নাহিন আশরাফ
বহু কাল থেকেই নারীর জীবনের সাথে গয়নার সম্পর্ক ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত। তাই তো স্বীকার করতেই হয় নারীর সাজগোজের অনেক বড় একটি অনুষঙ্গ গয়না। গয়না ছাড়া নারীর যেকোনো সাজ যেন অসম্পূর্ণ। অনেক নারীর তাই রয়েছে গয়নার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ। গয়নার ব্যবহার ঠিক কবে থেকে শুরু তা বলা বেশ কষ্টসাধ্য। কিন্তু বহু যুগ আগে রাজ পরিবারে ছিল ভারী গয়না ব্যবহারের প্রচলন। তখন যে যত বেশি গয়না পরিধান করতো তাকে ততো অভিজাত পরিবারের নারী বলে গণ্য করা হতো। তখন সবচেয়ে বেশি সোনার গয়নার কদর ছিল।
বাংলাদেশে সব সময় সোনার গয়নার চাহিদা ও জনপ্রিয়তা ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের দিকে সোনার ভরি ছিল ৫২৫ টাকা, নব্বইয়ের দশকের দিকে সেটি হয় চার থেকে ছয় হাজার টাকা। ২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশে সোনার ভরি ছিল আট-নয় হাজার টাকা। আর ২০১৮ সালে সোনার ভরি ৪৫-৫০ হাজার টাকা। সোনার গয়নার দাম নকশার কারণে খুব বেশি পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না। সোনার গয়নায় তাই রয়ে যেত একঘেয়েমি। সবার গৎবাধা একই নকশা পরতে হতো যুগের পর যুগ। তাই নকশার বদল আনতে হাওয়া বদল করে সবাই বেচ্ছে নিচ্ছে অন্যান্য মেটারিয়ালের গয়না। পরবর্তী সময়ে মুসলিম যুগে যখন মোগলরা ভারতে আগমন করে, তখন অলংকারশিল্পের পরিবর্তন ঘটে। পারস্য থেকে শৈল্পিক সুষমামণ্ডিত অলংকারের প্রচলন ঘটে। তখন সোনার অলংকারের সঙ্গে দামি রত্নের ব্যবহার শুরু হয়। মোগল রাজকন্যারা সোনার সঙ্গে মুক্তা, হীরা, পান্না, চুনি, নীলা ইত্যাদি রত্ন ব্যবহার করতে পছন্দ করত। বাদশাহ ও বেগমদের মুকুটে রত্নের ব্যবহার ছিল অত্যাবশ্যকীয়। মোগল যুগের গয়না বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।
আঠারো শতকের পরবর্তী সময়টিকে গয়নার আধুনিক যুগ। এ সময় এই উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমন ঘটে। তার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রসার লাভ করে। পাশ্চাত্য ঘরানার অলংকারশিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দামি পাথর ও অল্প সোনার ব্যবহার। প্রধানত সেই সময় থেকে সোনার সঙ্গে রুপা, প্লাটিনাম, স্টিল বেশি ব্যবহৃত হতে থাকে এবং নকশার দিকেও বেশি নজর দেওয়া শুরু হয়।
আগে গ্রামে নিম্নবিত্ত মানুষেরা তামা, পিতল, রুপা, মাটি, কাচের গয়না ব্যবহার করতো। কিন্ত এখন ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এসব মেটারিয়ালের গয়নাই। এইসব গয়না দামে সাশ্রয়ী আবার তেমন রুচির পরিচয় দেয়, তাই নতুন প্রজন্মের কাছে এসব গয়না গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
ইদানীং তরুণীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে কাঠের গয়না। কাঠের বেজের উপর রং তুলি দিয়ে বিভিন্ন নকশা এঁকে এই গয়না তৈরি করা হয়। সব ধরনের পোশাকের সাথেই এই কাঠের গয়না মানিয়ে যায়। শাড়ি, কুর্তি, সালোয়ার কামিজ এমনকি ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাথেও অনেকে কাঠের গয়না পরছে। কাঠের গয়না হালকা গড়নের হওয়ার ফলে বহন করা বেশ সহজ। কাঠের গয়নার মূল আকর্ষণ হচ্ছে এর উপরের চিত্রাংকন। সবাই নিজের রুচি ও ব্যক্তিত্বের সাথে মিল রেখে নিজের পছন্দ অনুযায়ী মালা বেছে নিচ্ছে।
শাড়ি, কুর্তি, সালোয়ার, কামিজ এমনকি ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাথেও অনেকে কাঠের গয়না পরছে। কাঠের গয়না হালকা গড়নের হওয়ার ফলে বহন করা বেশ সহজ। কাঠের গয়নার মূল আকর্ষণ হচ্ছে এর উপরের চিত্রাংকন। কাঠের উপর দেবী, কখনো হিমু-রুপা, কখনো কাঠ গোলাপের ছবি এঁকে এই মালাকে আরো বেশি নান্দনিক করা হয়। সবাই নিজের রুচি ও ব্যক্তিত্বের সাথে মিল রেখে নিজের পছন্দ অনুযায়ী মালা বেছে নিচ্ছে।
কাঠের গয়না কিন্তু শুধু মালাতেই সীমাবদ্ধ তা নয়। কাঠের চুড়ি, আংটি, কানের দুল সবকিছুই বানানো হয়। কাঠ দিয়ে বানানো চুড়ির উপর রং তুলি দিয়ে হালকা রং হয়। নানান আকারের আংটি দেখা যায়। আংটিতে পেঁচা, চায়ের কাপ, ফুলের পাপড়ি ইত্যাদি শোভা পায়। মালা, কানের দুল, আংটি, চুড়ি সব মিলিয়ে সেট হিসেবে বিক্রি করতেও দেখা যায়। সব ধরনের অনুষ্ঠানেই এই মালা মানানসই হলেও এর ব্যবহার বেশি দেখা যায় বাঙালিয়ানা বা ঐতিহ্যবাহী কোনো অনুষ্ঠানে। জামদানি, সুতির শাড়ি, জর্জেট সহ যেকোনো শাড়ির সাথে কাঠের গয়না পরে নিজের নান্দনিকতার পরিচয় দেওয়া যায় অনায়াসে। কাঠের মালা প্রতিদিন ব্যবহারযোগ্য একটি অলংকার। অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় সহ যেকোনো স্থানেই যাওয়ার সময় নিজেকে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদাভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য কাঠের গয়না পরে ফেলা যায়।
দোয়েল চত্বরে সারি বাধা কাঠের গয়নার দোকানে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিয়ার সাথে। তার হাতে দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটি কাঠের মালার প্যাকেট এবং পরেছেন কাঠের গয়না। রিয়া বলেন, তিনি বিশেষ আয়োজন ছাড়াও নিত্যদিনেও কাঠের গয়না পরিধান করে থাকেন। এটা হালকা গরনের হবার জন্য বহন করা বেশ সোজা এবং দেখতেও বেশ সুন্দর লাগে। দাম অন্যান্য গয়না থেকে তুলনামূলক কম হবার কারণে সে প্রায় প্রতি মাসেই টুকটাক নতুন কাঠের গয়না সংরক্ষণে রাখেন। এছাড়া বন্ধুদেরও তিনি কাঠের মালা উপহার দেন।
অন্যদিকে কথা হয় বিপাশা সেনের সাথে তিনি নিজের হাতে কাঠের মালা তৈরি করে থাকেন। তিনি কাঠ, পিন, রং তুলি, সুতা ইত্যাদি পাইকারি দামে নিউ মার্কেট থেকে কিনে নিয়ে আসেন এবং নিজের জন্য গয়না বানান। তার এতো সুন্দর গয়না বানানো দেখে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা উৎসাহ দিচ্ছেন সবার জন্য গয়না বানানোর জন্য। তাই তিনি ভাবছেন সবার চাহিদার কথা চিন্তা করে তিনি নিজের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও গয়না বানাবেন। এতে তার নিজের কিছুটা হাত খরচ আসবে।
কাঠের গয়নার বিভিন্ন দোকান ঘুরে বেশ ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বেশিভাগ ক্রেতারাই শিক্ষার্থী। কারণ তাদের সবার বাজেট কম থাকে। এই বাজেটের মধ্যে কাঠের গয়না বেশ ভালোভাবেই পাওয়া যায়। এতে কম দামেও কেনা যাচ্ছে আবার ফ্যাশনও হচ্ছে।
কাঠের মালা যারা তৈরি করে তাদের মধ্যে যথেষ্ট সৃজনশীলতা থাকতে হয়। কারণ কাঠের উপরে সুন্দর ও ভিন্নধর্মী চিত্র ফুটিয়ে তুলতে না পারলে ক্রেতার কাছে তা গ্রহণযোগ্যতা হারায়। অনেকেই তাদের সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করে কাঠের গয়না তৈরি করছে। অনেক নারীরা কাঠের গয়না নিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছে এবং স্বাবলম্বী হচ্ছে। অনলাইনে বেশ কিছু পেইজ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
কাঠের গয়নার সবচেয়ে বেশি বিচরণ দেখা যায় অনলাইনে। অনেক ধরনের পেইজে হরেক রকমের ডিজাইনে এই মালা বিক্রি হচ্ছে, চাইলে ক্রেতারা নিজের পছন্দমতো ডিজাইনে কাস্টমাইজড করেও নিতে পারছে। দেশি কিছু ফ্যাশন হাউজ যেমন দেশাল, অঞ্জনস, বিশ্বরঙ ইত্যাদি ইদানীং কাঠের গয়নার কালেকশন রাখছে। এছাড়া দোয়েল চত্বরে সারিবদ্ধ দোকানে কাঠের গয়নার দেখা মিলে। গাউছিয়া ও নিউ মার্কেটের কিছু দোকানে কাঠের গয়না পাওয়া যায়। অনেকে শুধু কাঠের বেজ কিনে নিজের ইচ্ছে মতো রং করেও গয়না বানিয়ে নিচ্ছে। অন্যান্য গয়না থেকে কাঠের গয়নার দাম তুলনামূলক কিছুটা সাশ্রয়ী। কাঠের গয়নার দাম নির্ভর করে ডিজাইন, অংকন ও ব্র্যান্ডের উপর। ৫০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকার মধ্যেই কাঠের গয়না পাওয়া যাচ্ছে সব জায়গায়।
কাঠের গয়নায় যেহেতু পুরো কাজটাই করা হয় রং দিয়ে তাই রং উঠে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। তাই বেশি দিন এই গয়নার রং ধরে রাখতে একটু যত্নে রাখতে হবে। এই গয়না যতটা সম্ভব শুকনো স্থানে রাখতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে যাতে পানিতে না ভিজে যায়। কাঠের গয়না সাধারণত প্লাস্টিকের প্যাকেটে বিক্রি করা হয়ে থাকে কারণ প্লাস্টিকের প্যাকেটে কাঠ ভালো থাকে অনেকদিন। তাই প্লাস্টিকের প্যাকেটেই কাঠের গয়না সংরক্ষণ করে রাখা ভালো বেশিদিন ব্যবহার করার জন্য।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন