কোপা ও ইউরোর যত ঘটন-অঘটন

নিবিড় চৌধুরী

শেষ হয়ে গেল দুই মহাদেশীয় লড়াই কোপা আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ। এখন চলছে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ অলিম্পিকস। ১০০ বছর পর প্যারিসে বসেছে বিশ্বসেরা অ্যাথলেটদের এবারের মেলা। চলুন দেখে নেওয়া যাক জুলাইয়ে শেষ হওয়া কোপা ও ইউরো কেমন গেল। গত ১৪ জুলাই দিবাগত রাতে ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর জয়ে এক যুগ পর ইউরোপের সিংহাসন দখল করেছে স্পেন। পরদিন সকালে লাওতারো মার্তিনেজের একমাত্র গোলে ২০ বছর পর ফাইনালে ওঠা কলম্বিয়াকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় কোপা জিতেছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। এবার দেখে নেওয়া যাক ২৯ দিনের ইউরো আর ২৪ দিনের কোপায় কী কী ঘটন-অঘটন ঘটল।

ফেবারিট ব্রাজিলের বিদায়

কাতার বিশ্বকাপে শেষ আট থেকে বিদায়ের পর কোচের দায়িত্ব ছাড়েন তিতে। এরপর লম্বা সময়ে ধরে কোচের সন্ধানে থাকতেই সময় কেটেছে তাদের। সেলেসাওদের পারফরম্যান্সও ছিল পড়তির দিকে। সেই চাপ দেখা গেল কোপাতেও। নতুন কোচ দোরিভাল জুনিয়রের অধীনে গ্রুপ পর্ব থেকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নকআউট পর্বে উঠলেও শেষ রক্ষা হয়নি ব্রাজিলের। কার্ড নিষেধাজ্ঞায় পড়া ভিনিসিয়ুস জুনিয়রকে ছাড়া খেলতে নেমে উরুগুয়ের বিপক্ষে টাইব্রেকার হেরে টুর্নামেন্টের গতবারের ফাইনালিস্টরা বিদায় নেয় কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। গত বিশ্বকাপেও সেলেসাওরা টাইব্রেকারে হেরেছিল কোয়ার্টার ফাইনালে। ব্রাজিলের শুরুটা হয় কোস্টারিকার বিপক্ষে গোলশূন্য ড্রয়ে। এরপর প্যারাগুয়ের বিপক্ষে বড় জয় পেলেও পরের ম্যাচে ড্র করে কলম্বিয়ার সঙ্গেও। চোটে পড়ায় কোপায় দেখা যায়নি নেইমারকে। তাকে ছাড়া দলটি দক্ষিণ আমেরিকার বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও ধুঁকছে।

গ্যালারিতে নুনিয়েজের হাতাহাতি

কলম্বিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে হারের পর হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন লিভারপুলের উরুগুইয়ান ফরোয়ার্ড ডারউইন নুনিয়েজ। বেষ্টনি টপকে গ্যালারিতে উঠে বক্সারের মতো ঘুষি পাকিয়ে কলম্বিয়ান সমর্থকদের সঙ্গে তার মারামারির দৃশ্যটি মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সামাজিকমাধ্যমে। গ্যালারিতে থাকা পরিবারকে বাঁচাতে নুনিয়েজ এবং তার সতীর্থরা এই মারামারিতে লিপ্ত হোন বলে জানান উরুগুয়ের অধিনায়ক হোসে মারিয়া হিমেনেজ। এমন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার তদন্ত শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা কনমেবল। মাঠেও কলম্বিয়ার সমর্থকদের সঙ্গে উরুগুয়ের খেলোয়াড়দের প্রায় হাতাহাতি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল কয়েকবার।

আবারও বাজপাখি মার্তিনেজ

ম্যাচ কোনোভাবে টাইব্রেকারে যাওয়া মানেই আর্জেন্টিনার জয়। গোলপোস্টের নিচে এমিলিয়ানো মার্তিনেজ আসার পর থেকেই এমন নির্ভার থাকতে পারছেন লিওনেল মেসিরা। এবারের কোপায় শেষ আটে ইকুয়েডরের বিপক্ষেও লা আলবিসেলেস্তেদের উদ্ধার করেছেন তিনি। পেনাল্টি শুটআউটে মেসি প্রথম শট মিস করেছিলেন। তবে আর্জেন্টিনা অধিনায়ককে কাঁদতে দেননি এমি। আবারও বাজপাখি হয়ে ইকুয়েডরের দুই শট রুখে দিয়ে হয়ে উঠেন নায়ক। গত বিশ্বকাপের ফাইনালেও ট্রাইবেকারে ফ্রান্সের সামনে চীনের মহাপ্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ‘দিবু’। সেই বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষেও টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনাকে জেতান তিনি। অ্যাস্টন ভিলা গোলরক্ষক দেশের হয়ে যে চারটি টাইব্রেকারে গোলপোস্ট সামলেছেন, সবকটিতেই জিতেছে আর্জেন্টাইনরা।

রদ্রিগেজের পুরোনো ছন্দ

২০১৪ বিশ্বকাপে ৬ গোল করে গোল্ডেন বুট জিতেছিলেন হামেস রদ্রিগেজ। এরপর অবশ্য ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজেকে সেভাবে আর মেলে ধরতে দেখা যায়নি সদ্য ৩৩ বছরে পা রাখা এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডারকে। এক দশক পরে হলেও আবারও পুরোনো স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। তার ৬ অ্যাসিস্ট ও ১ গোলে ২৩ বছর পর কোপার ফাইনালের টিকিট পায় কলম্বিয়া। দুই দশক পর ফাইনালে ওঠা দলকে শিরোপা জেতাতে না পারলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হোন তিনি। সেই পারফরম্যান্সে আবারও ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে ফেরার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ, বায়ার্ন মিউনিখের সাবেক তারকাকে।

অভিষেকেই কানাডার রূপকথা

কোপার ইতিহাসে স্বাগতিক হিসেবে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার লজ্জার রেকর্ড গড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে তাদের প্রতিবেশি কানাডা প্রথমবার টুর্নামেন্টে এসেই গড়েছে সেমিফাইনালে খেলার কীর্তি। তবে তাদের সেই রোমাঞ্চকর রূপকথার অভিযান থামে নিউজার্সিতে, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ২-০ হেরে। তৃতীয় স্থান নির্ধারণীতে  উরুগুয়ের কাছে হেরে কানাডা কোপা শেষ করে চতুর্থ হয়ে। তবে স্বপ্নের মতো এক টুর্নামেন্ট কাটানোটা স্মরণে থাকবে হেসে মার্শের শিষ্যদের।

ফাইনালে মেসির কান্না

মেসিকে কখনো সবার সামনে কাঁদতে দেখেছেন কি? সেই বিরল দৃশ্যই দেখা গেল কোপার ফাইনালে। চোটে পড়ে মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। মাঠ ছাড়ার সময় ক্ষোভও প্রকাশ করেন। এরপর সাইডলাইনে বসে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি গ্রহের সেরা ফুটবলার। সুখে অনেকবার কেঁদেছেন মেসি। কিন্তু এভাবে চোট পেয়ে কান্না তিনি কখনো করেননি। মুহূর্তে সব ক্যামেরা ঘুরে যায় রেকর্ড আট ব্যালন ডি’অর জয়ীর দিকে। মেসিকে কান্না করতে দেখে কেঁদেছেন তার ভক্ত সমর্থকেরা। তবে সেই কান্না মুছে শিরোপা উৎসব করেছেন মেসি। তবে আঘাতে ফুলে যাওয়া গোড়ালির কারণে অনেকদিনের জন্য মাঠের বাইরে চলে যেতে হলো তাকে।

১৬ বছরেই এতকিছু

গত ১৩ জুলাই ১৭ বছরে পা দিয়েছেন লামিনে ইয়ামাল। তার দিন চারেক আগে ফুটবলের অবিসংবাদিত সম্রাট পেলের রেকর্ড ভেঙেছেন তিনি। স্পেনের এই দামাল কিশোরই এখন মেজর টুর্নামেন্টে (বিশ্বকাপ/ইউরো) সবচেয়ে কম বয়সী গোলদাতা। গত বছর মাত্র ১৬ বছর বয়সে বার্সেলোনার হয়ে লা লিগায় অভিষেকের পর থেকে একের পর রেকর্ড গড়ে চলেছেন ইয়ামাল। সেই ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন ইউরোতেও। কিলিয়ান এমবাপ্পের ফ্রান্সের বিপক্ষে তার বাঁ পায়ের দূরপাল্লার শটে সমতায় ফেরানো গোলে এক যুগ পর ফাইনালে উঠে স্প্যানিশরা। শিরোপাও হাতছাড়া হয়নি ইয়ামালের। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে এখন সর্বত্র প্রশংসায় ভাসছেন এই তারকা। অনেকে তাকে মনে করছেন ‘ভবিষ্যতের মেসি’। ইয়ামাল সেই পথে হাঁটতে পারবেন কিনা সেটি সময় বলে দেবে।

বেলিংহামের বাইসাইকেল কিক

ঘড়ি দেখে রেফারি শেষ বাঁশি বাজাতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। গ্যালারিতে ইংলিশ সমর্থকদের মুখে তখন ঘোর অন্ধকার। হঠাৎ উড়ে আসা বলে এক দুর্দান্ত বাইসাইকেল কিকে সেই মেঘ সরিয়ে উদ্?যাপনে মেতে উঠল ইংল্যান্ড। সেøাভাকিয়ার বিপক্ষে জুড বেলিংহাম অমন দুর্দান্ত গোলটি না করলে শেষ ষোলোতেই ঘরে ফিরত হত গ্যারেথ সাউথগেটের দলকে। সেই ইংল্যান্ড টানা দ্বিতীয়বার ইউরোর ফাইনালে উঠলেও আবারও শিরোপা বঞ্চিত হয়েছে। বরুশিয়া ডর্টমুন্ড ছেড়ে  রিয়াল মাদ্রিদের হয়েও প্রথম মৌসুমেই ইংলিশ মিডফিল্ডার বেলিংহাম যোগ করা সময়ে বেশ কয়েকটি গোল করেছেন। কখনো ইউরো না জেতা থ্রি লায়ন্সরা শেষ কোনো প্রধান শিরোপা জিতেছিল ১৯৬৬ সালে, ঘরের মাটিতে আয়োজিত বিশ্বকাপে।

রোনালদো-পেপের কান্না

গত বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর কেঁদেছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। সেই কান্না কাউকে না দেখাতে দ্রুত ঢুকে পড়েছিলেন টানেলে। ৩৯ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড  এবার কাঁদলেন ইউরোতে, স্লোভেনিয়ার বিপক্ষে। ১০৫ মিনিটে পেনাল্টি থেকে পর্তুগালকে এগিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সিআর সেভেন। তবে তার শট ঝাঁপিয়ে রুখে দেন ইয়ান ওবলাক। এরপর অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার পর সেই ব্যর্থতায় কান্না চেপে রাখতে পারেননি রোনালদো। টাইব্রেকারে গড়ানো ম্যাচটিতে অবশ্য গোল পান তিনি। গোলরক্ষক দিয়োগো কস্তার বীরত্বে পর্তুগিজরাও নিশ্চিত করে শেষ আট। কিন্তু পর্তুগিজরা যেতে পারেনি সেমিফাইনালে। ফ্রান্সের বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেন রোনালদোরা। সেই হারের পর চোখ ছলছল চোখে দীর্ঘদিনের সতীর্থ ডিফেন্ডার পেপেকে সান্ত্বনা দেন রোনালদো। এবারের ইউরোয় রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক দুই তারকার শেষ টুর্নামেন্ট হয়ে থাকল।

অভিষেকেই জর্জিয়ার ইতিহাস

পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার পর কখনো বিশ্বকাপে খেলা হয়নি জর্জিয়ার। ইউরোতেও এসেছিল প্রথমবার। অভিষেকেই বাজিমাত করেছে তারা। গ্রুপ পর্বে চেক প্রজাতন্ত্রের বিপক্ষে ড্রয়ের পর পর্তুগালকে হারিয়ে গড়ে ইতিহাস। প্রথমবারের মতো উঠে যায় শেষ ষোলোয়। স্পেনের বিপক্ষে শেষ আটে ওঠার লড়াইয়ের আগে জর্জিয়ার কোচ জানিয়েছিলেন, তারা ইতিমধ্যে ইউরো জিতে গেছেন। তবে স্প্যানিশদের কাছে হেরে শেষ আটে উঠতে না পারলেও মনের আনন্দে ঘরে ফিরেছে জর্জিয়া। জার্মান  সফরটা যে দারুণ হলো তাদের! ইউরোতে এবার চমক দেখিয়েছে তুরস্কও। ২০০৮ সালের পর তারা খেলেছে শেষ আটে। ২০ বছর পর সেমিফাইনালে খেলেছে নেদারল্যান্ডস।

ইতালি-জার্মানির বিদায়

বাছাইপর্ব উতরাতে না পারায় ২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপে খেলা হয়নি চারবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালির। মাঝখানে ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইউরো জিতেছিল আজ্জুরিরা। তবে নাপোলিকে ৩৩ বছর পর সিরি আ জেতানো কোচ লুসিয়ানো স্পেলেত্তির অধীনে ইতালি শিরোপা ধরে রাখতে নেমে গ্রুপ পর্বের মৃত্যুকূপ পেরোলেও ঘরে ফেরে শেষ ষোলোয় সুইজারল্যান্ডের কাছে ২-০ গোলে হেরে। আর শেষ আট থেকে বিদায় নেয় জার্মানি। স্বাগতিক হওয়ায় এবারের ইউরোর ফেবারিট ছিল জার্মানরা। কিন্তু চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা রোমাঞ্চ জাগিয়ে হেরে যায় স্পেনের কাছে। গত দুই বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায়ের পর ইউরোতেও ব্যর্থতা ঢাকতে পারল না জার্মানি। কোচের পর কোচ পাল্টালেও আসছে না সাফল্য।

অন্য হিসাব

পাঠক এবার অন্য হিসেবে আসা যাক। আগামী বছর ইউরো ও কোপা চ্যাম্পিয়ন স্পেন-আর্জেন্টিনার মধ্যে ফিনালিসিমার লড়াই। গতবার ইতালিকে হারিয়ে সেই শিরোপা জিতেছিলেন মেসিরা। এবার সেটি পারবেন তো? লড়াইটা যে ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে থাকা মেসি ও নতুনের গল্প লিখতে আসা লামিনেরও। তার আগেই নিষ্পত্তি হবে একটি প্রশ্নের, এই বছর ব্যালন ডি’অর উঠবে কার হাতে? রিয়ালকে লা লিগা ও চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতানো ভিনিসিয়ুস বা বেলিংহামের হাতে নাকি ম্যানচেস্টার সিটিকে প্রিমিয়ার লিগ ও স্পেনকে ইউরো জেতানো ডিফেন্সিভ মিডফল্ডিার রদ্রির হাতে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: খেলার মাঠ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × two =