থ, সার্বক্ষণিক অক্সিজেন নিয়ে থাকতে হয়। যখন কাশি হয় মনে হয় জীবন বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতে আমার দুঃখ নেই, আমার একটাই দুঃখ আমি কোনো বই পড়তে পারি না।

যা হোক, এজন্য তিনি বিকল্প ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন, তা হলো – তার বাড়িতে তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য যে দুজন ছিলেন তারা তাকে প্রতিদিনের নিউজ পেপার পড়ে শুনাতেন। সেই সাথে বিভিন্ন বই। এছাড়াও তাকে দেখতে গেলে অনেককে তিনি বলতেন, এই বইটা একটু পড়ে শুনাও। এখানেই শেষ নয়, এ অসুস্থ অবস্থায় তিনি লেখালেখি করেছেন ডিকটেশন দিয়ে। প্রধানত অন্তু নামের এক তরুণ কমরেড নিয়ম করে সপ্তাহে দুই দিন গিয়ে তার ডিকটেশন অনুযায়ী কম্পিউটারে কম্পোজ করতেন। কম্পোজ করার পর তা তিনি পড়ে শুনাতেন। শুনে কমরেড রনো প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে বলতেন। যতক্ষণ না তিনি সন্তুষ্ট হতেন ততক্ষণ চলতো এভাবেই রনো ভাইয়ের লেখালেখি।

এখানে একটা কথা বলার দরকার তা হলো – গুরুত্ব অসুস্থ হলেও তার স্মৃতিশক্তি ছিল প্রখর। মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে গত বছর ৩১ আগস্ট তার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে তার বাড়িতে এসেছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি এমএল পিডির শীর্ষ নেতাসহ ৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। এই দিন পার্টি কমরেডদেরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে ঘরভর্তি মানুষের হৈ-হুল্লোড় আনন্দ উৎসব। এই উৎসবে জার্মান পার্টির নেতারা একের পর এক গান গেয়ে কমরেড রনোকে উজ্জীবিত করেন। উজ্জীবিত কমরেড রনোও একের পর এক রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। এমনকি মৃত্যুর কদিন আগেও তিনি কমরেডদের কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। অবশ্য, এটা আমরা দেখেছি সেই শুরু থেকে। যে কোনো আড্ডায় কমরেড রনো রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ সব কবিতা আবৃত্তি করেছেন বই না দেখে। আমার জানা মতে শেষ বয়সেও তার কয়েকশো কবিতা মুখস্ত ছিল। তাকে কবিতার এক লাইন ধরিয়ে দিলে পুরো কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, শেক্সপিয়ারের কবিতাও তিনি অনর্গল আবৃত্তি করেছেন অসুস্থ অবস্থার মধ্যেও। এক কথায় অসুস্থতা তার স্মৃতিশক্তির কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।

দেখা হলে কথা হলে (ফোনে) সব সময় পার্টি ও বাম রাজনীতিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতির খোঁজখবর নিতেন। সম্প্রতি ভারতে লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে। দু’দফার নির্বাচন শেষের পর আমি ফোন করে বলেছিলাম পশ্চিমবঙ্গ বিহারসহ ভারতের বিভিন্ন স্থানে বামপন্থীরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এই খবরে খুব খুশি হন। তবে তিনি সুনির্দিষ্ট করে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা জানতে চান। একই ঘটনা দেখেছি গত বছর কলম্বিয়ায় বামপন্থী নেতা পেড্রোর জয়ের পর। দেখেছি এ বছর নাইজারে ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ বিদ্রোহী বিক্ষোভ নিয়ে তার উচ্ছ্বাস। আর প্রায়ই খোঁজ নিতেন নেপালে কমিউনিস্ট সরকার কতটা কি করতে পারছে ইত্যাদি। এক কথায় কমরেড রনো ছিলেন এক বিশ্ববিপ্লবী। সমাজতন্ত্রের এক অবিচল সৈনিক।

আর তাইতো আরেক বিশ্ববিপ্লবী নেদারল্যান্ডের কিউটার কস্টারের সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও নিবিড় যোগাযোগ। তার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল জ্যোতি বসু, প্রকাশ কারাত, হারকিসেল সিং, সুরঞ্জিত মাধব কুমার নেপালসহ বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অনেক শীর্ষ নেতাদের। তাইতো তিনি ফিদেল কাস্ত্রো, দানিয়েল এরদেগা, আনোয়ার হোকসা, ব্রেজনেভ, কিম ইল সুঙসহ বিশ্ব নেতাদের আমন্ত্রণে ছুটে গেছেন বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। এমনকি ভারত ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গেও তার যোগাযোগ ছিল। এদের মধ্যে একজনের নাম বলতে পারি তিনি হলেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির লিবারেশনের নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। অবশ্য তিনি এখন আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে এসে প্রকাশ্যে পার্টি করছেন। বিহার ও ঝাড়খণ্ডে এই পার্টির যথেষ্ট প্রভাব আছে। বিহারের বিধানসভায় সিপিআইএমএল এর (লিবারেশন) ১৩টি আসন রয়েছে। ২০২৪ এর লোকসভায় এবার কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম শরিক।

কমরেড রনো সদ্যপ্রয়াত হয়েছেন। তাই তাৎক্ষণিকভাবে তার সম্পর্কে কিছু লেখা কিছু বলা আমার জন্য খুবই কঠিন ও কষ্টসাধ্য। তাই আমি আমার কথা না বলে মৃত্যু পরপরই তাৎক্ষণিকভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব মন্তব্য করা হয়েছে সেইসব মন্তব্যের কয়েকটি সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরছি। কারণ আমি মনে করি কমরেড রনোর মূল্যায়নে সোশ্যাল মিডিয়ার এই তাৎক্ষণিক বক্তব্য ভবিষ্যতে ইতিহাসের জন্য এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। ঠিক যেমনটা হয়েছে জোসেফ স্তালিনসহ অন্যান্য বিশ্ববিপ্লবীদের বেলায়। জোসেফ স্তালিনের মৃত্যুর পর ভারতে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর দীর্ঘ শোক বিবৃতি-বক্তব্য। ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতা ও পণ্ডিত অধ্যাপক হেরান্ড লাস্কির শোক বিবৃতি। রেভারেন্ড হিউলেট জনসন, ডিডি, বিএনস, ডিটিএইস, ডিন অব ক্যান্টারবারির স্মারক বক্তৃতায়।

স্তালিনের মৃত্যুর পর ১৮ এপ্রিল ১৯৫৩ সালে তিনি এই স্মারক বক্তৃতা করেন। দীর্ঘ বক্তৃতার স্তালিনের আদ্যোপ্রান্ত তুলে ধরে তার ভূয়সি প্রশংসা করে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তাকে দেখা ও চেনার সুযোগ আমার হয়েছিল। তার সহজ সরল চরিত্র মুগ্ধকর। পরিচ্ছন্ন ছিল সামান্য মোকাবেলা করার ধারণা। অসাধারণ সাধারণ জ্ঞান, অপরকে শোনার অপূর্ব প্রতিভা ও ধারণা জ্ঞান অনুযায়ী নিজের পরিকল্পনা কাজে লাগানোর ক্ষমতা। তিনি আরো বলেন, খুব সত্যি স্তালিন শিখেছিলেন মানুষের কাছে। এমনকি জনসাধারণকে শেখাচ্ছেন তখনো। তার ফলেই তার ক্ষমতা, জ্ঞানের শক্তিশালী পরিধি তৈরি হয়েছিল।

স্তালিন সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, স্তালিন যে সর্বদা নিজের মস্তিষ্কে চিন্তা করতেন তা নয়, তিনি বিশেষজ্ঞ সমিতি, অ্যাকাডেমিক অফ সাইন্স, ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের শিল্পী-কুশলী প্রধানদের মস্তিষ্কের মধ্য দিয়েও ভাবতেন। আর সর্বশেষ যে কথা বলেন, খ্রিষ্ট্রীয় ধর্মের সর্ববৃহৎ ধর্মগুরু যিনি এক সময় চরম কমিউনিস্ট বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন সেই ডিন অফ ক্যান্টারবারি রেফারেন্ড হিউলেট জনসন বলেন, স্তালিন ছিলেন একজন শান্তি মানব।

এ থেকে স্পষ্ট যে, বিখ্যাত ব্যক্তিদের চেনাজানা ও মূল্যায়নের জন্য তার মৃত্যুর পর যে তাৎক্ষণিক বক্তব্য আসে তা ইতিহাসের এক অনবদ্য অধ্যায়ে পরিণত হয়।

এখানে একটা কথা বলে রাখি আমি কোনোমতেই জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে কমরেড রনোর তুলনা করছি না। এটা চরম দৃষ্টতা। একজন বিশ্ববিপ্লবের সফল নেতা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ ফ্যাসিস্ট হিটলারকে পরাজিত করে বিশ্বকে দানবমুক্তিদায়ী মহাবীর। অন্যদিকে কমরেড রনো তার নিজ দেশে বিপ্লবের ধান বুনতে পারলেও বিপ্লব সম্পূর্ণ করা দূরে থাক বিপ্লবের জন্য যথার্থ ক্ষেত্র প্রস্তুত করতেও সমর্থ হয়নি। অবশ্যই, একটা সময়। সময় তাকে ও তার সহযোদ্ধাদের সঙ্গ দেয়নি। সে যাই হোক, সময়কে জয় করার অদম্য বাসনা নিয়ে যে লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন কমরেড রনো তাকেও ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও পূর্ব ইউরোপ সমাজতন্ত্রের বিপর্যয় না হলে বাংলাদেশে কি হতো তা এখন গবেষণার বিষয়। তারপরও কমরেড রনো সেই বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে ২০০০ সালে আগমনের দিন লিখিত বিবৃতি দিয়ে বলেন, একুশ শতক হবে সমাজতন্ত্রের শতক। সেই সময় ওই বিবৃতির প্রচার পায়নি! বরং এ নিয়ে এদেশের মিডিয়া আর ক্ষমতা লিপ্সু বুর্জুয়াদলের সঙ্গে ইসলামের নামধারী উচ্ছিষ্টভোগী বিভিন্ন দল ওই বিবৃতি নিয়ে হাসি তামাশা মশকরা করে। কিন্তু কমরেড রনো ও তার পার্টিসহ এদেশের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী আন্দোলনের নেতারাই ওই ঠাট্টা মশকরাকে পাত্তা না দিয়ে নিরলসভাবে সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার সংগ্রাম করে গিয়েছেন। শ্রেণিসংগ্রামকে যতটা তারা সম্ভব এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

আমি আমার এই লেখাকে আর বাড়াতে চাই না। তাই যা বলছিলাম, তাৎক্ষণিক মন্তব্য শোকবার্তার সংক্ষিপ্ত সারের কথা। আমি এবার তাই তুলে ধরছি। তার আগে শুধু এটুকুই বলে নেই যে তাৎক্ষণিক মন্তব্য যারা করেছেন এরা সবাই পার্টির সদস্য বা দলীয় কর্মী নয়। অধিকাংশ কমরেড রানোর অনুসারী, শুভানুধ্যায়ী ও সাধারণ মানুষ। শুরুতে আমি লেখক গবেষক আলতাফ পারভেজের মন্তব্যের অংশবিশেষ তুলে ধরছি। এরপর একে একে অন্যদের মন্তব্য।

“শিবপুর মুক্তাঞ্চল থেকে টঙ্গী শিল্পাঞ্চল পর্যন্ত রনো ভাইয়ের কাছে ছিল হাজার হাজার সংগ্রামী গল্প। শুনতে বসলে সেগুলো আর শেষ হতো না। একটার পর একটা সিগারেট ধরাতেন আর বলতেন। মাঝে মাঝে নিজেই রান্নাঘর থেকে পুত্রবৎ শ্রোতাদের জন্য নাস্তা-পানি নিয়ে আসতেন।

পদার্থবিজ্ঞান থেকে দর্শন পর্যন্ত তিনি লিখেছেনও বিপুল। পদার্থবিদ্যা তার প্রিয় বিষয় ছিল। তবে ‘মার্কসবাদ ও স্বতন্ত্র সংগ্রাম’ ছিল স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ের সবচেয়ে হিট বই। এই বই পড়েই লেখালেখিতে উৎসাহিত হয়েছিলাম। এই বইটি নিজেই তরুণদের কাছে একটা হাতিয়ার হয়ে ছিল দীর্ঘ সময়।

ব্যক্তি রনোর সবচেয়ে শক্তিশালী দিক ছিল নিশ্চিতভাবে তার নিজ নিরহঙ্কারী-নির্ভয়-সাদাসিধা ভঙ্গি। এই গুণ কিভাবে পেয়েছিলেন জানি না। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি তুলনাহীন এক নজির।

তার সঙ্গে গল্পের আসরগুলো মিস করবো। এদেশে তার সেরা রাজনৈতিক প্রজন্মের একজনকে হারালো। তবে রনো ভাই তৃপ্ত ছিলেন। জীবনকে যেভাবে যাপন করতে চেয়েছিলেন সেভাবে যাপন করে গেছেন। কেবল অসুস্থতার দিনগুলো ছাড়া।

(নানা) নওশের আলী থেকে হায়দার আকবর খান রনো বাংলার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ এক পারিবারিক ধারা – সেই কৃষক প্রজা পার্টি থেকে যা শুরু হয়েছিল – ২০২৪ এ এসে তা থামলো। এরকম মানুষদের অভিবাদনের চেয়েও বেশি কিছু পাওয়ার আছে। নিশ্চয়ই ইতিহাস তা দেবে।”

মোহাম্মদ ফারুক ফেসবুকে লিখেছেন, “হায়দার আকবর খান রনো পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক, রুচিশুদ্ধ সুলেখক। ভেরেন্ডা গাছ, মাকাল ফল, বনসাইতে ঠাসা এই দেশে তিনি ছিলেন চন্দন বৃক্ষ। মৃত্যুতে হয় না শেষ কোন কোন প্রখর জীবন। রনো ভাই শত শুভময়তায় উত্তীর্ণ উদাহরণ হয়ে আপনি বেঁচে থাকবেন।”

বিমল কান্তি দাস লিখেছেন, “আড্ডার মতো একটা বিষয়কে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করার মতো জাদুকরি ক্ষমতা রনো ভাইয়ের অধিকারে ছিল। তুমুল আড্ডাবাজ হলেও রনো ভাই ছিলেন চলনে ও বলনে একজন পরিশীলিত মানুষ। তার সেজন্য জ্ঞান ছিল নির্ভুল ও অসাধারণ, ছিলেন বিশুদ্ধ নিখাদ ভদ্রলোক।” তিনি আরো লিখেছেন, “তিনি ছিলেন শব্দের জাদুকর। বাংলা সাহিত্যের অনুপ্রাস বা পান ব্যবহারে শিবরাম চক্রবর্তী ছাড়া তার তুল্য দক্ষতা আর কারো নেই।”

আশরাফুল ইসলাম তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “বাম রাজনীতি পুরোধা ব্যক্তি ছিলেন তিনি।  রাজনীতিবিদ হয়েও যে সৎ আদর্শবান ও নির্লভ থাকা যায় তারই প্রকৃতই উদাহরণ তিনি। ক্ষমতায় যাওয়ার বারবার সুযোগ ও প্রলোভনেও তিনি কখনো নীতি থেকে বিচ্যুত হননি।”

শরিফ শমসের লিখেছেন, “আমার জানামতে সহজ ভাষায় তার মতো রাজনৈতিক সাহিত্য রচনা করেছেন যেমন আর কেউ নেই।”

সাইফুল তপন রনো ভাইয়ের দানকৃত কর্নিয়ায় দৃষ্টিশক্তি প্রাপ্ত দুই যুবক শৌরভ (২৪) ও আনোয়ার হোসেনের ছবি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, “কেবল চোখের দৃষ্টি নয়, আপনার দৃষ্টিভঙ্গি এবং কাক্সিক্ষত দেশের স্বপ্ন জেগে উঠবে আগামী প্রজন্ম।”

উম্মুল আরা সুইটি লিখেছেন, “সাম্য আর ক্ষমতার পথে হেঁটে হেঁটে যে বীজ ছড়িয়েছেন তা এগিয়ে যাক। কমরেডরা আপনার মতই হোক।”

বিকাশ দেব ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, “আজীবন বিপ্লবী মার্কসবাদী তান্ত্রিক কমরেড রনো ভাই নিজে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছেন, স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য লড়াই করেছেন। মৃত্যুর পরে তার সেই চোখ দিয়ে দুজন পৃথিবী দেখবে। লাল সালাম রনো। আপনার জন্য আমরা গর্বিত। আমরা আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লড়াই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাব।”

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা, সিপিএম পলিট ব্যুরোর ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে কমিটির সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম তার শোকবার্তায় বলেছেন, “কমরেড রনোর মৃত্যু উপমহাদেশের বাম আন্দোলনের এক বড় ক্ষতি। তিনি আরো বলেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য তার লড়াই এবং অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশের লক্ষ্যে তার অবদান অমর হয়ে থাকবে।”

ডব্লিউএফটিইউ এক শোক বিবৃতিতে বলেছে, “বাংলাদেশে শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনে কমরেড রনো এক ঐতিহাসিক নেতা। তিনি তার সারা জীবনটাই উৎসর্গ করেছেন দেশের শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামে।”

কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান উপদেষ্টা কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম তাৎক্ষণিক বক্তব্যে ডিবিসিকে বলেন, “হায়দার আকবর খান রনোর নাম ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে?। তিনি আপসহীনভাবে সংগ্রাম করেছেন এবং প্রত্যেক সংগ্রামে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।”

রাশেদ খান মেনন বলেছেন, “রনো আপাদমস্তক কমিউনিস্ট ছিলেন। সেই ছেলেবেলা থেকেই কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি তার আকর্ষণ আমার মধ্যেও সংক্রমিত করেছিলেন। আমি শেষপর্যন্ত কতখানি কমিউনিস্ট হতে পেরেছি জানি না, তবে তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ছাত্রজীবনে যে কমিউনিস্ট আদর্শ আঁকড়ে ধরেছিলাম দুজনে মিলে, সেই আদর্শে অবিচল থেকেছি এই শেষ বয়স পর্যন্ত।”

১৩ মে সোমবার বেলা আড়াইটায় এই মহান কমরেডের অন্তিম যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) অফিস প্রাঙ্গণ থেকে। এর আগে সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত সিপিবি অফিসে তার মরদেহের প্রতি পার্টি নেতৃবৃন্দ পুষ্পার্ঘ অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনের শুরুতে তার কফিন মুড়ে দেওয়া হয় কাস্তে হাতুড়ি খচিত রক্তলাল পতাকা দিয়ে। পার্টি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তাদের পাশে ছিলেন পার্টির সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে উপদেষ্টা কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান, কমরেড রানোর কন্যা রানা সুলতানা ও জামাতা মনিরুজ্জামান রাজুসহ পার্টির নেতৃত্ব। ঘণ্টাব্যাপী কফিনে পুষ্পার্ঘ অর্পণ ও মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে লাল সালাম জানিয়ে কমরেডকে বিদায় জানানো হয়। বিদায় জানানো হয় হাজারো কণ্ঠে আন্তর্জাতিক সংগীতের মধ্য দিয়ে। তারপর বেলা ১১টায় শুরু হয় কমরেড রানোর অন্তিম যাত্রা। মহাকাল যাত্রা। পার্টি কমরেডরা হাতে হাতে কাস্তে হাতুড়ি খচিত রক্তলাল পতাকা সঙ্গে কালো পতাকা নিয়ে সারিবদ্ধভাবে লাইন করে গানে সেøাগানে মুখরিত করে প্রথমে যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে সর্বস্তরের মানুষ তার মরদেহের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এবং ফুলে ফুলে ভরিয়ে দেন তার কফিন। শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার এ বিদায়ের অংশ নেন দেশের ক্রিয়াশীল সকল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

তার আগে শহীদ মিনার চত্বরে তার কফিন জাতীয় পতাকা ঢেকে দিয়ে তাকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। এ সময় বিউগলে বেজে ওঠে করুণ সুর। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে। এখানে নামাজে জানাজার পর তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় বনানী কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরে। এভাবেই কমরেড রনোকে বিদায় জানান তার কমরেড সহযোদ্ধা, শুভানুধ্যায়ী ও আত্মীয় পরিজন।

বিদায় কমরেড বিদায়। লাল সালাম কমরেড। লাল সালাম।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সমসাময়িক

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

sixteen − 2 =