কষ্টদায়ক অ্যালার্জি

ময়ূরাক্ষী সেন

বিভিন্ন বয়সী মানুষদের একটি সাধারণ সমস্যার কথা প্রায়ই বলতে শোনা যায় তা হলো অ্যালার্জি। আবহাওয়া ও বিভিন্ন কারণে এদেশের মানুষ এতো বেশি অ্যালার্জির সমস্যায় ভোগে যা একটি সাধারণ রোগে পরিণত হয়ে গিয়েছে। রোগটি সাধারণ হলেও এটি অনেকের জন্য ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিছু মানুষের অ্যালার্জি এতো মারাত্মক হয় যে সাধারণ জীবনযাপন করা তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। আবার কারো ক্ষেত্রে অ্যালার্জির অল্পবিস্তর লক্ষণ দেখা দেয়। অনেকের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গী থাকে অ্যালার্জি। জেনে নেওয়া যাক অ্যালার্জির কারণ ও এ থেকে মুক্তির উপায়।

অ্যালার্জির কারণ

মানুষের শরীরে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম থাকে, কোনো কারণে এই ইমিউন সিস্টেমে গোলযোগ দেখা দিলে অ্যালার্জির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমাদের শরীর সবসময়ই ক্ষতিকর বস্তুকে প্রতিরোধের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধের চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টাকে রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়া  বলে। কিন্তু কখনো কখনো শরীর সাধারণত ক্ষতিকর নয় এমন অনেক ধরনের বস্তুকেও ক্ষতিকর ভেবে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ক্ষতিকর নয়, এমন সব বস্তুর প্রতি শরীরের এই অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াকে অ্যালার্জি বলা হয়।

অ্যালার্জির লক্ষণ

অ্যালার্জির বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ রয়েছে। তবে সবার যে একই ধরনের লক্ষণ দেখা দিবে এমন নয়। একেক জনের একেক লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকে। অ্যালার্জির কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো সর্দি, হাঁচি-কাশি, চামড়া ফুলে যাওয়া, চুলকানি। অনেকের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট, রক্তচাপ কমে যাওয়া ইত্যাদি হতে পারে। অতিরিক্ত এলার্জির প্রবণতা থাকলে অনেকের ঘন ঘন শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। যাদের হাঁপানি ও এলার্জি সমস্যা দুটোই রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে অবস্থা অনেক সময় মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় অ্যালার্জির কারণে গলায় সারাক্ষণই খুসখুস কাশি এবং নাক দিয়ে পানি পড়ছে। অ্যালার্জির জটিলতা বেড়ে গেলে অনেকে রাতে নিঃশ্বাস নিতে পারে না এবং ঘুম ভেঙে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় অনেকের অ্যালার্জির লক্ষণ কম থাকলেও সময়ের সাথে সাথে অনেক সময় তা বেড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে। অনেকে এলার্জির মাত্রা কম থাকার কারণে এটিকে অবহেলা করে। কিন্তু অবহেলা করলে পরবর্তীতে নানা ধরনের জটিলতা বাড়তে পারে। অ্যালার্জি কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে।

অ্যালার্জিক রাইনাইটিস

অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে সাধারণত শ্বাসযন্ত্রের মিউকাস মেমব্রেন আক্রান্ত হয়। হিস্টামিনের প্রভাবে সেখান থেকে তৈরি হয় প্রচুর মিউকাস। শ্বাসযন্ত্রে লিউকোট্রিন নামের একপ্রকার পদার্থ তৈরি হয়, যা কাশি তৈরিতে শ্বাসযন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করে। অনেক সময় দেখা যায় কেউ বৃষ্টিতে ভিজছে, প্রতিদিন আইসক্রিম খাচ্ছে, ধুলাবালির মধ্যে ঘোরাফেরা করছে; তার শরীরে কোনো প্রভাবই পড়ছে না। কারো ক্ষেত্রে হয় ভিন্ন। মাথায় সামান্য বৃষ্টির পানি পড়লে কিংবা একদিন ঠান্ডা কিছু খেলে, শুরু হয়ে যায় হাঁচি ও কাশি। যেকোনো কিছু প্রভাব সাথে সাথেই দেখা দেয় শরীরে। ঠান্ডা কিছু খাওয়ার সাথে সাথে কিংবা দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করলে বা যেকোনো ছোটখাট কারণে যদি সাথে সাথে ঠান্ডা লেগে যায় সেক্ষেত্রে তাকে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়।

চোখ উঠা

অনেকের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে চোখে। শরীরে কোনো প্রভাব দেখা দিলে চোখ লাল হয়ে ফুলে যায় ও পানি পড়ে। অনেকের প্রচণ্ড চোখ চুলকায়, ব্যথা করে। একে বলা হয় অ্যালার্জিক কনজাংটিভাইটিস। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এমন অ্যালার্জি প্রভাব চোখে পড়ে থাকে।

খাবারে অ্যালার্জি

খাবারের সাথে অ্যালার্জির সম্পর্ক ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ধুলাবালির পর খাবারে অ্যালার্জি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। গরুর মাংস, চিংড়ি, বেগুন, ইলিশ মাছ খাওয়ার সাথে সাথে অনেকের অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দেয়। এছাড়া যেকোনো সামুদ্রিক মাছ, ডিম, দুধ, টমেটো ইত্যাদি যেকোনো খাবারেই অ্যালার্জি থাকতে পারে। খাবারে অ্যালার্জি থাকলে তা খাওয়ার কিছুক্ষণ পর শরীর ফুলে উঠে ও চুলকায়। অনেকের বমি হয় কিংবা বমি বমি ভাব হয়।

ঔষধে অ্যালার্জি

অনেকের নির্দিষ্ট কিছু গ্রুপের ঔষধে অ্যালার্জির সমস্যা হয়, বিশেষ করে এন্টিবায়োটিক। যেসব ঔষধে অ্যালার্জি থাকে তা খাওয়ার সাথে সাথে অনেকের বমি হয়। এছাড়া মুখে ঘা, দম বন্ধ অনুভূতি ইত্যাদি হতে পারে। ঔষধ খাবার পর এসব সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই তা চিকিৎসককে জানাতে হবে এবং সাথে সাথে সেসব ঔষধ বন্ধ করে দিতে হবে। পরবর্তীতে সেইসব গ্রুপের ঔষধ এড়িয়ে চলতে হবে। অনেকের ঔষধ খাওয়ার সাথে সাথে বমি কিংবা অস্বস্তি অনুভব হয় কিন্তু তারা বুঝতে পারে না এটা অ্যালার্জির কারণে হচ্ছে। কোনো ঔষধ খাওয়ার পর বারবার একই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।

অ্যানাফাইলেকটিক রিঅ্যাকশন

অনেক ক্ষেত্রে হঠাৎ করে অ্যালার্জির রিঅ্যাকশন প্রবলভাবে দেখা দিতে পারেন। কোনো খাবার খাওয়ার পর কিংবা কোনো পোকামাকড়ের সংস্পর্শে যাওয়ার পর শরীর ফুলে গিয়ে চুলকানি হয়ে, শ্বাসকষ্ট হতে পারে। একে অ্যানাফাইলেকটিক রিঅ্যাকশন বলে। এই অ্যালার্জির ফলে শরীরের রক্তচাপ কমে গিয়ে রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। সঠিক সময় চিকিৎসা না পেলে অ্যালার্জির কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। বিশেষ করে অ্যানাফাইলেকটিক রিঅ্যাকশনে রোগীর গুরুতর অবস্থা হয়ে যায়। অনেক সময় হাসপাতালে নেওয়ার পর আইসিইউ প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে কারো অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন দেখা দিলে বেশি সাবধান থাকা প্রয়োজন।

অ্যালার্জিক কন্ট্যাক্ট ডারমাটাইটিস

অনেক নারীর গহনা ব্যবহারের ফলে অ্যালার্জিক রিঅ্যাকশন দেখা দেয়। যেকোনো ধরনের গয়নাতে অ্যালার্জি সমস্যা হতে পারে। কিন্তু রুপা ও সোনায় সাধারণত তেমন অ্যালার্জি রিঅ্যাকশন দেখা দেয় না। সাধারণত ইমিটেশন ব্যবহারের ফলেই বেশি অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেয়। কারণ এতে থাকা ধাতব উপকরণ অনেকের অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। ইমিটেশনের গয়না পরার কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় সেখানে লাল হয়ে যায় ও গুটি উঠে। আবার অনেক সময় ফোসকা পড়ে যায়। যাদের গয়নায় অ্যালার্জির রয়েছে তাদের ফোঁড়ানো নাক ও কানে গয়না পরার সময় ইমিটেশন এড়িয়ে চলতে হবে। তা না হলে সেস্থানে ইনফেকশন হতে পারে। কারণ গয়নার ধাতুগুলো কেবল বাইরের ত্বকের সংস্পর্শেই আসে না, ভেতরের ত্বকেও এর প্রভাব পড়ে।

অ্যালার্জির চিকিৎসা

ঠিক কোন কারণে অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা সনাক্ত করতে পারলেই এলার্জির চিকিৎসা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কি কারণে অ্যালার্জি হচ্ছে ও অ্যালার্জির মাত্রা কত তা ধরা পড়ে। তবে অনেক সময় সঠিক কি কারণে অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা ধরা পড়ে না। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন ও ঔষধের মাধ্যমে অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়। অ্যালার্জির সমস্যা সাধারণত কখনোই পুরোপুরি সেরে যায় না। কিন্তু ঔষধের মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। খাবারে অ্যালার্জি থাকলে সে খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। এছাড়া ধুলাবালিতে অ্যালার্জি সমস্যা থাকলে সবসময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত ঠান্ডা খাবার গ্রহণ করা, দীর্ঘ সময় গোসল করা, বৃষ্টিতে ভেজা ইত্যাদি থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতে হবে।

কিছু ঋতুতে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেমন শীতকাল, বর্ষাকাল। এই সময় অ্যালার্জি প্রবণতা বেড়ে যায়। প্রসাধনী ব্যবহারেও সাবধান থাকতে হবে। বিশেষ করে স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট কিংবা মেকআপ; এসবের কারণে অনেকের ত্বকে এলার্জি সমস্যা দেখা দেয়। অ্যালার্জি সমস্যা দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিক চিকিৎসা নিতে হবে ও নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ করে এটি নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। অনেকেই অ্যালার্জি  সমস্যাকে সাধারণ ভেবে অবহেলা করে এবং পরবর্তীতে এটি আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে। তাই প্রাথমিক অবস্থা থেকেই এর সঠিক চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 2 =