কাপড় ধোয়া সহজ করে ওয়াশিং মেশিন

কর্মব্যস্ত জীবনে কাপড় ধোয়ার জন্য সময় বের করা বেশ কঠিন। আজকাল অধিকাংশ পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই থাকেন কর্মজীবী। সারা দিন কাজের পর কিংবা ছুটির দিনগুলোয় জরুরি অন্য কাজগুলো করেই দিনের অনেকটা সময় কেটে যায়। তাই অনেকেই জামাকাপড় ধোয়ার ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার জন্য ওয়াশিং মেশিন বা লন্ড্রি মেশিন ব্যবহার করেন। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না আমাদের দৈনন্দিন জীবন সহজ করে দেওয়া যন্ত্রটি কিভাবে আমাদের কাছে এলো। ওয়াশিং মেশিন আবিষ্কারের সম্পর্কে জানাচ্ছেন গোলাম রসুল

আগুন জ্বালানোর আগেই মানুষ পশুর চামড়া কেটে পোশাকের ব্যবহার শুরু করেছিল। যা পরবর্তীতে বিভিন্ন সভ্যতায় আরও ছড়িয়ে যায়। সেসময় পোশাকগুলো মানুষের হাত দিয়ে পরিষ্কার করতো যা ছিল অনেক শ্রমসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। যার কারণে একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। এছাড়াও প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যাও ওয়াশিং মেশিন তৈরির একটি কারণ।

ওয়াশিং মেশিনের প্রথম ধারণা পাওয়া যায় প্রায় ১০০ বছর আগে। তখনকার সময়ের ওয়াশিং মেশিন হাতে চালিত ছিল। যা দেখতে একটি বড় কাঠের টবের মতো ছিল। পোশাক ধোয়ার জন্য তাতে যার মধ্যে পানি, সাবান এবং জামাকাপড় দেওয়া হতো। এরপর জামাকাপড় হাত দিয়ে তা পরিষ্কার করতে হতো। যা বেশ সময়সাপেক্ষ এবং শ্রম-নিবিড় ছিল। তবে এই পদ্ধতিটি ওয়াশিং মেশিন নির্মাণের সূচনা করে। পদ্ধতিটি ১৮৪৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পেটেন্ট করে নেয়। তবে ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ১৯৫০ সালে কয়েক জন আবিষ্কারক ওয়াশিং মেশিন আবিস্কারের চেষ্টা করেন। তবে তারা তাদের সফল হতে পারেননি।

১৮৫১ সালে যান্ত্রিক ওয়াশিং মেশিন তৈরিতে প্রথম সফলতা পান বিজ্ঞানী জেমস কিং। তিনি একটি ড্রামের মধ্যে পানির চাপ ব্যবহার করেন কাপড় পরিষ্কারের জন্য। জেমসের যন্ত্রটি সংস্কার করে ১৮৫৮ সালে হ্যামিল্টন স্মিথ যন্ত্রটির ঘূর্ণমান সংস্করণ নির্মাণ করেন। তবে জেমস এবং স্মিথের যন্ত্রটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট ছিল না। যার ফলে ১৮৬৮ সালে টমাস ব্র্যাডফোর্ড যন্ত্রটি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাণিজ্যিকভাবে একটি মডেল তৈরি করেন যা ব্যাপক সফলতা পায়।

তবে প্রযুক্তির উন্নতিতে ওয়াশিং মেশিনের উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। ফলে ১৯০৮ সালে আমেরিকান আবিষ্কারক আলভা জে. ফিশার থর একটি মডেল তৈরি করেন। যা ছিল পৃথিবীর প্রথম বিদ্যুৎচালিত ওয়াশিং মেশিন। শিকাগোর হার্লি মেশিন কোম্পানি প্রাথমিকভাবে বাণিজ্যিক গ্রাহকদের জন্য মেশিনটি তৈরি করে। যা ক্রমাগত উন্নত হয়ে আজকের ওয়াশিং মেশিনে রুপান্তর হয়েছে।

ওয়াশিং মেশিনে সবচেয়ে জটিল বিষয় ছিল চক্র আকারে ঘোরা বস্তু নির্মাণ। প্রথম দিকের ওয়াশিং মেশিন কাঠের গোল বাক্সে দিয়ে তৈরির কারণে বেশ জটিলতা পোহাতে হয়নি। তবে ইলেক্ট্রোমেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কারণে ভেতরের চক্রটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্মাণের বেশ জটিলতা দেখা দেয়। তাই ওয়াশিং মেশিনের ভেতরে বিভিন্ন ঘর তৈরি করা হয় এবং সবগুলো ঘর একটি সিস্টেমের অধীনে কাজ করাতে হয়। ওয়াশিং মেশিনটিতে পানি গরম করার জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ফ্রন্ট লোডারদের লো-সুডিং ডিটারজেন্ট ব্যবহার করতে হয়। কারণ ওয়াশিং মেশিন ঘোরার সময় জামাকাপড়ের লোডের মধ্যে বাতাস প্রবেশ করে, যা অত্যাধিক ফেনাযুক্ত স্যাড তৈরি করে যার কারণে ওভারফ্লো হয়ে ওয়াশিং মেশিন নষ্ট হতে পারে। তাই ওয়াশিং মেশিনের ধারণাক্ষমতার কম কাপড় এবং পরিমাণমতো ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা উচিত।

বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ওয়াশিং মেশিন পাওয়া যায়। সে সম্পর্কে জানা যাক।

ফ্রন্ট লোডিং মেশিন

এই ধরনের মেশিনগুলো সবচেয়ে সাধারণ এবং ব্যাপক জনপ্রিয়। যার কারণে অধিকাংশ বাড়িতে এই ধরনের ওয়াশিং মেশিন পাওয়া যায়। এই ধরনের ওয়াশারের সামনে একটি দরজা রয়েছে যা লন্ড্রি লোড এবং আনলোড করার জন্য খোলা যায়। ফ্রন্ট লোড ওয়াশারগুলো ড্রামের উপর লন্ড্রি করে যা কাপড়গুলোর মধ্যে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে এবং কাপড়গুলো দ্রুত পরিষ্কার হয়। টপ লোড ওয়াশিং মেশিনের তুলনায়, এই ধরনের ওয়াশিং মেশিনে প্রতিটি ধোয়ার চক্র জুড়ে কম পানি ব্যবহার হয়।

টপ লোডিং ওয়াশিং মেশিন

এই ধরনের ওয়াশিং মেশিনগুলো উপরের দিকে খোলা যায়। বেশি কাপড় পরিষ্কার করার জন্য এই ধরনের ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করা হয়। এধরনের ওয়াশিং মেশিনে পানি ও বিদ্যুৎ খরচ বেশি হয়। এছাড়াও একাধিক গিয়ার বক্স এবং রিভার্স মোটর থাকায় সহজেই এটির গতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

হাইব্রিড ওয়াশিং মেশিন

এই ধরনের ওয়াশিং মেশিনের কাজ ওপরের ওয়াশিং মেশিনগুলোর থেকে ভিন্ন। এই ধরনের ওয়াশিং মেশিনে কাপড় পরিষ্কারের পাশাপাশি শুকানো যায়। শীতপ্রধান অঞ্চলগুলোর কথা মাথায় রেখে এ ধরনের ওয়াশিং মেশিন তৈরি করা হয়। অন্য সব ওয়াশিং মেশিনের চেয়ে এটির বিদ্যুৎ এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেশি।

বর্তমানে বিশ্বে ওয়াশিং মেশিনের বাজার প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলার। ধারনা করা যাচ্ছে যে ২০৩২ সালে এর পরিমাণ ১২৭ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকবে। বাংলাদেশে ওয়াশিং মেশিনের বাজার প্রায় ০.৭৪ বিলিয়ন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশ ২০২৯ সাল নাগাদ বছরে ১৭ লক্ষ ওয়াশিং মেশিন তৈরি করবে।

জানলে অবাক হবেন, প্রতি বছর ৩ নভেম্বর বিশ্ব ওয়াশিং মেশিন দিবস পালিত হয়। এছাড়াও ১৯০৪ সালে প্রথম ওয়াশিং মেশিনের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। তাছাড়াও বর্তমানে এআই প্রযুক্তিসম্পন্ন ওয়াশিং মেশিন বাজারে এসেছে।

ওয়াশিং মেশিনের ইতিহাস সম্পর্কে তো অনেক জানলাম, তবে কিভাবে এটিকে ভালো রাখা যায় সে সম্পর্কেও কিছু জানা দরকার। যেকোনো পণ্যই বেশি দিন ব্যবহার করতে চাইলে ভালোভাবে যত্ন নিতে হয়। ওয়াশিং মেশিনও ভালো রাখতে হলে নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। ডিটারজেন্ট জমে অনেক সময় মেশিনের ভেতরে অনেক অংশ ব্লক হয়ে যায়। তাই ধোয়ার কাজ সম্পন্ন হলে ভালোভাবে মেশিনের ভেতরটা ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখতে হবে। এছাড়াও ওয়াশিং মেশিন ব্যবহারে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন ধারণক্ষমতার চেয়ে কিছুটা কম কাপড় দিতে হবে। কাপড়ে সেফটিপিন বা আর্টিফিশিয়াল বোতাম থাকলে মেশিনে দেওয়ার আগে তা খুলে নিতে হবে। ওয়াশিং মেশিন ব্যবহার করার পর বিদ্যুতের সংযোগ বন্ধ রাখতে হবে।

ওয়াশিং মেশিন আবিষ্কারে সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয় গৃহিণীদের। কেননা প্রাচীনকাল থেকে জামাকাপড় ধোয়া নারীদের কাজ হিসেবে গণ্য করা হতো, যা ছিল বেশ শ্রমসাধ্য। তাই ওয়াশিং মেশিনকে সমাজে নারীদের উন্নতির শক্তি হিসেবে ধরা হয়। সুইডিশ পরিসংখ্যানবিদ হ্যান্স রোজলিং বলেন, ওয়াশিং মেশিন নারীদের মুক্তির উপর যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তা এটিকে শিল্প বিপ্লবের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার করে তোলে।

কোনো নতুন প্রযুক্তি যেমন আমাদের অনেক সুবিধা দেয় তেমনি সৃষ্টি করে যায় নানান অসুবিধা। ওয়াশিং মেশিন তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতি বছর যেমন বিপুল পরিমাণের ওয়াশিং মেশিন তৈরি করা হয়, তেমনি বিপুল পরিমাণের ওয়াশিং মেশিন মেরামত না করতে পারার কারণে বিভিন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। এছাড়াও ব্যবহারকারীরা নষ্ট ওয়াশিং মেশিন পুনরায় ব্যবহার করার চেয়ে নতুন কেনাটা সুবিধাজনক মনে করেন। যার কারণে এর ভেতরে থাকা রাসায়নিক পদার্থ মাটি ও পানিতে থাকা জীবদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে। এছাড়াও এসব ওয়াশিং মেশিন বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করে। যার কারণে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জন্য প্রাকৃতিক সম্পদ ক্ষয় করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে। ব্যক্তিগত ওয়াশিং মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এসব ব্যবসায় সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিদের অর্থনৈতিক  মন্দা দেখা দিচ্ছে।

লেখটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 − 7 =