কিংবদন্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন আজ

আজ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জন্মদিন। ১৯২০ সালের ১৬ জুন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তার মাতামহের বাড়ি পবিত্র বারাণসী শহরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার সুরেলা কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর আধুনিক গান আজও গেঁথে আছে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে।

পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো কিংবা ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে অথবা মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে—গায়ক বা সুরকার হিসেবে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেরা তিনটি গান বাছা, আর সমুদ্রের ঢেউ গোনা, একই রকমের ব্যর্থ প্রয়াস। অবিস্মরণীয়, অনবদ্য, কালজয়ী, যে বিশেষণই ব্যবহার করা যাক না কেন, অধিকাংশ বাঙালিরই তা যথেষ্ট মনে হবে না।

বাংলা সঙ্গীতজগতের অন্যতম পুরোধা ও সুরস্রষ্টা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় সংগীতের ঈশ্বর। তিনি বাংলা সঙ্গীতজগৎকে বিশাল উচ্চতায় তুলে ধরেছেন। গান গেয়েছেন, সুর করেছেন, অনন্য সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিয়েছেন সঙ্গীতবলয়কে। নানামুখী গানে আর কোনো শিল্পী তার সমকক্ষ হতে পারেননি। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী ছিলেন তিনিই।

বাংলা সঙ্গীত জগতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এক কালজয়ী নাম। অসাধারণ সুর আর স্নিগ্ধ ও মোহনীয় কণ্ঠের ছোঁয়ায় তিনি বাংলা সঙ্গীতভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন, হয়ে উঠেন সঙ্গীতের বরপুত্র, হয়ে আছেন সুরের জাদুকর। তিনি হিন্দি সঙ্গীত জগতে হেমন্ত কুমার নামে প্রসিদ্ধ। পঞ্চাশ-ষাটের দশককে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে বলা হয় আধুনিক গানের প্রবাদ পুরুষ।

সিনেমার গান হোক বা রবীন্দ্রসঙ্গীত বা আধুনিক, গায়ক হিসেবে কোনও ক্ষেত্রেই বিন্দুমাত্র অস্বচ্ছন্দ বোধ করতেন না তিনি। সুরকার হিসেবেও বারবার প্রমাণ দিয়ে গিয়েছেন অগাধ বৈচিত্র্যের। একদিকে পশ্চিমী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভক্ত ছিলেন, অন্যদিকে ভারতীয় সঙ্গীতের নানা আঙ্গিকও ছিল তার নখদর্পণে।

তার আদি নিবাস ছিল দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার জয়নগরে। তার ছেলেবেলা কেটেছে জয়নগরের বহেডু গ্রামে। চব্বিশ পরগনা থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে‌ তার পরিবার কলকাতায় চলে যায়। বড় ভাই তারাজ্যোতি ছোটগল্প লিখতেন। হেমন্ত মেজো। বড় ভাই ছাড়া বাকি দুই ভাই তারাজ্যোতি ও অমল মুখোপাধ্যায়। হেমন্তের ছোটভাই অমল মুখোপাধ্যায় গান করতেন।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কখনো গান শিখেননি। লোকমুখে শুনে শুনে গান তুলে নিতেন গলায়। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের ক্লাসরুমে বসে গান গাইতেন। একবার সেই গান শুনে ফেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার। স্কুল থেকে প্রায় বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন। পরে বাবা গিয়ে অনেক অনুরোধ করে সামাল দিয়েছিলেন।

শিক্ষাজীবনে হেমন্ত ভবানীপুরের মিত্র ইন্সটিটিউশনে ছিলেন। সেখানেই তার সাথে পরিচয় হয় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। হেমন্তকে রেডিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। শৈলেশ দাসগুপ্তের সহায়তায় ১৯৩৫ সালে ১৪ বছর বয়সে রেডিওতে প্রথম গান গাইলেন হেমন্ত।

সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার-সম্মাননার পাশাপাশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডিলিট। পেয়েছেন সংগীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার, মাইকেল মধুসূদন পুরস্কার।

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অসংখ্য গানের মধ্যে জনপ্রিয় কিছু গান- মাগো ভাবনা কেন; পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো; ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে; আয় খুকু আয়,আয় খুকু আয়; মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে; ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলোনা, ও বাতাস আঁখি মেলোনা; আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি, আর মুগ্ধ এ চোখে চেয়ে থেকেছি; এই রাত তোমার আমার, ঐ চাঁদ তোমার আমার… শুধু দুজনে; মেঘ কালো, আঁধার কালো, আর কলঙ্ক যে কালো; রানার ছুটেছে তাই ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে; বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও, মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিও; আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ; কেন দূরে থাকো, শুধু আড়াল রাখো; ওলিরও কথা শুনে বকুল হাসে; ছেলে বেলার গল্প শোনার দিনগুলো; আমিও পথের মত হারিয়ে যাবো; ইত্যাদি।

সঙ্গীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন সম্মানসূচক ডি.লিট। প্রথম ভারতীয় গায়ক হিসেবে হলিউডের সিনেমায় নেপথ্য কণ্ঠ দান ও আমেরিকা সরকার কর্তৃক বাল্টিমোরের নাগরিকত্ব লাভ। পেয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা মৈত্রী পুরস্কার।

১৯৮৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এই মহান শিল্পী মারা যান।

দেশ রূপান্তর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − two =