কালের সাক্ষী তেওতা জমিদার বাড়ি

হাসান নীল

প্রাচীন এক ঐতিহাসিক স্থাপনা মানিকগঞ্জের তেওতা জমিদার বাড়ি। এটি দুটি কারণে দেশের অন্যান্য প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। এক. এটি তিনশ বছরে পুরোনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। দুই. মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রামের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই জমিদারি বসতভিটা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত। কবি ও কবিপত্নী প্রমীলা দেবীর প্রেমের সাক্ষী।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাঁধনহারা জীবন যাপন সম্পর্কে কমবেশি সবার জানা। নারীর ভালোবাসা ছাড়া কোনো শৃংখলই বাঁধতে পারেনি তাকে। এরজন্য কবিকে প্রতারিত হতে হয়েছে বহুবার। তার বড় উদাহরণ কুমিল্লার নার্গিসের সঙ্গে প্রেম-বিয়ের ঘটনা। তবে কবি নিখাদ প্রেমের সন্ধান পেয়েছিলেন প্রমীলা দেবীর কাছে। তার ভালোবাসার টানেই বারবার তিনি ছুটে গেছেন মানিকগঞ্জের তেওতায়। এই জমিদারের পোড়া ভিটায় বসেই প্রমিলাকে নিয়ে নজরুল রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত গান, ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ?’ নজরুল-প্রমীলার প্রেম উপাখ্যানের সঙ্গে জমিদার বাড়ি সম্পর্ক নিয়ে কথা পরে হোক।

আগে চলুন জেনে নেওয়া যাক কার হাতে গড়ে উঠেছিল এই জমিদার বাড়ি। ১৭ শতকে পঞ্চানন সেন নামের এক ধনকুবেরের হাতে গড়ে উঠেছিল এই জমিদার বাড়িটি। পঞ্চানন সেন তেওতারই সন্তান। ১৭৪০ সালে দেশগুপ্ত পরিবারে তার জন্ম। তবে শৈশব, কৈশোর বা প্রথম যৌবন সুখকর ছিল না তার। খুবই দরিদ্র ছিল পঞ্চাননের পরিবার। তাই পঞ্চানন অল্প বয়সেই নেমে পড়েছিলেন কর্মজীবনে। দিনাজপুর গিয়ে তামাক ব্যবসা শুরু করেছিলেন তিনি। ভাগ্যদেবতা সহায় ছিল তার। ফলে প্রথম চালানেই তামাক থেকে প্রচুর মুনাফা আসে তার পকেটে। ফলে রাতারাতি অর্থের মালিক বনে যান পঞ্চানন। লোকে বলে কষ্টার্জিত অর্থের মূল্য আয়কারীই বোঝে। পঞ্চাননও বুঝেছিলেন অর্থের মূল্য। আঙুল ফুলে কলাগাছ হলেও করেননি অপচয়। অর্থের ব্যবহার করেছেন যথাযথ। পাশাপাশি সময়ও পক্ষে ছিল তার। তিনি অর্থশালী হওয়ার পরই চালু হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। এ সুযোগই কাজে লাগান পঞ্চানন। আয়কৃত টাকা লগ্নি করতে থাকেন জমি ক্রয়ে। প্রথমদিকে দিনাজপুরে বেশকিছু জমি ক্রয় করলেও পরে নিজের জন্মস্থান তেওতায় এসে জমি কিনতে থাকেন তিনি। এরপর তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন ওই অঞ্চলের জমিদার হিসেবে। গড়ে তোলেন তেওতা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনার তীর ঘেঁষে এই সুরম্য জমিদার বাড়ি।

তৎকালীন ভারতবর্ষের মধ্যে বিত্ত ও প্রভারশালী জমিদারির একটি ছিল এই তেওতা জমিদার বাড়ি। এ জমিদারির আওতাভুক্ত ছিল ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা এবং দিনাজপুরসহ রংপুর ও বর্ধমানের কিছু অংশ নিয়ে বিস্তৃত অঞ্চল। পঞ্চানন থেকে শুরু করে তার কয়েক পুরুষ জমিদারি চালিয়েছেন তেওতায়। ১৯১৪ সালে এই জমিদারির সম্পদের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ অর্থমূল্য পরিমাণের। জমিদার হিসেবে পঞ্চানন বা তার উত্তরসূরীরা ছিলেন বেশ প্রজাবৎসল ও উদার। পঞ্চাননের পর জমিদার হিসেবে অন্যতম ছিলেন জয় শংকর ও হেম শংকর। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তেওতা শাসন করেছেন তারা। পরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেলে ভারত চলে যান তারা। সেইসঙ্গে সমাপ্তি ঘটে তেওতা জমিদারদের জমিদারি। এরপর একে একে দেশত্যাগ করেন অন্যান্য উত্তরসূরীরা। ফলে একসময় যে বাড়ি মুখরিত থাকত পাইক বরকন্দাজ সভাসদদের পদচারণায়, নিভে যায় তার আলো। পরিণত হয় পরিত্যক্ত ভিটায়। তারপর থেকে তেওতার ওই জমিদার বাড়িটি পরিত্যক্ত হিসেবেই রয়ে গেছে।

যমুনার তীরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এ জমিদার বাড়িটি মূলত দুটি ভবন নিয়ে। তুলনামূলকভাবে প্রাচীন ভবনটি জমিদারবাড়ির মূল ভবন। এটিই নির্মাণ করেছিলেন জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা পঞ্চানন সেন। এটি মোট ৩.৭৮ একর জায়গা নিয়ে গঠিত। মূল ভবনটি পরিচিত লালদিঘী ভবন নামে। এর ভিতরে রয়েছে মোট ৫৫টি কক্ষ। এই ভবনের চারপাশে আরও একাধিক স্থাপনা ও একটি দীঘি রয়েছে। এছাড়া তেওতা জমিদার বাড়িতে রয়েছে একাধিক নাটমন্দির। পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু মঠ ও নবরত্ন মন্দির।

রাজবাড়ির এই দৃষ্টিনন্দন নবরত্নটি বানানো হয়েছিল মূলত পারিবারিক দেবতাদের উদ্দেশ্যে। এই নবরত্নটি ৭৫ ফিট উঁচু এবং চার তলা বিশিষ্ট। নবরত্ন মঠের ১ম ও ২য় তলার চতুর্দিকে আরও চারটি মঠ রয়েছে। নবরত্নটি ব্যবহার করা হতো দোল উৎসবের সময়।

আর লালদিঘী ভবনটি ব্যবহার করা হতো অন্দরমহল হিসেবে। জমিদারবাড়ির দীঘিতে রয়েছে শান বাঁধানো দুটি ঘাট। পঞ্চাননের পর এই জমিদার বাড়িটি দুটি অংশে বিভক্ত হয়। এর একটি হলো জয় শংকর এস্টেট। অন্যটি হলো হেম শংকর এস্টেট। প্রতিটি এস্টেটের সামনে স্থাপন করা হয় একটি করে নাটমন্দির। এছাড়া উনিশ শতকে তেওতা জমিদার বাড়ি সংলগ্ন অঞ্চলে কিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও তৈরি হয়। এর একটি হলো তেওতা একাডেমি। আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়টি তৎকালীন মানিকগঞ্জ সাব ডিবিশনের একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল। এছাড়া জমিদারের এস্টেট কর্তৃক পরিচালিত হতো একটি দাতব্য চিকিৎসালয় ও একটি বিশ্রামাগার।

নজরুল-প্রমীলার প্রেম উপাখ্যান

আশালতা সেনগুপ্ত প্রমীলা ওরফে দুলির বাড়ি ছিল জমিদার বাড়ির পাশেই। তার সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ের মাধ্যম ছিলেন বীরেন সেন। তিনি প্রমীলার বাবা বসন্ত সেনের ভাতিজা। তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রেই নজরুল পদধূলি দিয়েছিলেন তেওতায়। তবে প্রথমে বন্ধুত্বের টানে এলেও পরে প্রেমের টানে একাধিকবার তেওতায় আসেন কবি। প্রমীলার পাশাপাশি তেওতাও যে তার মন কেড়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া গেছে কবির সৃষ্টিতে। একাধিক কবিতা গানে উঠে এসেছে অঞ্চলটির নাম। নজরুল তার ছোট হিটলার কবিতায় লিখেছেন, ‘ভয় করি না পোলিশদের জার্মানির ঐ ভাওতাকে/ কাঁপিয়ে দিতে পারি আমার মামার বাড়ি তেওতাকে…।’

এছাড়া আরও বেশকিছু ছড়া কবিতা, গান, কীর্তন তেওতায় বসে লিখেছেন তিনি। এরমধ্যে হারাছেলের চিঠি, ইছামতি ও তার বিখ্যাত ছড়া লিচুচোর উল্লেখযোগ্য। একারণে তেওতাবাসী আজও কবিকে বিশেষভাবে মনে রেখেছেন তার প্রমাণ নজরুলের বিশালাকারের মনুমেন্ট। পাশাপাশি সেখানে নজরুল-প্রমীলা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী নামে সংগঠনও রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংগঠনটি জমিদার বাড়ির মাঠসংলগ্ন নজরুল-প্রমীলা স্মৃতি মঞ্চে তাদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালিয়ে থাকে।

এখন কেমন আছে তেওতা জমিদার বাড়ি

আজ নেই পঞ্চানন বা নজরুল-প্রমীলা। কিন্তু একইসঙ্গে তাদের স্মৃতি বুকে ধরে জেগে আছে জমিদার বাড়িটি। তবে ভালো নেই একেবারেই। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেকদিন ধরেই ধুকে ধুকে টিকে আছে। জমিদার বাড়িটি আজকাল প্রায় অরক্ষিত। পরিস্থিতি ভালো করে আঁচ করা যায় ভবনের ভেতরে ঢুকলে। শত শত বছরের পুরোনো পলেস্তরা খসে পড়েছে অনেক আগেই। আজকাল খসে পড়ছে ইট। সবচেয়ে ভয়াবহ এর ছাদ। ভেঙেচুরে ইট সুরকি বেরিয়ে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। ফলে বিভিন্ন স্থান হতে আসা পর্যটকরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে গিয়ে আপন ইচ্ছায়ই নেমে আসেন ছাদের যাওয়ার বাসনা ত্যাগ করে। এছাড়া ভবনের মেঝেতে, কোনায় কোনায় উইয়ের ঢিবি ও পোকামাকড়ের বসতি তো রয়েছেই। বাড়িটির মালিক এখন বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। বিভিন্ন সময় এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির দুরবস্থার কথা উঠে এসেছে দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমগুলোতে। কিন্তু তারপরও এটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বড়জোর মাঝে মাঝে নবরত্নটি রং করা হয়েছে। এর বাইরে কিছু নয়।

স্থানীয়রা আজও চান টিকে থাকুক জাতীয় কবির স্মৃতি বিজড়িত এই স্থাপনাটি। বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে সংস্কারের দাবিও জানিয়ে আসছেন বিভিন্ন সময়। তারা মনে করেন স্থাপনাটি তার যথাযথ মর্যাদা পাক। পাশাপাশি বেদখলের হাত থেকে রক্ষা পাক প্রমীলার বাড়িটি। সেখানে স্থাপন করা হোক নজরুল-প্রমীলা স্মৃতি যাদুঘর, পাঠাগার প্রভৃতি।

দেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হওয়ায় প্রতিদিন এখানে ভিড় লেগে থাকে পর্যটকের। তাছাড়া আজকাল ঐতিহাসিক স্থাপনা নিয়ে কনটেন্ট বানানো তো উল্লেখযোগ্য পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে স্থাপনাটির সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি অনেক ভøগারই এখানে জড়ো হন। এ কথা শুনলে নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছা হচ্ছে কীভাবে যাবেন শিবালয় নামের ওই উপজেলায় যমুনার কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা নিদর্শনটি দেখতে। ঢাকা থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাই দিনে গিয়ে দিনেই ঘুরে আসা যাবে। গাবতলী থেকে আরিচা ঘাটের উদ্দেশে বাসে চেপে বসলে মাত্র সাড়ে তিনঘণ্টায় পৌঁছে যাবেন আপনি। এজন্য আপনাকে ভাড়া হিসেবে গুণতে হবে ১০০-১৫০ টাকা। এরপর আরিচা ঘাট থেকে রিকশাওয়ালাকে ৩০-৪০ টাকা ধরিয়ে দিলে অনায়াসেই আপনি পৌঁছে যাবেন তেওতা জমিদার বাড়ি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: কোথায় কি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 + 13 =