খাড়া পর্বতের ৪০০ ফুট উঁচুতে দোকান

রঙবেরঙ ডেস্ক

খাড়া একটি পর্বতের প্রায় ৪০০ ফুট উচ্চতায় একটি ঝুলন্ত দোকান। সেখানে কর্মচারী আছেন, এমনকি দোকানটি থেকে মানুষ কেনাকাটাও করেন। আর এর দেখা পেতে হলে আপনাকে যেতে হবে চীনে। একটি সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থিত একটি ছোট খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র বা দোকান যেখানে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়, সেটাই কনভেনিয়েন্স স্টোর। কিন্তু চীনের এ ধরনের একটি দোকানে পৌঁছাতে আপনাকে খাড়া পাহাড় বেয়ে ১২০ মিটার (৩৯৩ ফুট) উঠতে হবে।  অনেকেই তাই একে পরিচয় করিয়ে দেন ‘মোস্ট ইনকনভেনিয়েন্ট’ বা ‘সবচেয়ে অসুবিধাজনক’ কনভেনিয়েন্স স্টোর হিসেবে।

প্রাকৃতিক নানা বিস্ময়ের জন্য চীন বিখ্যাত। আবার মানুষের নির্মিত নানা ভবন এবং কাঠামোর জন্যও গর্ব করে তারা, যা সেখানকার স্থাপত্যবিদ্যার বিস্ময়কর অগ্রগতিকে তুলে ধরে। আর পর্বতের গায়ে ঝুলতে থাকা আশ্চর্য এই দোকান যেন অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝখানে মানুষের এক খেয়ালি কীর্তি। চীনের হুনান প্রদেশের শিনিওঝাই ন্যাশনাল জিওলজিক্যাল পার্কের এই কাঠের বাক্স বা দোকানটি বানানো হয়েছে পর্বতারোহীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে। পর্বতের গায়ে ঝুলতে থাকা দোকানটিতে বিক্রি করা হয় পানির বোতল, পটেটো চিপসসহ হালকা খাবার। চীনা সংবাদমাধ্যম চায়না সেন্ট্রাল টেলিভিশনের (সিসিটিভি) সূত্রে জানা যায়, একবারে কেবল একজন কর্মচারীই বসেন আজব এ দোকানটিতে।

‘দোকানটি থেকে খুব একটা আয় হয় না। তবে পর্যটকেরা এটা এখানে থাকায় খুব খুশি। কাজেই আমরা সবাই মনে করি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করছি’ সিসিটিভিকে বলেছিলেন দোকানটির একজন কর্মচারী। শুধু একজন কর্মচারী একবারে বাক্সটির মধ্যে অবস্থান করেন। কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগে দোকানটিতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তুলে ফেলা। অবশ্য পানি বা স্ন্যাকস প্রয়োজন হলে নিচ থেকে দড়ি দিয়ে টেনে খুব একটা ঝামেলা ছাড়াই দোকানে তোলা সম্ভব হয়।

‘প্রত্যেক নতুন কর্মচারী প্রথমে এখানে কাজ করতে বেশ ভয় পান। তবে আপনি খুব দ্রুত এতে অভ্যস্ত হয়ে যাবেন’ একজন কর্মচারী বলেন, ‘একটা বড় সমস্যা হলো টয়লেট ব্যবহার করা। এর জন্য আবার নিচে নামা ও ওপরে ওঠা কষ্টকর। তাই আমরা খুব বেশি পানি পান না করার চেষ্টা করি।’ অবশ্য এ দোকানে যেসব কর্মচারী কাজ করেন তারা সবাই পর্বতারোহণে দক্ষ।

শিনিওঝাই ন্যাশনাল জিওলজিক্যাল পার্ক পর্যটকদের বিশেষ করে পর্বতারোহীদের কাছে খুব জনপ্রিয়। এটি খাড়া পাহাড়, জলপ্রপাত এবং পর্বতারোহণের পথের জন্য পরিচিতি পেয়েছে। সিসিটিভি বলছে, দোকানটি ২০১৮ সালে খোলা হয়েছিল। অবশ্য করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। একটি খাড়া পার্বত্য পথের ঠিক পাশেই এর অবস্থান। লোহার রড, খাড়া মই এবং কেবল ব্যবহার করে পর্বতারোহীরা দুরারোহ পথটি অতিক্রম করেন। একটা সময় এখানে একটি কুঁড়ের মতো ছিল। যেখানে পর্বতারোহীরা ওপরে ওঠার পথে বিশ্রাম নিতে পারতেন। বছর পাঁচেক আগে একে এমন একটি দোকানে রূপান্তর করা হয়। পর্যটকেরা বিশুদ্ধ পানির পাশাপাশি কেক, জুস, চিপসের মতো ছোটখাটো জিনিস কিনতে পারেন এখান থেকে। অবশ্য ঝুলন্ত এই দোকানটির কথা মানুষ একটা সময় পর্যন্ত খুব একটা জানত না। মূলত বছর খানেকের কিছু বেশি হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ছবি ছড়িয়ে পড়েছে।

যেমন সম্প্রতি একজন এক্স (আগের টুইটার) ব্যবহারকারী এই দোকানের কয়েকটি ছবি দিলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে বেশ আলোড়ন দেখা যায়। এটা সম্পর্কে নানা ধরনের মন্তব্যই করে মানুষ। একজন মন্তব্য করেছেন, ‘এটি একই সঙ্গে খ্যাপাটে এবং অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার।’ অপর একজন লিখেন, ‘এখানে কেনাকাটা করতে বললে আতঙ্কিত হব।’ আরেকজন রসিকতা করেন, ‘আর আমি কিনা ভেবেছিলাম আমার কাজের জায়গায় যাওয়ার পথটা খারাপ।’

কাজেই পাঠক, আপনি যদি রোমাঞ্চপ্রেমী হোন আর পর্বতারোহণ আপনার প্রিয় শখ হয়, তবে শিনিওঝাই ন্যাশনাল জিওলজিক্যাল পার্কে একটি বার আপনার যাওয়াই উচিত। এমন বিস্ময়কর দোকান থেকে কেনাকাটার সৌভাগ্য কয়জনের হয় বলুন!

মাটির ১৩০০ ফুটেরও বেশি নিচের হোটেল

মাটির ১৩০০ ফুটেরও বেশি নিচের একটি হোটেলে থাকতে কেমন লাগবে বলুন তো? অবিশ্বাস্য হলেও ইউরোপের দেশ ওয়েলসের স্নোডোনিয়া পর্বতমালার মাটির নিচে সত্যি এমন একটি হোটেল আছে। পরিত্যক্ত একটি খনির মধ্য অবস্থান ‘ডিপ স্লিপ’ নামের হোটেলটির। একে বলা হচ্ছে পৃথিবীর ডিপেস্ট বা গভীরতম হোটেল।

কমোরথেন নামের পরিত্যক্ত সেøট পাথরের খনিটির ৪১৯ মিটার (১ হাজার ৩৭৫ ফুট) গভীরে হোটেলটি। তবে এখানে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে মনে রাখতে হবে জায়গাটিতে পৌঁছাতে হলে খাড়া এবং দুরারোহ পরিত্যক্ত খনি পথ অতিক্রম করতে হবে আপনাকে। গত এপ্রিলে পর্যটকদের নানা ধরনের রোমাঞ্চকর কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া ‘গো বিলোও’ কোম্পানি এটি চালু করে।

এই হোটেলে থাকতে আগ্রহীরা অনলাইনে এখনকার একটি কামরা রিজার্ভ করতে পারেন। ব্লাইনাই ফেসটিনিওগ শহরের কাছে অবস্থিত গো বিলোওয়ের টানেগ্রিসাই বেস থেকে রোমাঞ্চকর এক যাত্রা শুরু হয় তাদের। সেখানে পাতালরাজ্যের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গাইডেরা। তারপর এখানকার কটেজে হেলমেট, মাথায় আটকানো টর্চ ও বুট পায়ে গলিয়ে বাইরের পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে প্রবেশ করেন পাতালরাজ্যে।

খনি পথটি কিন্তু দুর্গম। খনিশ্রমিকদের ব্যবহার করা পুরানো সিঁড়ি, ক্ষয় হতে থাকা সেতুসহ শরীরের রোম দাঁড় করিয়ে দেওয়া দুরারোহ পথ পেরোতে হবে আপনাকে। রহস্যময় এই আলোছায়ায় আপনাদের সঙ্গে থাকা প্রশিক্ষক এই খনির ইতিহাস গল্পের ছলে শোনাবে আপনাকে। মোটামুটি এক ঘণ্টা পর মাটির ১ হাজার ৩৭৫ ফুট নিচে পৌঁছে যাবেন।

ইস্পাতের বড় একটি দরজা জানিয়ে দেবে ‘ডিপ স্লিপে’ পৌঁছে গেছেন আপনি। কিছুটা সময় বিশ্রাম নেওয়ার পর থাকবে রাতের খাবারের আয়োজন। বড় একটি টেবিলে পরিবেশন করা হয় মাংস এবং সবজির বিভিন্ন পদ। পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর হোটেলে তাপমাত্রা বছরজুড়েই থাকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু কেবিনগুলো এমন উপাদানে তৈরি যে ভেতরটা খুব আরামদায়ক। প্রবহমান পানি, বিদ্যুৎ এমনকি এক কিলোমিটার দীর্ঘ একটি কেবলের মাধ্যমে ওয়াইফাই সুবিধাও পাবেন এখানে। সুইডেনের সালা রুপার খনির ১৫৪ মিটার (৫০৮ ফুট) গভীরে অবস্থিত একটি স্যুইটকে টেক্কা দিয়ে এ অর্জন পাতাল-হোটেলটির।

এবার বরং হোটেলটির কামরাগুলোর খোঁজখবর নেওয়া যাক। ‘ডিপ স্লিপে’ আছে দুই শয্যার চারটি কেবিন। আর এর বিশেষ আকর্ষণ বলতে পারেন কৃত্রিমভাবে তৈরি ডাবল বেডের একটি গুহা-কামরা। এ ছাড়া হোটেলটিতে আছে ডাইনিং এলাকা ও টয়লেট। সপ্তাহে কেবল একবারই অতিথি সেবা দেয় হোটেলটি। সেটি শনিবার সন্ধ্যা থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত। একজন প্রশিক্ষক এবং কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি রাতে নিজস্ব কেবিনে থাকবেন। অর্থাৎ আপনাকে খনিতে একা ছেড়ে দেওয়া হবে না! হোটেলে ওঠা-নামার পথ দুরারোহ হলেও আপনার নিরাপত্তার পুরো ব্যবস্থাই করা হয় এখানে।

সকাল ৮টার দিকে জেগে উঠবেন। একটি উষ্ণ পানীয় এবং হালকা নাশতার পর আবারও মাটির ওপরে এবং দিনের আলোয় ফিরে আসার জন্য দীর্ঘ আরোহণ শুরু করবেন। মোটামুটি দশটা থেকে সাড়ে দশটার দিকে ভ্রমণ শেষে গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে আপনাকে। কেবিন আর গুহায় খরচ কিন্তু দুই ধরনের। কেবিনে থাকলে দুজনের জন্য থাকা-খাওয়াসহ গোটা প্যাকেজ খরচ ৩৫০ পাউন্ড বা প্রায় ৪৭ হাজার টাকা, আর গুহা-নিবাসের বেলায় খরচ হবে ৫৫০ ডলার বা প্রায় ৭৪ হাজার টাকা।

গো বিলোওর অপারেশন ম্যানেজার মাইক মরিস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, অতিথি যারা ইতিমধ্যে হোটেলে থেকেছেন তারা এর ভিন্নতা, সন্ধ্যায় পাতালরাজ্যে কয়েকজন মানুষ একসঙ্গে কাটানোর অনুভূতি এবং সভ্যতা থেকে দূরে থাকার বিষয়টি অনেক পছন্দ করেছেন। অনেক অতিথি এটাও বলেছেন যে এখানে স্বাভাবিকের তুলনায় ভালো ঘুম হয়েছে তাদের। অবশ্য গো বিলোও তাদের এই হোটেলের নামই তো দিয়েছে ‘ডিপ স্লিপ’ বা গভীর ঘুম।

অতএব পাঠক ভিন্নরকম পরিবেশে গভীর একটি ঘুমের জন্য পাতালরাজ্যের এ হোটেলে যেতেই পারেন। তবে মাথায় রাখবেন সেখানে আশ্চর্য এক নীরবতা আপনাকে আঁকড়ে ধরতে পারে, সেই সঙ্গে পাতালের হোটেলে পৌঁছার পথটাও সাহসের পরীক্ষা নেবে!

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: বিচিত্র

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three × four =