গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
ইন্ডাস্ট্রিতে ক্যামেরার আড়ালে কাজ করা মানুষদের নিয়ে তেমন একটা কথা হয় না। তেমনই একজন কামরুন নাহার কলি। যিনি বিগত সাত বছর যাবত কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন শোবিজ অঙ্গনে। শতাধিক বিজ্ঞাপনে যুক্ত ছিলেন কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে। মিডিয়াতে আসেন রান আউট ফিল্মস প্রোডাকশন হাউজে কাজ করার মাধ্যমে। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন। সর্বশেষ কাজ করেছেন ‘মিশন হান্ট ডাউন’ ওয়েব সিরিজে। মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘পুনর্মিলন’।
মফস্বল থেকে ইট পাথরের শহরে
বাবা চিটাগাং কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র কাজ করতেন সেই সুবাদে কামরুন নাহার কলির শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামে। তার বড় হয়ে ওঠা গ্রামের বাড়িতেই। পাঁচ ভাইবোনের তিনি সবার ছোট। তিনি পরিবারের সবচেয়ে আদুরে মেয়ে ছিলেন। সবার সাথে একসাথে ঘুরতে যাওয়া ছিল প্রতি মাসের ঘটনা। এখনও কাজের ফাঁকে প্রায়ই ঘুরতে চলে যান দেশের নানা প্রান্তে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ঢাকায় আসেন। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন ক্যামব্রিয়ান স্কুল এন্ড কলেজ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি সম্পন্ন করেন আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) থেকে বিবিএ বিভাগে। ছোটবেলা থেকেই ফটোগ্রাফির প্রতি ঝোঁক ছিল। ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফি করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ৫টি জব করেছেন তিনি। কখনো সেলস আবার কখনো টেলিমার্কেটিং টিমে। কোথাও নিজের মন স্থির করতে পারেননি তিনি। কর্পোরেট অফিসের নয়টা টু ছয়টা চক্রে নিজেকে মেশাতে পারছিলেন না তিনি। কোথাও পাঁচ দিন গিয়েছে আবার কোথাও সর্বোচ্চ এক সপ্তাহ।
শুরুটা আদনান আল রাজীবের রানআউটে
কামরুন নাহার কলি নতুন মানুষদের সঙ্গে খুব সহজেই মিশে যেতেন। তিনি জানালেন, একদিন ভার্সিটিতে আড্ডা দিচ্ছিলাম বন্ধু ও বড় ভাইদের সাথে। সেসময় এক বড় ভাই আসলেন। তিনি আমাদের সাথে সবসময়ই আড্ডা দিতেন। তিনি এসে আমাকে বলেন আমি কাল ফ্রি কি না! হ্যাঁ বললে বড় ভাই বললেন, তার গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে একটা অডিশনে উত্তরা যেতে। উত্তরা গিয়ে দেখলাম, অনেক মানুষ এসেছে অডিশন দিতে। আমি তখনও জানি না কীভাবে একটা প্রোডাকশন হয়। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। এক পর্যায়ে সেটে নীরব নামে একজন ভাইয়ের সাথে কথা হয়। তিনি ফেসবুকে কানেক্টেড হন। তারপর নিয়মিত কথা হয় টুকটাক কাজকর্ম নিয়ে। একদিন তিনি জানান, রানআউটে ফিমেল এডি নিচ্ছে। তোমার যেহেতু আগ্রহ আছে ফটোগ্রাফিতে ইন্টারভিউটা দিয়ে দেখো। আমি তখন কিছুই জানিনা।
না জানা থেকেই কলির ইন্টারভিউ দিতে আসা। ২০১৬ সালের অক্টোবরে সিভি সহ হাজির হোন নিকেতনে রানআউট অফিসে। ইন্টারভিউতে প্রবেশ পর দেখেন বসে আছে আদনান আল রাজীব। তিনি নানান প্রশ্ন করতে থাকেন। একপর্যায়ে একটা টাস্ক দিয়ে বসেন। সময় বেঁধে দেন মাত্র ত্রিশ মিনিট। টাস্কটা ছিল, পুরো নিকেতন এলাকা ঘুরে ২২ বছর বয়সের একজন ড্রাইভার ও ৩০ বছর বয়সের একজন কর্পোরেট ব্যক্তির কন্টাক্ট নাম্বার আর ছবি কালেক্ট করতে হবে। কেউ জিগ্যেস করলে বলা যাবে, প্রাণ কোম্পানির এক বিজ্ঞাপনের জন্য প্রয়োজন। ৩০ মিনিট ঘুরে ৪ জন মানুষকে কনভিন্স করে ছবি ও নাম্বার অফিসে দিয়ে বাসায় চলে আসেন কলির। তারপর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। একদিন আচমকা ফোন আসে কাল থেকে জয়েন করতে পারবেন কি না! তিনি এক বাক্যে বলে ফেলেন, পারবো।
২০১৬ সালে ৮ নভেম্বর প্রথম অফিসে যুক্ত হোন কলি। প্রথমদিন নির্মাতা আদনান আল রাজীব বলেন, ফিল্ম বানানোর জন্য প্রথমে সবকিছু শিখতে হয়। আর প্রথম ধাপ হচ্ছে কাস্টিং ডিরেক্টর। যখন তুমি জানবে, কোন গল্পের জন্য কেমন কাস্টিং প্রয়োজন তখন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাবে। একটা গল্প ফুটে ওঠে সুন্দর চরিত্রের মাধ্যমে। তুমি কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দাও। ৩ মাস ইন্টার্নশিপ করো। তারপর আমরা দেখবো, তুমি আমাদের সাথে কতটুকু কাজ করতে পারবে। এভাবেই শুরু কামরুন নাহার কলির কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে শোবিজ অঙ্গনে কাজ করা। প্রাণ মিস্টার ম্যাংগোর বিজ্ঞাপন ছিল কলির প্রথম প্রজেক্ট। কাস্ট ছিলেন অভিনেত্রী সারিকা। আদনান আল রাজীব প্রথম শুট শেষে একটা হাগ দিয়ে বলেন, গুড কলি, তুমি খুব ভালো করছো।
ইন্টার্নশিপ শেষে রানআউট ফিল্মসে কেটে গেছে কলির অর্ধ যুগ। প্রথম বছরে ২১টি প্রজেক্টে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। দীর্ঘ পথচলায় একশোর উপরে বিজ্ঞাপনে কাস্টিংয়ের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য কিছু প্রজেক্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আসলে প্রতিটি কাজই আমার আমার কাছে আনন্দের। সব কাজ আমি ফুল এফোর্ট দিয়ে করেছি। শুরুর দিকে বাংলালিংক ফোর জি প্রজেক্টের কথা বলতেই হয়। সিনিয়ররা প্রথম ফুল প্রজেক্ট একাই হ্যান্ডেল করতে বলেন। এ টু জেড আইডিয়া দিয়ে কাজটা বের করেছিলাম, যা ভিন্ন এক অনুভূতি ছিল। তারপর গ্রামীণফোন ফোর জি প্রজেক্টের কথা বলতে হয়। আদনান ভাইয়ের ‘বিকেল বেলা পাখি’ ফিকশনে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করে ভিন্ন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একটা ফিকশনের ক্ষেত্রে কীভাবে কাস্ট সিলেকশন করতে হয় তা শিখতে পেরেছিলাম। অনেকের কাছে ‘ইউটিউবার’ ফ্লপ প্রজেক্ট। কিন্তু আমি বলবো অনেক কিছু শিখেছি এই প্রজেক্ট থেকে।
এখন কাজ করছেন সকলের সঙ্গে
ছয় বছর আগে কিছু না জানা এক তরুণীকে সুযোগ করে দিয়েছিলেন আদনান আল রাজীব। শুধু শুধু যে দেননি তা কলি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। বলা হয়, বর্তমান সময়ের সেরা কাস্টিং ডিরেক্টরদের একজন কামরুন নাহার কলি। বিজ্ঞাপন জগতের কিং বললে ভুল হবে না আদনান আল রাজীবকে। কামরুন নাহার কলি নিজের ক্যারিয়ারে সবটুকুই শিখেছেন তাদের ছায়াতলে থেকে। প্রতিটি প্রজেক্ট আলাদা একটা এক্সপেরিয়েন্স দিয়েছে। টানা ছয় বছর কাজ করেছেন আদনান আল রাজীবের সঙ্গে। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রানআউট ফিল্মস থেকে বের হয়ে ফ্রিল্যান্সার কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন সকলের সঙ্গে। জানুয়ারি মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিশটির অধিক বিজ্ঞাপনে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন।
নতুন ভুবনে কলি
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করার সুবিধা হচ্ছে সকলের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়। গত আট মাসে এপেক্স, বিকাশ, জিপি, বসুন্ধরা, এয়ারটেলের মতো কোম্পানির সঙ্গে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনে। এবছরের ‘ক্লোজআপ কাছে আসার গল্প’-র একটি ফিকশন নির্মাণ করেছেন রাকা নোশিন নাওয়ার। ‘আমার একটা তুমি লাগবে’ ফিকশনের কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কামরুন নাহার কলি। ফ্রিল্যান্সার কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করার পর বড় ক্যানভাসে কাজ ছিল এটাই। ঈদুল আজহায় ভারতীয় ওটিটি প্লাটফর্ম ‘হইচই’ তে রিলিজ পেয়েছে ‘মিশন হান্টডাউন’ ওয়েব সিরিজ। সানী সানোয়ার ও ফয়সাল আহমেদের যৌথভাবে নির্মিত সিরিজটিতে কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তিনি জানান, সম্পূর্ণ একটা ওয়েব সিরিজে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল পুরোপুরি আলাদা। বাল্যবিবাহ নিয়ে ইউনিসেফের একটি বিজ্ঞাপন নির্মাণ করছেন অমিতাভ রেজা চৌধুরী। সম্প্রতি কাজটি সম্পন্ন করেছেন কলি। ‘নোনা জলের কাব্য’ খ্যাত নির্মাতা রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের সঙ্গে একটা সরাসরি প্রজেক্ট করেছেন তিনি। দেশীয় ওটিটি প্লাটফর্ম ‘চরকি’তে মিজানুর রহমান আরিয়ানের ‘পুনর্মিলন’ মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
কলির বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
একজন কাস্টিং ডিরেক্টর হিসেবে তিনি প্রযোজক, পরিচালক এবং অভিনয়শিল্পী এই তিন জনের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন। সহজ করে বললে, একজন নির্মাতা নতুন কোনো কাজ করার সময় তার গল্পের ওপর ভিত্তি করে যে প্রকৃতির শিল্পী খুঁজছেন তা খুঁজে বের করা মূলত কাস্টিং ডিরেক্টরের কাজ। কাজের সম্পর্কে জানতে চাইলে কলি জানান, অবশ্যই নির্মাতার কাছ থেকে বিজ্ঞাপনের গল্প জানার পর কাস্টিং সিলেকশন করে থাকি। ডিরেক্টর অ্যাপ্রোচ করলে অবশ্যই পুরো গল্পটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করি, কার সঙ্গে পারফেক্ট ম্যাচ করবে। আমার মনে হয় একজন আর্টিস্টকে একটা প্রোপার টাইম দিলে তিনি নিজের কাজটা করে দেখাতে পারবেন। আমরা তো কাজ করি শিল্পীদের নিয়ে, আমাদের অনেক নতুন মুখ প্রয়োজন হয়। এজন্য নানান ইভেন্ট চলে যাই প্রায়ই। ফ্রি থাকলেই শিল্পকলা একাডেমি, মহিলা সমিতিসহ যেখানেই অভিনয় শিল্পীদের আনাগোনা রয়েছে সেখানেই আড্ডা দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রি প্রোডাকশনে প্রচুর সময় চলে যায়। প্রায়ই ফুল নাইট শ্যুট হয়। আমার সবসময় ফ্যামিলি সাপোর্ট ছিল কাজের ক্ষেত্রে, যার ফলে অনেক পথ সহজ হয়ে যায়। ভবিষ্যতে বড় পর্দায় কাজ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক কিছু প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান থেকে কাস্টিং ডিরেকশন শেখার ইচ্ছে রয়েছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু শেখা তা কাজ করতে করতে শেখা হয়েছে কামরুন নাহার কলির।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: অন্তরালে