প্রভাষ আমিন
যে কারো জন্মদিনই আনন্দের। হোক সেটা ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের। তবে কোনো কোনো ব্যক্তির জন্ম ব্যক্তিগত আনন্দকে ছাপিয়ে বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে উৎফুল্ল করে। কোনো রাষ্ট্রের জন্ম গোটা বিশ্বকেই অনুপ্রাণিত করে। বঙ্গবন্ধু তেমনই একজন ব্যক্তি, বাংলাদেশ তেমনই একটি রাষ্ট্র। মনে হতে পারে কাকতালীয়, কিন্তু কখনো কখনো কিছু কিছু সময় মিলে যায় ইতিহাসের মোহনায়। বঙ্গবন্ধুর জন্মের মাসেই বাংলাদেশের জন্ম! কাকতাল নিশ্চয়ই ইতিহাসেরও পছন্দ। টুঙ্গীপাড়ার অজপাড়াগাঁয়ে জন্ম নেওয়া মাটির গন্ধ মাখা শেখ মুজিবুর রহমান ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রামে ধারণ করলেন একটি জাতির জন্ম আকাক্সক্ষা। সেই আকাক্সক্ষাকে বাস্তব করলেন যৌক্তিক নেতৃত্বে।
একটি শিশুর জন্ম তার মায়ের জন্য একই সঙ্গে সবচেয়ে বেদনার এবং সবচেয়ে আনন্দের। সন্তানের মুখ দেখলে মা ভুলে যান তার পেছনের ১০ মাসের কষ্টের ইতিহাস। একটি রাষ্ট্রের জন্মের পেছনেও থাকে অনেক সংগ্রাম, অনেক বেদনা, অনেক কষ্ট, অনেক রক্ত। বাংলাদেশের জন্মের পেছনেও ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রাম, ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ জড়িয়ে আছে।
একটি রাষ্ট্রের জন্ম অনেক বড় ঘটনা। তাই এর পেছনের কষ্টের কথা, নায়কদের কথা ভোলা যায় না। তাই উপলক্ষ্য যত আনন্দেরই হোক; আমি কখনোই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাঁথা, ৩০ লাখ শহীদের ত্যাগ, শরণার্থী হওয়া ২ কোটি মানুষের যন্ত্রণা, নির্যাতিত ২ লাখ নারীর বেদনা ভুলি না, ভুলতে পারি না। নত মস্তকে তাদের প্রতি সম্মান জানাই। তাদের কথা মনে করে দেশকে আরো বেশি করে ভালোবাসি। আমাদের পূর্বসুরীরা প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে যে দেশটি স্বাধীন করে দিয়েছে, আমরা ভালোবেসে সে দেশটিকে এগিয়ে নিতে পারবো না? সবসময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আমার হৃদয়ে এক ধরনের ঈর্ষা মেশানো ভালোবাসা আর অন্তহীন শ্রদ্ধা আছে। ঈর্ষা, কারণ আমরা যত যাই করি, আর কখনো মুক্তিযোদ্ধা হতে পারবো না। মুক্তিযোদ্ধারা জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান। এখন যার অবস্থান যাই হোক, একাত্তরে তারা জীবনের মায়া না করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধে। সেই ত্যাগের, সেই সাহসের কোনো তুলনা নেই, কখনো হবেও না।
সন্তান যেমনই হোক, তার মুখ দেখলেই মা ভুলে যান সব বেদনা। আমরাও শুরুতে একটা স্বাধীন দেশে পেয়েই খুশি ছিলাম। কিন্তু বাবা-মা কিন্তু সন্তান জন্ম দেওয়ার আনন্দেই দায়িত্ব শেষ করেন না। সন্তানকে লালন-পালন করে বড় করেন, মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। সেই সন্তান যখন সফল হয়, সবাই যখন তার প্রশংসা করে; গর্বে বাবা-মার বুক ভরে যায়। ৫৩ বছর বয়সী বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আজ সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমরা আজ গর্বিত দেশের নাগরিক।
বাংলাদেশের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল শূন্য হাতে। পাকিস্তান ২৩ বছর শোষণ তো করেছেই, মুক্তিযুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে যাওয়ার আগে সব সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে। এমনকি নেওয়া সম্ভব নয়, এমন সম্পদ পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। আর নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ছিল বিধ্বস্তপ্রায়। যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারাই পাকিস্তানী হানাদারদের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়েছিল। বিধ্বস্ত অবকাঠামো, শূন্য অর্থনীতি আর বিপর্যস্ত বাংলাদেশের তখন বন্ধুর চেয়ে শত্রুর সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়েই সংশয় ছিল অনেকের। বাংলাদেশের জয় যার জন্য পরাজয়, সেই হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে উপহাস করেছিলেন। ১৯৭১ সালে দাঁড়িয়ে চরম আশাবাদী কোনো মানুষও নিশ্চয়ই ভাবেননি, ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে পৌঁছাবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমার ভাবনায়ও আজকের বাংলাদেশ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স অল্প ছিল, তাই তখনকার বাংলাদেশের কথা পরে পড়ে জেনেছি। কিন্তু জিয়া এবং এরশাদের শাসনামল দেখেছি। তখন বিশ্ব মিডিয়ায় বাংলাদেশ শিরোনাম হতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। আর বাজেট করতে তাকিয়ে থাকতে হতো বিদেশি সহায়তার দিকে। সেই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল, বিশ্বের বিস্ময়। ৫৩ বছরে এমন বিস্ময়কর বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে থাকাটা আনন্দের, গর্বের।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লড়াই। সেই লড়াইয়েও নেতৃত্ব দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু দুর্ভাগ্য বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য কিছু মানুষ এক বছর যেতে না যেতেই জাসদ নামে নতুন দল গঠন করে দেশ পুনর্গঠনের লড়াইটা কঠিন করে দেন। নতুন দল করাটা সমস্যা নয়। একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে কেউ যে কোনো দল করতে পারে, সরকারের সমালোচনা করতে পারে। কিন্তু জাসদ নামে রাজনৈতিক দল হলেও তাদের কাজকর্ম ছিল অরাজনৈতিক এবং ষড়যন্ত্রমূলক। জাসদ রাজনৈতিক প্লাটফর্মের পাশাপাশি গণবাহিনী, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে ষড়যন্ত্রের জাল ছড়িয়ে দেয়। থানা লুট, পাটের গুদামে আগুন, এমপি হত্যা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসা ঘেরাও, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টা – এসবই ছিল জাসদের কর্মকাণ্ড।
দেশি-বিদেশি নানান ষড়যন্ত্রে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর থেমে যায় দেশ পুনর্গঠনের লড়াই। চেষ্টা হয় বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানী ভাবধারায় ফিরিয়ে নেয়ার। স্বাধীনতা বিরোধীরা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। পৌঁছে যায় ক্ষমতার কাছাকাছি। স্বাধীনতাবিরোধী শাহ আজিজ বনে যান প্রধানমন্ত্রী। ৭৫ থেকে ৯০ পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্ধকার সময়। জিয়া আর এরশাদের সামরিক শাসনের থমকে থাকে বাংলাদেশ। ৯০ সালে স্বৈরাচার পতনের পর ৯১ সাল থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের নতুন অভিযাত্রা। তবে ৯১-এর নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসায় স্বাধীনতা বিরোধীদের দাপট আরো বাড়ে। ২১ বছর পর ৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয় বাংলাদেশকে বাংলাদেশের লাইনে ফিরিয়ে আনার লড়াই। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ সুগম করে বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে দেশকে বের করে আনার লড়াই শুরু হয়। ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করেন শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ গ্লানিমুক্ত হয়। এরপর শুরু হয় সমৃদ্ধির পথে যাত্রা। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অভাবনীয় উন্নতি করেছে। উন্নতির ধারাটা এমনই চমকপ্রদ, অনেক সূচকে পাকিস্তান তো বটেই ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। আপনি আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন আর না করেন; এটা মানতেই হবে, স্বাধীনতার পরের প্রথম চার দশকে বাংলাদেশের যতটা উন্নতি হয়েছে, গত দেড় দশকে হয়েছে তারচেয়ে বেশি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু আমাদের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে আছে। আমাদের এখন সাবমেরিন আছে, স্যাটেলাইট আছে। মেট্রোরেল, কর্নফুলি টানেল, এক্সপ্রেসওয়ে, পারমাণবিক বিদ্যুৎ – একের পর এক নতুন নতুন অধ্যায়ে পা রাখছে বাংলাদেশ। পাঁচ দশক আগে দূরে থাক, দুই দশক আগেও বাংলাদেশের আজকের অবস্থান কল্পনা করা যায়নি।
বাংলাদেশ এখন স্বলোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে চায় বাংলাদেশ। তবে সামনের লড়াইটা আরো অনেক কঠিন। ছোট অর্থনীতির দেশগুলো সঠিক পরিকল্পনায় প্রাথমিক উন্নতি করাটা যত সহজ, সেই মোমেন্টাম ধরে রাখা ততটাই কঠিন। বিশ্বের আরো অনেক দেশ উন্নয়নশীলের কাতারে ওঠার পর একটা বৃত্তে আটকে গেছে। সেই ঝুঁকি বাংলাদেশেরও আছে। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশের সামনে অনেক সুযোগ কমে যাবে, বাড়বে চ্যালেঞ্জ। তবে সঠিক পরিকল্পনায় এগুতে পারলে কঠিন হলেও কাজটি অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির যে মোমেন্টাম ছিল, প্রথমে কোভিড, পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তাকে অনেকটাই থমকে দিয়েছে। তবে থেমে থাকলে চলবে না। সৃষ্টিশীল পরিকল্পনায় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হবে। সংখ্যাগত উন্নয়ন অনেক হয়েছে, এবার সময় এসেছে গুনগত উন্নয়নের। আর উন্নয়নের সুফল যাতে সব মানুষের কাছে পৌঁছায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। রাতারাতি হয়তো সম্ভব নয়, তবে কমিয়ে আনতে হবে বৈষম্য।
২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সে দেশের মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে পাকিস্তানের উন্নয়নে ‘সুইডেন মডেল’ অনুসরনের সিদ্ধান্ত হয়। সেদিন রাতেই পাকিস্তানের ক্যাপিটাল টিভিতে এক টক শো’তে সাংবাদিক জায়গাম খান ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সুইডেন নয়, পাকিস্তানকে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ বানিয়ে দেওয়ার আকুতি জানিয়েছিলেন। তার আকুতিটা এখনও আমার কানে বাজে, ‘খোদাকে ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো’। তবে তিনি এও বলেছিলেন, তিনি নিজেও জানেন এটা অসম্ভব। ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থায় পৌঁছতে পাকিস্তানকে ৯/১০ হারে প্রবৃদ্ধি করতে হবে, যেটা আসলে অসম্ভব। আর পাকিস্তান যখন হাচড়ে-পাচড়ে বাংলাদেশের অবস্থানে পৌঁছবে, তখন বাংলাদেশ পৌঁছে যাবো আরো ওপরে ধরা ছোয়ার বাইরে। আসলে বাংলাদেশ সারাজীবন পাকিস্তানের আক্ষেপের নাম হয়ে থাকবে। যারা ২৩ বছর ধরে নির্যাতন, শোষণ আর বঞ্চনায় আমাদের দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিল; তারা এখন বাংলাদেশের মতো হতে চায়, তবে তারাও জানে এটা এখন আর সম্ভব নয়। জায়গাম খানের সেই অসহায় আকুতি আমার মধ্যে অনির্বচনীয় আনন্দের অনুভূতি এনে দেয়।
উন্নয়নের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়াও এখন বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন, কৌশলগত কারণে হলেও ক্ষমতাসীনদের সাথে সাম্প্রদায়িক শক্তির যোগসাজস আমাদের শঙ্কিত করে। স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে কোনো পর্যায়েই আপসের কোনো সুযোগ নেই।
বলা হয়, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তেমনি সমৃদ্ধি অর্জন যতটা কঠিন, উন্নয়নের গতি ধরে রাখা তারচেয়েও কঠিন। দেশকে ভালোবাসার কথা মুখে বললে হবে না, ভালোবাসাটা নিছক আবেগ নয়। প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ করতে হবে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, প্রতিবাদ করার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, ভোট দেয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। মানবাধিকার পরিস্থিতিরও আরো উন্নতি করতে হবে। টেকসই উন্নয়নের জন্য গণতন্ত্র অপরিহার্য। আমরা চাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে উঠবে। বাংলাদেশের উন্নয়নের গাড়ি গতি পাবে গণতন্ত্রের মহাসড়কে।
প্রভাষ আমিন, হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ