নিবিড় চৌধুরী
বিখ্যাত রুশ চলচ্চিত্র নির্মাতা আঁদ্রেই তারকোভস্কির এক একটি দৃশ্য দেখে যেমন চোখে ধাঁধা লেগে যায়, তেমনি কিম কি দ্যুকের সিনেমাও আপনার হৃদয় ও চোখ এক করে দেবে। তারকোভস্কিকে বলা হয় চলচ্চিত্রের কবি। কিম কি দুক প্রকৃতি ও মনস্তাত্ত্বিক বোদ্ধা। রোগ নিরাময়কারীও। যেমনটা সাহিত্যে আমরা বলে থাকি, জন কীটস সৌন্দর্যের কবি আর উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির। ঠিক ওভাবে হয়তো তুলনা দেওয়া সমীচীন হবে না। তবু বলতে হয়, তারকোভস্কি যেমন কীটস বা এলিয়টের মতো অলিগরি ঘুরে তুলে আনেন দৃশ্যের ঘ্রাণ তেমনি বিখ্যাত রুশ ঔপন্যাসিক লেভ তলস্তয়ের মতো কিম দ্যুক মানব মনের বিভিন্ন চেতনাকে নিয়ে আসেন পর্দায়।
চোখ পলক ফেলবার আগেই কিম দ্যুক মনের ভেতর দৃশ্য গেঁথে দিতে পারেন। ইরানিয়ান ফিল্মের যে ন্যারেটিভ সেন্স বা ফরাসি ফিল্মের নির্মাণশৈলী, যে শৈল্পিক উপস্থাপন ও মোশন (গতি) তৈরি করে; কিম দুক ঠিক যেন সেখান থেকেই তার ফিল্ম শুরু করেন। তার ফিল্ম জুড়েই রয়েছে ঘৃণা, যৌনতা, প্রায়শ্চিত্ত, বৃষ্টি, বরফ, প্রতিশোধ, রাগ, চমক বা ট্যুইস্ট, হিংসা-প্রতিহিংসা, খুন, রিভেঞ্জ (প্রতিশোধ) এবং উপর্যুপরি ব্যক্তির ‘নিরাকার’ হওয়ার অদ্ভুতুড়ে ব্যাপার। এ ছাড়া থাকে জেন্ডার (লিঙ্গ) সচেতনতা। পুরুষতান্ত্রিকতা দ্বারা নারীর হয়রানি হওয়াকে তুলে নিয়ে আসেন পর্দায়। যৌনতা যে শারীরিক ব্যাপারের চেয়ে মনস্তাত্ত্বিক; কিম দুক তা খুব শক্তভাবে ব্যবহার করেন। অর্থাৎ রাগ, হিংসা, ঘৃণার মতোও ‘যৌনতা’ একটা মানসিক বিষয়।
মূলত সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ঘরানার হলেও তার ফিল্ম থ্রিলার নয়। তবে মনোজগতের খুঁটিনাটি নিয়ে তিনি নাড়তে ভালবাসেন। কিম দুকের যে সিনেমাবোধ তার সামান্য উদহারণ দেওয়া যাক। বছর খানেক আগে কিম কি দুকের সিনেমা বা বোধের হালকা একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ হয়েছিল। তার থেকে কিছু অনুবাদ তুলে দিলাম এখানে, পাঠকদের উদ্দেশ্যে। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয়েছিল তার ২০০২ সালে ‘ব্যাড গাই’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগে।
শুরুতেই সাক্ষাৎকারগ্রহীতা ভল্কার হামেল জানতে চান, মিস্টার কিম, একসময় আপনি বলেছিলেন, আপনার প্রত্যেকটি ফিল্মের স্টার্টিং পয়েন্টটা তীব্র ঘৃণার। আপনার নতুন ছবি ‘ব্যাড গাই’তে কোন রকমের উন্মত্ততা দেখাচ্ছেন? কিম কি দুকের উত্তর, আমি এখানে ‘তীব্র ঘৃণা’ শব্দটি ব্যবহার করেছি বৃহৎ প্রসঙ্গে এবং আমি সত্যিই মনে করি না আপনার এই প্রসঙ্গের বাইরে যাওয়া উচিৎ। ঘৃণার ব্যাপারে আমি কোনো একটি নির্দিষ্ট কথা বলছি না, কোনো বস্তু বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে পরিচালনা করছি না। বস্তুতপক্ষে এটা এমন এক প্রকারের অনুভূতি যা আমি আমার জীবনে দেখি এবং এমন কিছুকে দেখি যা আমি বুঝি না; যার কারণবশত আমি ফিল্ম বানাই। আমি কিছু দেখি এবং আর অনেক কিছুই দেখি না এবং ঐসব না দেখা জিনিসকে বোধগম্যের জন্য আমি ফিল্ম বানাই।
কীভাবে ফিল্ম বানাতেন কিম কি দুক? ‘বানাতেন’ লিখতে হচ্ছে কারণ, করোনা মহামারির সময় ২০২০ সালের ১১ ডিসেম্বর লাটভিয়ায় নতুন ছবি নির্মাণের সময় আকস্মিকভাবে ৬৯ বছর বয়সে মারা যান দক্ষিণ কোরিয়ার পরিচালক। তার জন্ম ১৯৬০ সালের ২০ ডিসেম্বর। চলচ্চিত্রের জন্য বিশ্বে যেমন নন্দিত হয়েছিলেন তেমনি বিভিন্ন কারণে কিম দ্যুক নিজ দেশে নিন্দিতও হয়েছিলেন। কোরিয়ায় তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে না আসলেও বিশ্ববাসী তাকে স্মরণ করেছিল। এখনো তাকে স্মরণে রেখছেন সবাই।
প্রাচীন জেন দর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন কিম দ্যুক। তার ছবিতে ভায়োলেন্স, যৌনতা যেমন উঠে এসেছে তেমনি ধ্যান, একাগ্রতা ও প্রকৃতিবাদী চেতনা। আর এই সবকিছু একসঙ্গে পাওয়া যায় তার ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সনি পিকচার্সে ব্যানারে মুক্তি পাওয়া ‘ঝঢ়ৎরহম, ঝঁসসবৎ, ঋধষষ, ডরহঃবৎ… ধহফ ঝঢ়ৎরহম’ মুভিতে। মুক্তির পরপরই এই ছবি দিয়ে বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন কিম দ্যুক। মানুষের জীবনের সঙ্গে ঋতুর যে ওতপ্রোত সম্পর্ক; সেটিকে অসাধারণভাবে বর্ণনা করেছেন তিনি। ঋতুর সঙ্গে মানুষের মন মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটে। বাল্মীকি এক সময় দস্যু ছিলেন। পরে মুনি হয়ে লেখেন ‘রামায়ণ’। ‘স্প্রিং, সামার, ফলে’ও সেই সুর।
কোরিয়ার এক জনহীন জায়গায় এক ছোট মন্দির। চারপাশে ঘন গাছপালা। তার মাঝে এক লেক। মাঝখানে দ্বীপের মতো এক বৌদ্ধ মন্দির। সেখানে বাস করেন এক সাধু। সঙ্গে তার শিষ্য। ছোট থেকেই শিষ্যকে ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক ও মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষা দিয়ে আসছেন গুরু। একদিন তাদের নির্ভেজাল জীবনে আসে এক কিশোরী। মানসিক চিকিৎসার জন্য গুরুর কাছে কিশোরীকে আনেন তার মা। সেই কিশোরীর নিরানন্দ ও একাকীত্বের জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে সেই কিশোর। তখন হ্রদের চারদিকে পানি থৈথৈ করছে। দুজনে জড়ায় অনৈতিক সম্পর্কে। গুরু সেটি জানতে পারেন। কিশোরী সুস্থ হয়ে শহরে চলে যায়। কিশোর তার জন্য পালিয়ে যায়। অনেক বছর পরে যখন ফেরে তখন সে যুবক। তবে খুনের আসামী। সেই কিশোরীকে বিয়ের পর সে খুন করেছিল। পালিয়ে আসা শিষ্যকে ধরতে মন্দিরে আসে দুই পুলিশ। অপরাধ জানতে পেরে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক পদ্ধতিতে মানসিকভাবে শিষ্যকে শাস্তিতে দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেন গুরু। এরপর সাজা কেটে যখন শিষ্য ফেরে তখন দেখে চারদিকে বরফে ঢাকা। গুরু আর নেই। শিষ্য নতুন মানুষ হয়ে ওঠার জন্য পুনরায় মন্দিরের ও নিজের সংস্কার শুরু করেন। একদিন এক নারী এসে এক শিশুকে রেখে যান। যেমনটি অনেক বছর আগে গুরুর কাছে শিষ্যকে রেখে গিয়েছিল আরেকজন।
এই ছবিতে কিম কি দ্যুক দেখিয়েছেন, কীভাবে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানব জীবনেরও পরিবর্তন ঘটে। ঋতুর ছাপ পড়ে জীবনে। বলে রাখা ভালো, কোরিয়ায় চার ঋতু। এই চার ঋতুর নামের সিনেমার নামকরণ। কিম দ্যুক দেখিয়েছেন, মানব জীবনের পুনরাবৃত্তিকেও।
কিম দ্যুকের প্রায় প্রত্যেক ছবিতে আধ্যাত্মিক জীবনের ছাপ পাওয়া যায়। তার অন্য দুই মাস্টারপিস; ‘থ্রি আয়রন’ ও ‘দ্য বো’। ২০০৪ ও ২০০৫, পরপর এই দুই ছবি বানিয়ে নিজের সৃজনশীলনতাকে ভিন্নমাত্রা দেন তিনি। থ্রি আয়রন এক বোবা যুবকের গল্প। যার কোনো ঠিকানা নেই। তবে বুদ্ধি ও কৌশলের জোরে সে বিভিন্ন জনের আলিশান ঘরে জীবন যাপন করে। একদিন সে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। সাজা হয়। তখন সে অদৃশ্য হওয়ার ধ্যান শুরু করে। সেভাবেই এক নির্যাতিত বিবাহিত নারীর ঘরে আশ্রয় নেয় ও ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু সে নারী ছাড়া তাকে দেখে না কেউ। দ্য বো, এক সাধক নাবিকের গল্প। একটি বোট নিয়ে নদীতেই জীবন যাপন তার। সঙ্গে থাকে তার পালিত কন্যা। জীবিকা নির্বাহ করেন বোটে শৌখিন ব্যক্তিদের মৎস্য শিকারের ব্যবস্থা করে দিয়ে। শুধু এক উদ্দেশ্যে সেই নাবিক সঙ্গে রেখেছিল মেয়েটিকে। রজস্বলা হলে শারীরিক মিলনের জন্য। সেটিই হয়। সাপ হয়ে মেয়েটির সঙ্গে মিলনের পর পানিতে চলে যান তিনি। মুক্তি পায় মেয়েটিও।
কিম দ্যুকের ছবি আনপ্রেডিক্টেবল। চরিত্রগুলো এমনভাবে এগোয় যেন তারা একসঙ্গে মনে পুষে রাখে ভালোবাসা ও বিষ। তেমন দুই মুভি, পিয়েতা (২০১২) ও মুভিয়াস (২০১৩)। এই দুটির পর তিনি আরও অনেক ছবি করলেও সেভাবে আলোচিত হয়নি। এই দুই ছবির বৈশিষ্ট্য হলো, ভালোবাসা ও ঘৃণা। পিয়েতা এক অনাথ যুবকের কাহিনী। যে নির্দয় জীবন যাপন করলেও পরাজিত হয় ভালোবাসার কাছে। তেমনি মুভিয়াসও। যেখানে সন্তানের পুরুষাঙ্গ কেটে নেয় তার মা। একই ঘরানার আরেক ছবি ‘টাইম’। এই তিন মুভি দেখার পর বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সেই বিখ্যাত উক্তিটিই মনে পড়বে, ‘ভালোবাসা থেকেই ঘৃণার উৎপত্তি’।
এছাড়া কিম দ্যুকের দ্য আইল (২০০০), স্যামাটারিয়ান গার্ল (২০০৪), আমেন (২০১১) ছবি তিনটিতেই আপনি খুঁজে পাবেন প্রেম, ঘৃণা, প্রতিশোধ, আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। তার আরেক জীবনীভিত্তিক ছবি আরিরাং (২০১০)। সেই ছবি জানিয়ে দেবে, কিম দ্যুকের ব্যক্তিগত জীবনটা কেমন ছিল। তবে সেটিকে পুরোপুরি তার জীবনী ভাবলে ভুল হবে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: বায়োস্কোপ